পেয়েও না পাওয়া/তাপসী ঘোষ
পেয়েও না পাওয়া
তাপসী ঘোষ
মধ্য বয়স্কা খালেদা আর নন্দিতার বন্ধুত্ব লেখালেখির মাধ্যমে হয়েছে। বাংলাদেশে যাতায়াতের সূত্রে নন্দিতা ও খালেদার মধ্যে বন্ধুত্ব গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। তাদের বন্ধুত্বের গভীরতা এতই বেশী যে, নন্দিতা তার জনপ্রিয় গল্পটি যে নিজের পরিবারের একজনের জীবনী তুলে ধরেছে, সেটা পাঠক ও পরিবারের ছোটরা না জানলেও খালেদাকে কেবল জানিয়েছে।
ছোটোবেলা থেকেই মাতৃহীনা খালেদা বড়ো হয়ে ভারতে আসার চেষ্টা করেছিল, একজনকে খুঁজতে ও সুবিচার চাইতে। যিনি কিনা তার সব থেকেও আপন হয়ে হল না আপন। তার শৈশবটাকে ডুবিয়ে দিয়ে, সেই আপন মানুষটি কি করে সুখী থাকতে পারে, একবার নিজের চোখে খালেদা তাকে দেখতে চায়।
সময় সুযোগের অভাবে এতদিন আসা না হলেও এবার সত্যি সত্যিই খালেদা ভারতে আসবে নন্দিতার পরিবারের সেই একজনকে দেখতে, যাকে নিয়ে নন্দিতা বাস্তব ও কিছুটা কল্পনার আশ্রয় নিয়ে একটি গল্প লিখেছে। সেই গল্পের সাথে কিছুটা হলেও খালেদের জীবনে মিল আছে।
নন্দিতার জেঠিমা প্রতিমা দেবী বার্ধক্যজনিত রোগে দুর্বল হয়ে পড়েছেন, তবু ওনার আদেশই এই বাড়ির ছেলে মেয়েরা পালন করে। এই যেমন, নন্দিতার জেঠিমার আদেশ ছাড়া বর্তমানে এই বাড়ির গাছের একটা পাতাও পড়ে না। ওর জেঠামশাই অবনিবাবু নাকি জেঠিমাকে স্ত্রীর মর্যাদাই দেননি কোনোদিন , আবার ত্যাগও করতে পারেননি সামাজিক সম্মানের কথা ভেবে। অবনিবাবুর মতে তার দ্বিতীয় স্ত্রীর পরিবার ওনার সাথে প্রতারণা করেছে। সমাজের চোখে প্রতিমা দেবী ও অবনিবাবু স্বামী স্ত্রী হলেও লোকচক্ষুর আড়ালে প্রতিমা দেবীকে অবনিবাবু স্ত্রী মানতেন না । তবু প্রতিমা দেবী বুকের মধ্যে জ্বালা নিয়েও স্বামীর পরিবারের প্রতি কর্তব্যের কোনো ত্রুটি রাখে না । স্বামীর প্রথম পক্ষের সন্তানদেরও আপন স্নেহ মমতা দিয়ে মানুষ করেছেন।
বেশ কয়েকদিন ধরে প্রতিমা দেবীর অতিথি আপ্যায়ন ও স্নেহের আলিঙ্গনে খালেদা যেন এক আপনত্বের পরশ পায়। প্রতিমা দেবীকে দেখে খালেদের বারে বারে মনে হয় উনি ওর পূর্ব পরিচিত কোনো একজন। কিন্তু মনে করতে পেরেও পারছিল না খালেদা। যেদিন নন্দিতা ওদের পরিবারিক পুরোনো অ্যালবামে থাকা অল্প বয়সি গুরুজনদের ছবির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় তখনই খালেদা অবাক হয়, অ্যালবামে অল্প বয়সি প্রতিমা দেবীর যে ছবি আছে সেই ছবিতো তাদের বাড়িতে আছে।
'তুমি কেমন মা, নিজের আত্মজাকে ফেলে আসতে অন্তর কাঁপেনি' এই প্রশ্নটাই তো খালেদা তার মনের মধ্যে এতকাল পুষে রেখেছিল, আপন জন্মদাত্রীর জন্য। কিন্তু আজ চোখের সামনে তাকে দেখেও করতে পারছে না, এই কয়েক দিনেই প্রতিমা দেবীর স্নেহ মমতা তাকে দুর্বল করে দিয়েছে। স্নেহের তির বহু বছরের হোক বা দুদিনের, ঠিক নিশানায় এসে লাগলে কঠিন বস্তুও গলে যেতে বাধ্য।
নিজ পরিচয় দিয়ে জন্মদাত্রীর কাছে বিচার চাওয়ার সাহস না থাকলেও, নন্দিতার গল্পের নায়িকা উমা, মানে বাস্তবের প্রতিমা দেবী, তাকে খালেদা সাহস করে জিজ্ঞেস করেই ফেলে, আপনি নিজের একরত্তি মেয়েকে ফেলে এসে দ্বিতীয় পক্ষের ছেলে মেয়ে নিয়ে সংসার করছেন কি করে, আপনার পাষান হৃদয় কি কাঁদে না সেই ফেলে আসা মেয়ের জন্য। আবার আপনার সেই মেয়ে যদি আপনার কাছে এসে সন্তানের অধিকার দাবি করেন, তার সাথে যেতে বলে, তাহলে কি সিদ্ধান্ত নেবেন?
প্রতিমা দেবী প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলে, স্বেচ্ছায় জঠর জাতককে ফেলে আসব এতো পাষান আমি নই, বাবা দাদাদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আমার মতো অবলার রুখে দারোনোর ক্ষমতা ছিল না, আমি পরিস্থিতির শিকার।
দ্বিতীয়ত, ফেলে আসা সন্তান আজও আমার মনে প্রাণে আমারই আছে, কিন্তু আজ সে ডাকলেও ফিরে যেতে পারব না, কারণ এই বাড়ির সন্তানরা আমার রক্ত না হলেও তাদের সাথে ভালোবাসা ও মায়ার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
দেশে ফিরে যাওয়ার সময় খালেদা বলে গেল নন্দিতাকে, তোমার গল্পের অন্তিম পর্বে লিখো, দীর্ঘদিনের মায়া মমতার সংসার নামক নৌকাটার কাছে রক্তের দাবি বড়ই তুচ্ছ।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴