সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon

পাহাড়ি পথ আর জঙ্গল ঘেরা দুর্গ/মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস

পাহাড়ি পথ আর জঙ্গল ঘেরা দুর্গ
মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস

জঙ্গুলে পথে চলব বলেই তো আমাদের জন্ম এ অরণ‍্যধারে। এদিকে ওদিকে বড় নদী, মাঝে মাঝে ছোট পাহাড়ী ঝোরা অথবা নদীর ঢেউয়ের মতো নীলচে জল। শৈশব কেটেছে তোর্সার কাছে।জলকথা, কচুরীপানা আর চরের মানুষের মুখের ভাষা আর বুনো পাতার গন্ধে। তিস্তার ধারে বসত হতেই একঝাঁক সবুজ জড়িয়ে নিয়েছে উদার অলস মেঘের মতো। ডায়না নদীর ধার ঘেঁষে শৈশবের না শোনা না দেখা জল অথবা নুড়িপাথর ভেঙে পেরিয়েছি। যৌবন কেটেছে মাগুরমারি, বালাসন মহানন্দাকে ভালোবেসে। ভেজা মাটির গন্ধ আর বৃষ্টিভেজা অরণ‍্য বার বার ডেকেছে।
গত দশবছর প্রায় সময়ই ছাত্রীদের নিয়ে চিলাপাতার জঙ্গল, রাজাভাতখাওয়া, অদূরে ছিপছিপি নদীঘেরা অদ্ভুত অন্ধকার।...হঠাৎই এক দুর্গাপূজার ছুটির শেষদিকে ঠিক হল পারিবারিক ট‍্যুর হোক একখানা।এর আগে কখনো ট্রেকিংএ যাইনি। এবার সেই পাহাড় ঘেরা বক্সাদুর্গের দিকে। আমাদের আটজনের দল আনন্দে যাত্রার সঙ্গে ভাবছে উঠতে পারব তো! দূর হোক ভয়। আমরা পরিকল্পনা মতো আলিপুর থেকে রওনা। বক্সা রোডে রাস্তা ভাগ হয়ে ডান হাতে চলে গেছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভরা জয়ন্তীর রাস্তা। বাঁ দিকে বাঁক ঘুরে বক্সার বনপথ। অদূরে মাথা তুলে আছে অরণ‍্য। দিগন্ত বিস্তৃত সিনচুলা রেঞ্জ। সান্ত্রাবাড়িতে গাড়ির রাস্তা শেষ। নির্জনতার শব্দ নিতে নিতে চলে এসেছি বন‍্য নাম না জানা পাখির টি টি-র শব্দ শুনতে শুনতে।
এবার দুর্গম পথে এঁকেবেঁকে পথের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া। পাহাড়ি পথের দুধারে ছড়িয়ে আছে হিমালয়ের গাঢ় সবুজ অরণ‍্য। কত যে নাম না জানা পাখি ডাকছে। দুপাশের বহেরা, সাজ, চিলৌনি চাঁপ গাছের সঙ্গে শাল সেগুনও বাদ যায়নি। ঘন অরণ‍্য পথে দু একখানা বাঁদর পরিবার আর বেশ বড়সড় সাইজের স্কুইরেল। যাদের দেখা যেত সমতলে ছোট ছোট। রক্তচোষা বলতাম তখন মনে আছে। ইনহেলার মজুত রেখেছি, আমাকে নিয়ে কারো যেন অসুবিধেয় পড়তে না হয়! অনেক দূরে দূরে রূপোর জরির মতো পাহাড়ি নদী আর আর ঝোরা। পথে খানিকটা উঠতে উঠতেই এখদল বিফল মনোরথ ফিরে আসা পর্যটকদের সঙ্গে দেখা। বেশি কথা না বলে এগিয়ে চলেছি। মুখোমুখি হচ্ছি কিছু ডুকপা আর নেপালি ছেলেমেয়েদের সঙ্গে যারা পিঠে বোঝা বা মোট নিয়ে চলেছে সান্ত্রাবাড়ির দিকে নেমে। হাটে পসরা সাজাবে বলে। দ্রুত পায়ে তাদের চলন। আমাদের সঙ্গে সহকর্মী ঊর্মি আর ও হাজবেন্ড ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে আছে। সেই সাত আট বছর বয়সী মেয়ে একেবারে খরখরে অমসৃণ পথের খাঁজে খাঁজে পা রেখে দ্রুত উঠে যাচ্ছে কাঠবেড়ালির মতো।
পথ চলায় গভীর মনোযোগী আমরা চুপচাপ। দম নষ্ট করব না কেউ। মধ‍্যে মধ‍্যে দাঁড়িয়ে পড়ে বিশ্রাম, টুকটাক রসিকতা আর ক্লান্ত হতেই সুরজের দেখানো ডুকপাদের ঘিরে নেওয়া এক সমান জায়গায় অদ্ভুত সুন্দর চা খেয়ে নিয়ে চলতে থাকা।
আবার দুর্গম পথে চলা। পাশাপাশি হাঁটা নয়, সরু কিছু পথ খুব সাবধানে পর পর হাঁটছি। হাঁফিয়ে পড়লে চলবে না। ওরই মধ‍্যে দুজন সঙ্গীর পায়ে জোঁকের অস্তিত্ব। সান্ত্রাবাড়ি থেকেই আমাদের দুই গাইড সুরজ আর নিংমা ওরাই দায়িত্ব নিয়ে জোঁক ছাড়িয়েছে। বুনোগন্ধ,বন‍্য পাখির ডাক সব কিছুর মধ‍্যেই বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। একটু পর নামবে অন্ধকার। ইতিমধ‍্যে অন্ধকার নিকষ হচ্ছে।সুরজের মাথায় লাগানো সার্চ আলো আর মোবাইলের টর্চ খুব কাজে লাগছে। ডুকপা দুই তরুণের হাত ধরেও মাঝে মাঝে পথ ভেঙে উপরে উঠতে হয়েছে। পাথুরে জঙ্গল ই আমাদের খাড়াই পথে সিঁড়ি তৈরি করেছে ছমছমে জঙ্গুলে অনুভূতি এ রাতের পথ চলায়। কিছুক্ষণের মধ‍্যেই চাঁদ জ‍্যোৎস্নায় পৌঁছে গেলাম হোমস্টের কাছাকাছি। দূর থেকে তার মৃদু আলো দেখিয়ে পথে নিয়ে চলল সুরজ নিংমা।আমাদের ড্রাইভার দীপকও আছে সঙ্গে।
কাঠের নড়বড়ে সিঁড়ি বেয়ে কাঠের টং ঘরের বারান্দায় পৌঁছে নিশ্চিন্তি।...ইতিমধ‍্যে সুরজ জানিয়ে দিয়েছে বক্সা বহু শতাব্দী প্রাচীন জনপদ। ভোট শব্দ পাশাখা থেকে বক্সায় বিবর্তন ঘটেছে নাম।
দুই গাইড সুরজ আর নিংমা আমাদের লাগেজ দুটো ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। নীচের ঘরে থাকবে দীপক ড্রাইভার। আমরা জমিয়ে বসেছি চা খেয়ে চাঁদের আলোয় দুর্গকে কেমন লাগে দেখতে ছুটব।  ইতিমধ‍্যে গরম গরম চা আর ক্রমশ ঠান্ডা হাওয়ার তীব্রতায় জমে গেছে। সঙ্গে শুকনো ম‍্যাগী মাখা আর মুড়ি।এদিক সেদিক থেকে হাওয়ায় ভাসছে ঘন্টাধ্বনি।সেই সুরজের কাছে শোনা বৌদ্ধ মনাষ্ট্রির কথা মনে পড়ছে। উড়ছে দূরে লম্বাটে পতাকাগুলো।রঙ বোঝা যাবে খুব সকালে। রাতের রোমাঞ্চে কেমন মায়া ছায়া মাখা।
অদ্ভুত নির্জনতা গাঢ় হচ্ছে ক্রমে। গল্পের ফাঁকেই ধোঁয়া ধোঁয়া নিজেদের নিঃশ্বাস শব্দ উঠছে। আমাদের মধ‍্যে দু একজন অসমসাহসী ঐ রাতেই রান্নার ফাঁকে চলল রাতের মায়াময়তায় দুর্গের রূপ দেখবে বলে। নীচে রান্না চলছে। হোমস্টের মালিক সুরজ সহযোগি নিংমাকে নিয়ে উপর নীচ দৌড়োদৌড়ি করছে। কাঠের অদ্ভুত ঘরে কম্বলটা খুলব কি খুলব না করেও সকলেই পায়ের ওপর নিয়ে গল্প জুড়েছি। ভৌতিক গল্প,গান ইত‍্যাদিতে মনে হচ্ছে নাগরিক সভ‍্যতা থেকে বহুদূর আমরা। যেখানে এই জঙ্গলের রমনীয়তার সঙ্গে বিরাট ফারাক। যারা দুর্গ দেখতে গিয়েছিল কিছুক্ষণের মধ‍্যেই ফিরে এল। আসলে হোমস্টে থেকে এক বিরাট মাঠ পেরিয়ে তবেই দুর্গের প্রবেশ পথ। যতই চাঁদের আলো থাক, আশপাশের অন‍্যান‍্য হোমস্টে আর অন‍্যান‍্য জনজাতির মানুষজনের নিষেধে তারা রাতে আর সাহস দেখায়নি।
হঠাৎ হঠাৎ কুকুরের আওয়াজ উঠছে। শোনা গেল চিতার গন্ধ বা শব্দ পেলেই কুকুরের আওয়াজ বাড়ে।
ডিনার জমে গেল ডিম ভাতে। বহুরাত পর্যন্ত আড্ডার পর দুটো ঘরে ভাগ হয়ে শুয়ে পড়েছি সবাই কম্বলের নীচে। একটু তন্দ্রা মতো এসেছে কি আসেনি, সমস্বরে কুকুরের শব্দ। নড়বড়ে দেয়ালের ফাঁক ফোকর দিয়ে এসে পড়ছে সার্চ আলোর ঝলক। আর ফিসফিস মানুষের কথার স্বর ক্রমে জোরালো। ... কে যেন সুরজের নাম ধরে ডাকছে.. "বাহার আ যা সুরজ, বাহার আ.. বাহার সে আদমী আনা? দেখলুংগা..." ইত‍্যাদি। নীচে থেকে দীপক দৌড়ে উপরে উঠে এসেছে ততক্ষণে। ঠক ঠক করে কাঁপছে। সে আবার অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাসী। যারা এসেছে...মানুষ লয় দিদি। স্বরে ভয়।
আমরা ভয় পাচ্ছি তখন অন‍্য। হয় চিতা বাঘ, নয়তো আদিবাসী জনজাতির কোন আক্রোশ...ফেঁসে আটকে গেলাম না তো! এতদিন বন্ধ হোমস্টে খোলায় ক্রোধ হতে পারে...
এদিকে কাউকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। না আমাদের গাইডদের না সুরজ বা ওর ওয়াইফকে। ধরে নিলাম ট্র‍্যাপে পড়েছি। ফোনে ট্রাই করছি কোচবিহার, আলিপুর, জলপাইগুড়ির হাই অফিশিয়ালদের, অথবা বন্ধু বান্ধবদের। কাউকে পাচ্ছি না। মেসেজ করছি। সক্কলে উৎকন্ঠিত। ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে। খানিকক্ষণ পর প্রবল স্বস্তি নিয়ে এল সুরজের ফোন। ও দোতলায় এসে দরজায় নক করছে। আমরা ততক্ষণে সিদ্ধান্ত নিয়েছি কাল সকাল হতেই নীচে সান্ত্রাবাড়ি নেমে যাব। লেপচাখা যাওয়ার পরিকল্পনা আরো একটা রাত থাকা তখন মাথায় উঠেছে। যাইহোক, সুরজ জানাল - না না, সেরকম কিছু নয়, নিশ্চিন্তে বাকি রাত ঘুমোও। সকালে দেখা যাবে। ও সকলকে আশ্বস্ত করে নেমে গেল। বাকি রাত আর ঘুম হল না। দীপক ততক্ষণে আমাদের ঘরেই ঘুমিয়ে পড়েছে।
    সকাল সকাল বক্সা পাহাড়ের ঝলমলে রোদ অন‍্যরকম। কুন্ডলী পাকানো শান্ত কুকুরগুলোকে চেনা যায় না। এদিক ওদিক হোমস্টের সামনে গৃহপালিত ছাগল গরুর গলার ঘন্টি বাজছে। মুরগী মোরগের ঘুরে বেড়ানো ডেকে ওঠা।অদূরে মাঠ পেরোনো বক্সাফোর্টের ভাঙাচোরা তোরণ।চা পাট সেরে নীচে তৈরি হয়ে নেমে টুকরো এদিক ওদিকের কতগুলো হোমস্টে বা জনজাতির কাঠের বাড়ি দোকান পেরিয়ে মাঠ পেরিয়ে পৌঁছে গেছি ফোর্টের রহস‍্যময়তার কাছে। এই মায়াতেই কত মানুষ এসেছেন। আমরাও আচ্ছন্ন তখন। সাদা পাথরে ১৯৩২ সালে বন্দীদের রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনের নিদর্শন হয়ে রাজবন্দীদের বয়ান সহ ফলক দাঁড়িয়ে আছে।রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন প্রত‍্যভিনন্দন।সে লেখা অত‍্যন্ত জীর্ন অবস্থায় থাকলেও পড়তে পেরেছিলাম। 'নিশীথেরে লজ্জা দিল অন্ধকারে রবির বন্দন.'.. ইত‍্যাদি।
লাল ইটের ভাঙাচোরা প্রকোষ্ঠে নীরব হয়ে আছে ইতিহাস। কত যন্ত্রণা আর অত‍্যাচার কাহিনি। বড় বড় ছায়ায় মায়ায় ঘেরা দুর্গ প্রাকার তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিয়ে আজো দাঁড়িয়ে।
বহুদিন পর জগন্নাথ বিশ্বাসের কবিতার লাইন মনে পড়ে গেল
....."অবিরত বক্সাঝোরাতে
আরো জল বয়ে চলে।
পাহাড়ি বস্তিতে
সান্ত্রাগাছ মৃতপ্রায়
মহাকাল বটঝুরি অবাধে নামায়
পাথরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে
 দুর্গের প্রাকারে

ম্রিয়মান মানুষেরা 
বস্তিতে বস্তিতে 
আবার আঁধার এসে ঘন হয়।

সবাই একে অন‍্যকে ছুঁয়ে আছি বিরাট অশ্বত্থ গাছ ঝুরি নামিয়ে প্রাচীনতা নিয়ে দাঁড়িয়ে দুর্গ রহস‍্য যেন আরো বাড়িয়েছে।
সিদ্ধান্ত নিয়েই পাহাড়ের শরীর বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করলাম। যাব লেপচাখা। নাইটস্টে করব না।উদার অরণ‍্য পথ। কত নাম না জানা ফুল পথের পাশে। কে বলবে রাতে ঘুমোইনি আমরা! সেই স্বর্গের দেশে পৌঁছে মনে হল দেবতার উপত‍্যকা। বৃষ্টি ঝরছিল ফোঁটায় ফোঁটায়। ডুকপাদের হাতে তৈরি চাউ চাউ খেয়ে দ্রুত নামতে শুরু করেছি তখন। দীপক তার গাড়ির টানে খাওয়া দাওয়া সেরে সান্ত্রাবাড়ির দিকে নামতে শুরু করেছে ততক্ষণে। আমরা সাতজনের দল সেই রাতের চেনা অমসৃণ পাহাড়ি শরীরে পা রেখে নামছি। পিছন ফিরে ঐ আমাদেল রাতের ভয়ঙ্কর নড়বড়ে কাঠের বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আর মানুষজনের চোখগুলোর দিকে চোখ পড়তেই বুকের ভিতর ছলাৎ করে ওঠে। রাতের চাঁদ জ‍্যোৎস্না কি আবার ডেকে নেবে! কে জানে।...নামছি আর নামছি জঙ্গলঘেরা পাহাড়ি পথে এবার নি:শঙ্কায়।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri