পুজোর আলো অন্ধকার/মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস
পুজোর আলো অন্ধকার
মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস
-----------------------------
বিপুল উষ্ণায়নে প্রবল আলোর মতো এস।ষষ্ঠীপুজোয় কখনো যন্ত্রের আঁকিবুকি আর শব্দে পা রাখিনি। উমা এলেন ঘরে। মা চললেন পর্বতে হিমালয়ের কাছে।এমন হয় নাকি কখনো! হল তাই...পথ বদলে গেল, গ্রন্থি বেঁধে বেঁধে মুখগুলো গুনি ফেলে আসা অতীতের ধুলো থেকে অনর্গল।... যাবতীয় প্রেমকথা অক্ষরে অক্ষরে টুকরো জলে ভাসে।নৌকো তখনো দাঁড়ায় এসে অনন্ত পথ জুড়ে।বার বার 'পুরাণ' রচনা হয়না।প্রেমও না। সমস্ত বাতাস থেকে রাখালের বাঁশি তখন নির্ভাবনায় বাজে,শস্যবীজ থেকে তুলে আনি অসংখ্য গম রঙ,শরীরে মাখি,শব্দ আলো আমার ভাল থাকার ঘর হয়ে যায়। সেখানে মা'র আঁচলে পাই পোলাও সুবাস, নতুন শাড়ি জড়ানো হয়েছিল মার শেষের কয়েকবছর! অঞ্জলি দেওয়ার ডাক ডেকেছিল কে! হিমালয়ে চলে যাওয়া মেয়ে আর ফিরলনা বলে দু:খের কালো রঙ আর সাদা রঙ দাগ রেখে গেল অদৃশ্য বাতাসে।
ক্রমশ কথা ফুরোয়। শব্দের রঙ শিউলি হয়ে টুপটাপ ঝরে বারান্দা অথবা মাটির রোয়াকে। এত সকলের ই ছুঁয়ে দেওয়া অনুভব।একখানা বাড়ির হয়েইতো সে আর নেই,ঝরানো ফুল পৌঁছে যায় ডালে ডালে এপাশের ইটের প্রাচীর পেরিয়ে পুবদিকের রেশমিদের বাড়ি অথবা পশ্চিমে অসীমকাকুর উঠোনে আর সরু গলিটা পেরিয়ে কাজলীদের বাড়ির ছাদেও ফুল ঝরিয়ে আসে শিউলি মেয়ে।...আমি হলে সে শিউলী হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে ছেনে পাগল হয়ে যেতাম। ঈর্ষার জন্ম কি শিউলি দিতে পারে কখনো! অবাক হয়ে ভাবি দু পা বাড়ালেই যখন কাজলী ও পার থেকে মুখ বের করলেই দেখা যায়,সে তখন দূরভাষে বলে,'দিদি তোমাদের শিউলির ডাল আর পাতা গলিটাকে বড় নোংরা করছে, আর ফুল ও তো আমরা নিইনা...ডালগুলো কি লোক দিয়ে কেটে দেব? কিংবা পুবদিকের বাড়ির অসীম কাকুর স্ত্রী কাকিমা নাকি রাস্তার আলো গার্ড করে দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে।
কর্মসূত্রে থাকতে হয় মাঝে মাঝেই বাড়ি ছেড়ে দূরে।এসব কথায় মাথাল ভিতর ছোটখাট আগুন জ্বলে।কাজলীর দুই ছেলে প্রতিবছর দেওয়ালিতে হার্ট অ্যাটাক করা শব্দ তোলে বাজি পটকা মানে বোমের শব্দে। দু'একবার বলেও কোন ফল হয়নি বা হয় না।সে আগুন হলকা এসে লাগে শেফালির শরীরে সবুজ শক্ত খসখসে পাতায়। সে শিউলি পাতার রসে চিনি মিশিয়ে কত সকালে উপবাস ভেঙেছে আমার।মার হাতের যত্নে অথবা এখন আমার রান্নাঘরে শেফালি পাতার বড়া হয়।গন্ধে মন ভরে। সে অনুভব ভাগ করে নেওয়া যায়না কেন! কেন মনের জায়গাটা সকলের এক হয়না!কেন? বিনিদ্র রাত কেটে যাওয়ার পর ভোরের আলো কেটে তীব্র হতে না হতেই সব দ্বিধা ছেড়ে কাজলীকে ফোন লাগাই...'না কাজলী, শেফালির গাছের ডালে হাত দিওনা।লোক লাগিওনা।এখন শরৎকাল।আমাদের রাস্তায় একটাই বড় গাছ।আলোর মায়ায় মাখামাখি।ফুল তুমি নাওনা,আমি তুলি,পুজোর আসনে দিই।অদ্ভুত বোঁটায় কমলা রঙ।তোমার ছেলেরা দেখেছে তো? ওদের দেখিও শিউলি ফূল কাকে বলে...দয়া করে 'শিউলি'র ইংরেজি শব্দ শেখাতে যেওনা।...আর পুজো পেরিয়ে যাক,শিউলির ডাল আমিই লোক লাগিয়ে ছেটে দেব,অসীমকাকুর বাড়িতেও নিশ্চয় ই জানিয়ে দিও।
* * *
এখন বেশ স্বস্তি লাগছে। এবারে বাড়ি ফিরেছি তোর্সার দু'ধারের সাদা হয়ে থাকা কাশের ঝাড় দেখতে দেখতে...তিস্তা ব্রীজ পেরোতে পেরোতে নীল আকাশের গায়ে সাদা মেঘের মত লেগে থাকা কাশের ঝাড় টেনে নেয় মন। অদ্ভুত বাড়ি বাড়ি করে ভিতরটা।যেমন অনেক আগে তিস্তা ছেড়ে তোর্সার দিকে ছুটতে হ'ত বাড়িতে অপেক্ষায় থাকা দুটো মানুষের জন্য,যাঁরা সকাল হতেই বাইরের গাছের ছায়ায় মেয়ের রিক্সার ঘন্টি শুনবে বলে বসে থাকত,অথবা ঘর বার করত, সেই আমার সারা জীবনের শৈশব কৈশোর যৌবন এক ই ভাবে দৌড়ে যায় অনন্ত অভিসারে।একই রকম করে শিউলি গন্ধ কাশের হাওয়া আমার পুজোর গন্ধ হয়ে যায়। ভগবান আমার কাছে কাজের উৎস। গীতার বানীর মত।ফলের আশা করে সে কাজের অন্তরালে থাকেনা।
* * *
কোভিদ কালীন দুটো বছর এ আকাশই তো দেখেছি পরম উদার স্নেহে। সোনালি ডানার চিল দেখেছি অনন্ত পথে। বিন্দুর মত কালো ফোঁটা ধীরে ধীরে বড় হয়ে এসে ডানার বাতাস দিয়ে ছাদের রেলিঙ এ এসে দাঁড়িয়েছে। তার বাঁকিনো ঠোঁট আর উজ্জ্বল চোখ আমাকে স্কুলবেলায় নিয়ে গেছে কতবার।আর 'সহজ উঠোন' বন্ধু হয়ে হাত বাড়িয়েছে। কত লিগেছি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা।ছবিতে এলার্জি এই আমি কত যে ছবি তুলেছি প্রকৃতি থেকে মানুষের...নিজের ও।এই যে শরৎ এ আমার শারদীয়া।অন্য পুজোর স্থানিক বাতাবরণ স্পর্শ করতে চলেছি...সে হবে রুখুশুকু বাঁকুড়া হেলনা শুশুনিয়ার মাটি। সজল বহু আদর অপেক্ষা করছে যে ঐ লালধুলো ওড়া মাটিতেই। কন্যা অপেক্ষা করছে হিমালয়ের গভীর শরীরে।ফিরে দেখব,নতূন করে আলো জ্বলছে ওদের সাবেকি মন্দিরের দর দালানে, তুলে নেব সে কাঠামোর মাটি ঘেরা রূপ আর অপরূপ মুখশ্রী।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴