সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon

পাহাড়ে বাঙালি পাড়ার গল্প /ভাস্বতী শ‍্যামচৌধূরী

পাহাড়ে বাঙালি পাড়ার গল্প 
ভাস্বতী শ‍্যামচৌধূরী

যে ছিলএকদিন একটাবড়  পাহাড় ,তাকে ভেঙে লোকালয় গড়ে উঠল; তৈরী হল তিনটি পাড়া __   ওপরের পাড়ার রাস্তার নাম Morgan Road, মাঝের পাড়ার   রাস্তাটার নাম হল Goode  Road আর  নিচের পাড়ার রাস্তাটার নাম হল Ferndale Road যেটা পরে নামটা বদল  হয়ে নেপালী কবি Rup Narayan Sinha র  নাম অনুসারে  R.N Sinha Road হয় । এই পাড়াটা ছিল  আমার নিজের। কোথায় ছিল জানেন?সে ছিল পাহাড়ের রানী দার্জিলিঙে ।

দার্জিলিং পশ্চিমবঙ্গেরই  অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু  বাঙালিয়ানার কোন ছোঁয়া ওখানে নেই। তাই পশ্চিমবঙ্গের শহর বলে তাকে মনে হয় না।   দার্জিলিং শহরে ব্রিটিশ আমল থেকেই অনেক বাঙালি পরিবার  স্থায়ী  ভাবে বসবাস করত। অবিভক্ত বাংলার  বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে তারা শহরের গোড়াপত্তনের সময় থেকে বাড়ি  বানিয়ে থাকতে শুরু করে।  তারা কেউ চাকরি সূত্রে আবার কেউবা  ব্যবসার কারণে দার্জিলিঙে এসেছিলেন। আমাদের পাড়ার   সব বাড়িগুলোই  বাঙালিদের ছিল,তবে শর্ত অনুসারে  কেউ বাড়ি বিক্রি করলে তা বাঙালিকেই  করতে হবে।  বাড়িগুলোর খুব সুন্দর সুন্দর নাম ছিল  যেমন  'উষসী', 'মেকনফসিস', 'পঞ্চবটি', 'কাঞ্চনী', 'দীপ্তিকুটির',  'দি লাইট', 'অমিয় কুটির',  'দীনেনকুটির'  'অবিনাশ ভবন' ইত‍্যাদি। বাড়িগুলোর সমস্ত  মানুষজন এমন ভাবে বসবাস করত  মনে হত তারা যেন একই পরিবারের মানুষ । সবাই সবার সুখে দুঃখে অংশীদার হত। এই পাড়াতেই আমার জন্ম অমিয় কুটিরে। 

এখানে পাড়ার সব কাকিমা,জেঠিমা, মাসিমা,  ঠাকুমা, দাদু, জেঠু, কাকু, দাদা, দিদি, ভাই, বোন  সবাই  ছিলাম যেন একই পরিবারভুক্ত, আনন্দ-বিষাদ সবাই ভাগ করে নিতাম।  কাকিমা জেঠিমারা  আদর করে খাওয়াতেন । কাকু জেঠুরা  অভিভাবকের মতন আগলে রাখতেন। আমাদের পাড়া ছাড়া আরেকটি পাড়া ছিল, যার নাম চাঁদমারি। সেখানেই সবচেয়ে বেশি বাঙালিরা থাকত। সব জায়গাতেই একে অপরের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল, ঠিক যেন একই পরিবারের মানুষ।

ওখানে বিশেষ কয়েকজন  ছিলেন যারা কয়েক পুরুষ ধরে দার্জিলিঙে বসবাস করেছেন।  যেমন শ্রীযুক্ত মন্মথ চৌধুরী ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা করতেন, শ্রীযুক্ত সূর্যকান্ত বোস ওখানে ছাপাখানা খোলেন, শ্রীযুক্ত প্রফুল্ল চ্যাটার্জি কয়লার ব্যবসা করতেন,   স্বনামধন্য  সরকারি  উকিল শ্রীযুক্ত মহেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি ওনার উদ‍্যোগেই গড়ে উঠেছিল "নৃপেন্দ্রনারায়ণ হিন্দু পাবলিক  হল"    আর "কাশেশ্বরী গ্রন্থাগার"।
ওনার বাড়ির নাম ছিল ''বলেন ভিলা"  এখানেই  স্বামী বিবেকানন্দের পদধূলি পড়েছিল, স্বামীজী  সাতাশি দিন "বলেন ভিলায়'' ছিলেন আর চারদিন ছিলেন 'রোজব‍্যংকে', যেটা বর্ধমান রাজবাড়ির কাঠের দোতলায় ছিল। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুরও দার্জিলিঙে বাড়ি ছিল যার নাম 'রায় ভিলা' ; এখানেই ভগিনী নিবেদিতা জীবনের শেষ দিনগুলো  কাটিয়েছিলেন ।
  
 বছরের বিভিন্ন সময়ে নানা উৎসবে বাঙালির মিলনমেলা হত। যেমন দুর্গাপুজো, দেওয়ালি, সরস্বতী পুজো, পয়লা বৈশাখ, রবীন্দ্র জয়ন্তী  ইত্যাদি।দুর্গাপুজোকে ঘিরে সবাই আনন্দে মেতে উঠত, তখন সব পাড়া মিলে একটা মাত্র পুজো হত। আমরা এবেলা ওবেলা জামা পাল্টে ঠাকুর দেখতে যেতাম। দুপুরবেলা পেট ভরে প্রসাদ খাওয়া, সন্ধ‍্যাবেলা আরতি, তারপর নাটক _ সব মিলিয়ে জমজমাট ব্যাপার। অষ্টমীর দিন আমাদের বাবা কাকারা   ধূতি পাঞ্জাবি পরতেন, মেয়েরা শাড়ি পরে অঞ্জলি দিত। সব থেকে আনন্দের ছিল আমাদের ঠাকুর  বিসর্জনের পদ্ধতি  ও অভিনব শোভাযাত্রা। ছেলেরা কাঁধে করে মাকে পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে বহু দূর হেঁটে  
"এসো  মা অভয়া
হও মা সদয়া,
বারে বারের মত  এসো"
এই গানটা গাইতে গাইতে বিসর্জনে নিয়ে যেত। তারপর   বিজয় দশমীর কোলাকুলি, বাড়ি বাড়ি মিষ্টি খাওয়া। এই ছিল আমাদের পুজো। এই ভাবেই  পয়লা বৈশাখ, রবীন্দ্র জয়ন্তী ও অন্যান্য অনুষ্ঠান নাচ, গান  ও নাটকের মধ্যে দিয়ে পালন করা হত। তখন অভিনেত্রী মিতা চট্টোপাধ্যায় দার্জিলিঙে ছিলেন ওনার স্বামী শ্রীযুক্ত  বিমল চট্টোপাধ্যায় দার্জিলিং সরকারি কলেজের বাংলার অধ্যাপক ছিলেন, উনি আমার শিক্ষক ছিলেন। মিতা চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় এখানে  অনেক নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল ।  সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খেলাধুলা, পড়াশোনা, সবকিছু নিয়েই আমাদের জীবন পরিপূর্ণ ছিল।  দার্জিলিঙের ছেলেমেয়েরা হকি ব‍্যাডমিন্টন খুব ভালো খেলত এই দুটি খেলায় অনেকেই সাফল্য অর্জন করেছিল  । 

ওই ছোট্ট শহর থেকে অনেকেই পরবর্তীকালে  কৃতি  হিসাবে বাংলা তথা দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন,যেমন বামফ্রন্টের অর্থমন্ত্রী শ্রীযুক্ত অসীম দাশগুপ্ত ,  সুরকার শ্রীযুক্ত সুধীন দাশগুপ্ত,  যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের   ইলেকট্রিক্যালের  অধ্যাপক শ্রীযুক্ত  নির্মলেন্দু চট্টোপাধ্যায়, ইলেকট্রনিক্সের  অধ্যাপক শ্রীযুক্ত সলিল সান্যাল, প্রেসিডেন্সী কলেজের  ফিজিক্সের   অধ্যাপক শ্রীযুক্ত প্রদ্যোৎ রায়, বেথুন কলেজের বাংলার অধ্যাপিকা শ্রীযুক্তা  দিবা মিত্র. গণসংগীতের   সুরকার, গীতিকার ও গায়ক  কঙ্কন ভট্টাচার্য‍্য, স্বনামধন্য বৈজ্ঞানিক শ্রীযুক্ত বিপুল  বিহারী সাহা, সাংবাদিক  শ্রীযুক্ত তুষার  পন্ডিত প্রমুখ। আরও অনেকেই শিবপুর  বি ই কলেজ, যাদবপুর বিশ্বিবিদ‍্যালয় আইআইটি, প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে পাস করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।

এরা সবাই আমাদের দার্জিলিঙের  বাঙালি  পাড়ার মানুষ ।দার্জিলিঙের একমাত্র মেয়েদের  বাংলা মাধ্যম স্কুল ছিল মহারানী বালিকা বিদ্যালয়। এটি স্থাপন করেছিলেন শ্রীযুক্ত শিবনাথ শাস্ত্রীর কন‍্যা শ্রীযুক্তা হেমলতা সরকার। ঐ স্কুলের শিক্ষাতেই আজও দার্জিলিঙের  বাঙালি মেয়েরা প্রতিষ্ঠিত  ।

দার্জিলিঙে বাঙালিদের এই অবস্থান এখন অতীত  ;  সেখানে বাঙালিদের অস্তিত্ব এখন আর  নেই। একে একে সবাই বাড়ি বিক্রি করে   সমতলে চলে গেছেন। দার্জিলিং এখন গোর্খাদের   কবলে। ওখানকার  সেই আভিজাত‍্য ও বনেদিয়ানা আর নেই। ঘিঞ্জি,নোংরা ব্যবসার কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে; সমস্ত গাছ কেটে পাহাড়ে বাড়ি বানিয়ে  দায়িত্ব নিয়ে  শহরটাকে ধ্বংস করেছে। এখন পাহাড়ের রানী অন্তঃসারশূন্য অর্থ উপার্জনের কেন্দ্র  মাত্র। যেখানে কোন আনন্দ নেই , নেই কোন ভালোবাসা। 

বহুদিন পর গত বছর গিয়েছিলাম জন্মভূমিকে দেখতে, কিন্তু খুবই কষ্ট  পেয়েছি এবং হতাশ হয়েছি। এখন আমাদের   সেই  বাড়ি আর নেই। একদিন যেখানকার সমস্ত মানুষ ছিল আমার চেনা, এখন সেখানে কেউ আমাকে চেনে না। নিজের শহরেই আমি যেন সম্পূর্ণ অচেনা, অপরিচিতা   এক পরিব্রাজক । 

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri