পুরোনো আখরগুলি/রণজিৎ কুমার মিত্র
পুরোনো আখরগুলি
রণজিৎ কুমার মিত্র
"লিখন তোমার ধুলায় হয়েছে ধুলি
হারিয়ে গিয়েছে তোমার আখরগুলি।
চৈত্র রজনী আজ বসে আছি একা,
পুন বুঝি দিল দেখা।"
.......................................................................
'সহজ উঠোনে' র সকলের অত্যন্ত প্রিয় অনিন্দ্য সেনগুপ্তর আকস্মিকভাবে ভয়ংকর এক দুর্ঘটনায় অজানা পরপারে চলে যাওয়া আমাদের স্তব্ধ করে দিয়েছে। একজন প্রিয় অনুজের সাথে বিচ্ছেদের গভীর কষ্ট নিয়ে কোন অগ্রজের তাঁর সম্পর্কে লেখা বড় বেদনার। সম্ভবত ২০০৮ কিংবা ২০০৯ এর দিকে অনিন্দ্যর বীরপাড়া হাই স্কুলের মাস্টারমশাই সুপরিচিত কবি, বনভূমি পত্রিকার সম্পাদক, তুষার বন্দ্যোপাধ্যায় ,আমাদের তুষারদার মাধ্যমে পরিচয় হয়েছিল। পরে সে পরিচয় ভিন্নমাত্রা পায় আমার স্ত্রী রত্নার মাধ্যমে। অনিন্দ্য মাল বাজারে ডাক বিভাগে চাকরী করতো, রত্না ও ডাক বিভাগে জলপাইগুড়ি হেড অফিসে। মালবাজার থেকে ও মাঝে মাঝে হেড অফিসে এলে রত্নার সঙ্গে যোগাযোগ করত, লেখালেখির প্রসঙ্গে কথা হত আমার সঙ্গে তখনো ওর দেখা হয়নি। দেখা হয়েছিল অনেক পরে। মাল বাজারে পোস্টাল রিক্রিয়েশন ক্লাবের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে অনিন্দ্যরা 'ঠিকানা' নামে একটি বার্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করত, যার সূচনা হয়েছিল খুব সম্ভবত ২০০৯ থেকে। অনিন্দ্য মাল বাজারে থাকাকালীন প্রায় বছর পাঁচেক নিয়মিত সে পত্রিকা প্রকাশিত হতো। প্রত্যেকটি সংখ্যাতেই অনিন্দ্য আমার কাছে লেখা চেয়েছে ও প্রকাশ করেছে। ওই মাল বাজারে ডাক বিভাগেই কর্মরত ছিলেন আর একজন বিখ্যাত কবি সমীরণ ঘোষ। একসময় বাংলা কবিতায় অত্যন্ত সাড়া জাগিয়েছিল হাংরি জেনারেশন আন্দোলন। সমীরন ছিলেন এই কবিতা আন্দোলনের সক্রিয় কবি। অনিন্দ্যদেরএই 'ঠিকানা' পত্রিকার উপদেষ্টা ছিলেন সমীরণ ঘোষ। ২০১২র ২৫ নভেম্বর কবি সমীরন ঘোষ প্রয়াত হন। ২০১৩র ঠিকানা পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা হল সমীরণকে নিয়ে। এই সংখ্যাটির অন্যতম সম্পাদক ছিলেন অনিন্দ্য। মানুষ ও কবি সমীরণের কবিতার প্রতি অনিন্দ্য-র ছিল গভীর অনুরাগ ও শ্রদ্ধাবোধ। সমীরণের ছটি কাব্যগ্রন্থ' রক্তবীজ',' প্রতিভূমিকা,' 'রহস্যবৃষ্টি', 'মুষলগর্ভ', 'এক অন্ধ আরেক চক্ষুষ্মান' ও 'দারিদ্র বিক্রি আছে'নিয়ে এক রবিবারের দুপুরে অনিন্দ্য হাজির হয়েছিল আমাদের বাড়িতে, সমীরণের কবিতা নিয়ে লিখবার জন্য। ততদিনে রত্না ও অনিন্দ্য , দিদি ও ভাই। ২০১৩তে ঠিকানার সেই বিশেষ সংখ্যায় 'রক্তবীজ'এর ছায়ায়' এই শিরোনামে লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল। উত্তরবঙ্গের অগ্রজ কবিদের সম্পর্কে অনিন্দ্য ছিল গভীর শ্রদ্ধাবোধ। সমীরণ ঘোষের সান্নিধ্য ও বেশ কয়েক বছর পেয়েছিল। কবি তুষার বন্দ্যোপাধ্যায় এর ছাত্র ছিল ও। ওর নিজের মুখে শুনেছি কবিতার প্রতি ওর আগ্রহ জন্মে তুষার বন্দ্যোপাধ্যায় যখন ওদের বাংলা ক্লাসে কবিতা পড়াতেন তখন থেকে। স্কুল ছেড়ে দেবার পরও তুষার দার সাথে ছিল ওর গভীর সংযোগ। তুষারদা অনিন্দ্যের লেখা সম্পর্কে প্রশংসা করতেন ওকে ভালবাসতেন খুব। কথায় কথায় অনিন্দ্য বলেছিল, "কবি তুষার বন্দ্যোপাধ্যায়ের যথার্থ মূল্যায়ন হয়নি।"
নতুন প্রজন্মের কবি লেখকদের কাছে তুষার বন্দ্যোপাধ্যায়কে তুলে ধরবার শ্রদ্ধাপূর্ণ চেষ্টা ও অনবরত চালিয়ে যেত। গতবছর বীরপাড়ায় ওদের পত্রিকা তাতাসি( রোববারের সাহিত্য আড্ডা ও ভাবনা সাহিত্যধর্মী পত্রিকার যৌথ প্রয়াস) আয়োজন করেছিল তুষার বন্দ্যোপাধ্যায় স্মরণে সাহিত্য সভা। সেই সভায় তুষার বন্দ্যোপাধ্যায় স্মারক বক্তৃতা দেবার জন্য আমাকে আমন্ত্রণও জানিয়েছিল। আমি যেতে পারিনি, জলপাইগুড়ির বাইরে আমাকে কয়েক মাসের জন্য থাকতে হয়েছিল, তবে তুষার দা কে নিয়ে একটি বিস্তৃত লেখা দিয়েছিলাম 'তাতাসি'র জন্য। কবি বেণু সরকারকে তুষার বন্দ্যোপাধ্যায় স্মারক পুরস্কার প্রদান করা হয়েছিল সেই অনুষ্ঠানে। কয়েক সপ্তাহ আগে এই নিয়ে অনিন্দ্যর সঙ্গে কথা হচ্ছিল তাতাশির আগামী সংখ্যার জন্য লেখা চেয়ে নিয়েছিল। এবং কবুল করিয়ে নিয়েছিল 'তাতাসি' এবছরের বার্ষিক সাহিত্য অনুষ্ঠানে আমি অবশ্যই উপস্থিত থাকব। আমাকে কথা রাখবার সুযোগ না দিয়েই ও চলে গেল কথাহীন জগতে। ২০১৫ তে রত্নাকেও আকস্মিকভাবে হারিয়েছিলাম সেই বোধ হয় শেষ অনিন্দ্য আমাদের বাড়িতে এসেছিল, আমার প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রণা কমাতে। কি নিষ্ঠুর আয়রণি, এবারে অনিন্দ্যের সাথে বিচ্ছেদর যন্ত্রণা কে কমাবে? তবুও 'হারায় যা তা হারায় না'। এখনো মোবাইল ফোনে অনিন্দ্যর সচিত্র ফোন নাম্বার, হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার রয়েছে, ওটুকু থাক। যদি অলৌকিকভাবে ওপার থেকে কখনো শুনতে পাই স্যার কেমন আছেন? 'তাতাসি' যে একটি নদীর নাম অনিন্দ্যর কাছ থেকেই জেনেছিলাম। কুলি নদীর ধারে ওদের আড্ডা, পদ্মশ্রী ধনীরাম টোটোর সঙ্গ, আঙরাভাসা নদীর ধারে কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের জন্মদিন পালন, ওর পরিকল্পনা ছিল তুষারদার সমগ্র কাব্য সংগ্রহ প্রকাশ, এইরকম কত ইচ্ছের কুঁড়ি বিকশিত না হতেই ঝরে গেল। পরপারের অজ্ঞেয় জগতে কে কেমন থাকে জানি না, তবু তুমি ভালো থেকো, অনিন্দ্য, তোমার সব যন্ত্রণা কষ্টের উপশম হোক।
...........................................................................
"কোমল তোমার অঙ্গুলি ছোঁওয়া বাণী
মনে দিল আজ আনি।
বিরহের কোন ব্যথা ভরা লিপিখানি
মাধবী শাখায় উঠিতেছে দুলি দুলি
তোমার পুরাণো আখর গুলি।"
________________________________________
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴