পাহাড়ের 'বোস' বাড়ি/শঙ্খনাদ আচার্য
পাহাড়ের 'বোস' বাড়ি
শঙ্খনাদ আচার্য
গিদ্দা পাহাড় - এই পাহাড়ের নাম কি আপনি শুনেছেন ? কার্শিয়াংয়ের কাছে ছোট্ট একটি জনপদ যেখানে জড়িয়ে আছে বিশ্বের মহান বিপ্লবী নেতার ইতিহাস। সেই বিপ্লবী নেতা আর কেউ নন তিনি আমাদের সকলের প্রিয় নেতাজি এবং তাঁরই স্মৃতিবিজড়িত এই গিদ্দাপাহাড়। এখানেই ছিল তাঁদের একটি পারিবারিক বাড়ি। বছরে নিয়ম করে অন্তত দু'বার, গ্রীষ্মাবকাশে ও পূজাবকাশে এখানে ছুটি কাটাতে আসতেন বসু পরিবারের সদস্যরা। আর বসু পরিবারের সদস্য হিসেবে নেতাজিও বেশ কয়েকবার এসেছিলেন গিদ্ধা পাহাড়ের এই বাড়িতে।
সালটা ছিল ১৯২২। নেতাজির দাদা বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী শরৎচন্দ্র বসু কার্শিয়াংয়ের গিদ্দা পাহাড়ের এই বাড়িটি কিনেছিলেন সমসাময়িক অসমের ডেপুটি পুলিশ সুপার রাউলি লেসলি ওয়ার্ড-এর কাছ থেকে। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বাড়িটি বসু পরিবারের অধীনেই ছিল। এরপর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে বাড়িটি সংস্কার করা হয় এবং তা তুলে দেওয়া হয় 'Netaji institute for Asian Studies' কলকাতা কর্তৃপক্ষের হাতে। পরবর্তীকালে ২০০০ সালের ২৩ এপ্রিল, এই ঐতিহ্যশালী বাড়িটিকে 'Netaji Museum and Centre for Studies in Himalayan Languages, Society and Culture' রূপান্তরিত করে উদ্বোধন করা হয়।
গিদ্দাপাহাড়ের তেনজিং নোরগে রোডে অবস্থিত এই বাড়িটির পরতে-পরতে লেগে রয়েছে 'দেশনায়ক'-এর স্মৃতি। ব্রিটিশ স্থাপত্যে তৈরি ওই বাড়িতে রয়েছে বড় বড় পাল্লা দেওয়া জানলা। তিনকোনা আর্চের ভঙ্গিতে টিনের চাল। সদর দরজা দিয়ে ঢুকে বারান্দা, পাশেই গোলাকৃতি বৈঠকখানা। নেতাজির স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়িটিতে সংরক্ষিত রয়েছে মূল্যবান কিছু ঐতিহাসিক চিঠি। এছাড়া নেতাজির অনেক দুষ্প্রাপ্য ছবিও শোভা পায় বাড়িটির অন্দরমহলে। বসু পরিবারের সঙ্গে নেতাজির ছবি যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে জওহরলাল নেহরু, সর্দার বল্লভভাই পটেলের সঙ্গে তোলা ছবিও। পাগলাঝোরাতে পাহাড়ি ঝর্নার ধারে নেতাজির প্রাতঃভ্রমণের ছবিও আছে এখানে। এছাড়াও বসু পরিবারের সঙ্গে নেতাজির তোলা অনেক ছবিও আছে। এর বাইরে নেতাজির ব্যবহার করা খাট, ড্রেসিং টেবিল, লেখাপড়ার টেবিল, চেয়ার সবই সযত্নে রাখা আছে বাড়িটিতে। নেতাজির দাদা শরৎচন্দ্র বসু ১৯৩৪ সালে বাড়িটির আঙিনায় একটি ক্যামেলিয়া গাছ লাগিয়েছিলেন । আজও তা রয়ে গিয়েছে। ১৯৫৪ সালে শেষবারের মতো বসু পরিবারের সদস্যরা এই বাড়িটিতে ছুটি কাটাতে এসেছিলেন।
ইতিহাস বলে ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৫, এই বাড়িতেই ব্রিটিশ সরকার গৃহবন্দি করে রেখেছিল শরৎচন্দ্র বসুকে। এরপর আসে নেতাজির পালা। ১৯৩৬ সালের জুন থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত নেতাজি এই বাড়িতেই অন্তরীন ছিলেন। পরে মুক্ত অবস্থাতেও এই বাড়িতে এসেছিলেন। এই বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি রাখলেও নেতাজীকে দমিয়ে রাখতে পারেনি ইংরেজরা। এই বাড়ি থেকেই নেতাজির নির্দেশে একের পর এক চিঠি পৌঁছে যেত কলকাতায় স্বাধীনতা সংগামীদের কাছে কিম্বা অন্যত্র। গিদ্দা পাহাড়ে নজরবন্দি থাকাকালীন মোট ২৬ টি চিঠি লিখেছিলেন নেতাজি ৷ এর মধ্যে ১১ টির প্রাপক ছিলেন এমিলি শেঙ্কেল ৷ অন্যদিকে, এমিলির তরফ থেকেও নেতাজির জন্য ১০ টি চিঠি এসে পৌঁছেছিল গিদ্দা পাহাড়ের এই ‘বন্দিশালা’য় ৷ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্য়ায় রচিত 'বন্দেমাতরমের' শব্দচয়ন নিয়ে একবার একটা বিতর্ক তৈরি হয়েছিল ৷ শোনা যায়, সেই বিষয়টি নিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং জওহরলাল নেহরুকে চিঠি লিখেছিলেন নেতাজি ৷ সেই চিঠিও তিনি লিখেছিলেন এই বাড়িতে বসেই ৷পাহাড়ের বাসিন্দাদের সমস্যা নিয়ে নেতাজি যে আন্তরিক ছিলেন সেটাও ফুটে উঠেছে তাঁর আর একটি চিঠিতে। এছাড়া, হরিপুরা কংগ্রেসে নেতাজি যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তার খসড়াও নেতাজি প্রস্তুত করেছিলেন এখানেই ৷ প্রসঙ্গত, জাতীয় কংগ্রেসের হরিপুরা অধিবেশনটি হয়েছিল ১৯৩৮ সালে ৷ সুভাষচন্দ্রের সভাপতিত্বেই সেই অধিবেশন হয়েছিল ৷ তবে শুধুমাত্র নেতাজি নন, গিদ্দা পাহাড়ের এই ঐতিহাসিক বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন আরও এক কিংবদন্তী ৷ তিনি 'দেশবন্ধু' চিত্তরঞ্জন দাশ ৷ মৃত্যুর মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে শরৎচন্দ্র বসুর সঙ্গে তাঁর বাড়িতে থেকে গিয়েছিলেন দেশবন্ধু ৷ সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী বাসন্তী দেবী ৷ সেইসব স্মৃতি আজও যতটা সম্ভব সংরক্ষিত করে রাখা হয়েছে নেতাজির পাদস্পর্শে ধন্য পাহাড়ের কোলে থাকা এই বাড়িটিতে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴