পূর্ণেন্দুশেখর গুহ : একটি আনন্দপাঠ/মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ী
পূর্ণেন্দুশেখর গুহ : একটি আনন্দপাঠ
মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ী
প্রয়াত লেখক দেবজ্যোতি রায় লিখছেন, পৃথিবীতে দু'ধরনের মৃত্যু আছে। এক ধরনের মৃত্যু হল পাখির পালকের মতো হালকা। কেউ মনে রাখে না। আর দ্বিতীয়টি হল পাহাড়ের মতো ভারী। দ্বিতীয় ধরনের মৃত্যু যাঁরা বরণ করেন তাঁদের অনুপস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পরবর্তী মানবসমাজ--তা যত ক্ষুদ্র পরিসরেই হোক না কেন। আজীবন বিপ্লবী মনোভাবাপন্ন পূর্ণেন্দুশেখর গুহর মৃত্যু হল এই দ্বিতীয় ধরনের। সমাজে যেসব মানুষ, সংখ্যায় কম হলেও বৃক্ষের মতো ঋজু থেকে যান আজীবন, পূর্ণেন্দুশেখর ছিলেন তাঁদের দলে। ফলে মৃত্যুর একত্রিশ বছর পরেও অগণিত গুণমুগ্ধের স্মরণে থেকে যান তিনি। সমাজে এ ধরনের লোকের সংখ্যা যত কমতে থাকে, ততই বেশি বেশি করে মনে পড়ে তাঁর কথা, তাঁদের কথা।
সম্পাদকের আলোচনা থেকে জানতে পারি, পূর্ণেন্দুশেখর গুহর জন্ম বর্তমান বাংলাদেশের রংপুর জেলার মাহিগঞ্জে, ১৯১৪ সালের ১১ই নভেম্বর। বাবা লালবিহারী গুহ, মা শতদলবাসিনী গুহ। মাত্র বারো বছর বয়সে পূর্ণেন্দুশেখর স্বদেশী আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হন। ফলে তাঁর ওপর পুলিশের নজর পড়ল। ভয় পেয়ে পরিবার তাঁকে পাঠিয়ে দিলেন ধুবড়িতে। সেখানে থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে আবার নিজের জায়গায় ফিরে তিনি কারমাইকেল কলেজে ভর্তি হলেন। যোগ দিলেন অনুশীলন সমিতিতে এবং সমিতির গোপন কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন।
ঊনিশ বছর বয়সে তাঁর এক বন্ধুর সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহের জন্যে তিনি গেছিলেন কলকাতায়। সেখানে গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়ে বন্দী হন। তারপর চলল বিচার। তাঁকে দেওয়া হল বারো বছর ছয় মাস কারাদণ্ডের সাজা, আন্দামান সেলুলার জেলে পাঠানো হল। বন্দী অবস্থাতেও তাঁদের নানাবিধ প্রতিবাদী আন্দোলন চলতে থাকল জেলের ভেতরে। একসময় আন্দামান থেকে রাজবন্দীদের ফেরত পাঠানো হয় ভারতে। কারাবাসের বাকি দিনগুলো পূর্ণেন্দুশেখরকে কাটাতে হয় আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। ১৯৪৫ সালে মুক্তি পান বন্দিদশা থেকে। বিভিন্ন সময়ে ইংরেজ শাসকরা তাঁকে ভালো চাকরি ও পুরস্কারের লোভ দেখিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সম্পর্কে গোপন তথ্য জানার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বারবারই তারা ব্যর্থ হয়েছে। জেল থেকে ছাড়া পাবার পর তিনি মাহিগঞ্জে একটি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। দেশভাগের পর শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে তিনি চলে যান ধুবড়িতে। তখন চাকরি পেলেন আসামের ম্যাচ কোম্পানিতে। এখানে তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সঙ্গে। তাঁর জীবন অন্য খাতে বইতে থাকে।
এই গ্রন্থটি কয়েকটি প্রবন্ধের সমাহার। লিখেছেন পিনাকী চৌধুরী, পারিজাত চৌধুরী, পার্থ নিয়োগী, শাহজাদা মিয়া আজাদ প্রভৃতি বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।
শঙ্কর দত্তগুপ্ত লিখছেন, ১৯৬০ সালে কোচবিহারে নিজস্ব বাসভবন নির্মাণ করেন পূর্ণেন্দুশেখর গুহ। সেখানে ছিলেন স্ত্রী নীলিমারানী গুহ, তিন কন্যা ও তিন পুত্র। তাঁরা যথাক্রমে রীনা গুহ, অশোক গুহ, স্বপ্না গুহ, স্নিগ্ধা গুহ, অলোককুমার গুহ এবং অরূপ গুহ। ১৯৭২ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতালাভের রজত-জয়ন্তী বর্ষ উপলক্ষ্যে তদানীন্তন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী তাম্রপত্র দিয়ে সংবর্ধনা জানান স্বাধীনতা সংগ্রামীদের। সংবর্ধিত হন পূর্ণেন্দুশেখর।
তিনি ফুটবল ও সাঁতারে ছিলেন পটু, অ্যাথলেটিক্সে সেরা। আমৃত্যু স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সংগঠনের কোচবিহার জেলা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এছাড়াও 'আন্দামান নির্বাসিত প্রাক্তন রাজনৈতিক বন্দি মৈত্রী চক্র' নামে আন্দামান রাজবন্দীগণের সংগঠনেরও সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৭১-এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এমন কি আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনেরও তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সমস্ত দিকেই বিচরণ করেছিলেন তিনি। ছিলেন পরোপকারী, দরদী এবং কর্তব্যপরায়ণ। ১৯৮২ সালে এই মহান মানুষটির প্রয়াণ ঘটে।
এমন একটি স্মরণীয়-বরণীয় মানুষকে আমরা এই গ্রন্থে কিছুটা হলেও অনুভব করতে পেরেছি যে সেজন্যে সম্পাদককে কৃতজ্ঞতা। ভাবীকালের জন্যেও তোলা রইল এই কথাগুলো। কিছুটা এজন্যে বললাম যে এইসব মহান মানুষের অবদান কিছু লেখায় ধরা যায় না। তাঁর প্রতিটি ক্ষণ দেশের জন্য সুচিন্তায় ও কার্যে ব্যবহৃত হয়েছে, তাঁকে অন্তরের শ্রদ্ধা জানাই।
গ্রন্থ:
পূর্ণেন্দুশেখর গুহ: একটি অধ্যায়
সম্পাদনা: নীলাদ্রি দেব
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴