পাহাড়ে একটি অপূর্ব সকাল/টিপ্ লু বসু
পাহাড়ে একটি অপূর্ব সকাল
টিপ্ লু বসু
----------------------------------
আমাকে ছ-দিনের কোলে নিয়ে শিলিগুড়ি হাসপাতাল থেকে মা তিনধারিয়ায় রেলকোয়ার্টারে চলে এলো। সেখানে তিনমাস আমি দিদা দাদামশাই এর আদরে কাটিয়েছি। দাদামশাই তখন তিনধারিয়ার রেলস্টেশনে কর্মরত। মায়ের ছোটবেলা কেটেছে কার্শিয়াঙ এ , বাবার দার্জিলিং এ। আমার ঠাকুর্দা ছিলেন দার্জিলিং জেলাস্কুলের হেডমাস্টার। এসব কথা বলার একটাই কারণ, ছয়দিন বয়স থেকে আমার পাহাড়-ভ্রমণ শুরু এবং তা আজো চলছে। তবে নির্মম সত্য এই যে এখন আমার দার্জিলিং একদম ভালো লাগেনা। উঁচুনিচু বড়োবাজার (কোলকাতা) মনে হয়। তাই আশেপাশে থেকে একবেলা একটু ছুঁয়ে আসি। ছোটবেলার নিষ্পাপ কুয়াশায় ঢাকা পরিচ্ছন্ন শৈলশহরটাকে একেবারেই হারিয়ে ফেলেছি। আমার বন্ধু চন্দনা সাংবাদিক। ও প্রায়ই দার্জিলিং যায় নানা কাজে। প্রতিবারই আমাকে সাধ্যসাধনা করে। আমি যাইনা। কারণ ওর সঙ্গে গেলে দার্জিলিং এই থাকতে হবে। কিন্তু সেবার নতুন রাজ্যপালের ডাকে দার্জিলিং রাজভবনে ওর একটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার ছিলো। আমিও কেন যেন 'না' বলতে পারিনি। I.B তে আমার এক বন্ধু আছে, সে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলো। মায়ের পিঠে চেপে, ছোটমামার হাত ধরে হেঁটে হেঁটে, বন্ধুদের সঙ্গে পাহাড়ের পথে পথে অনেক ঘুরেছি, কিন্তু আমি কখনো টাইগার হিল যাইনি। কি করে যাবো, ভোরে উঠতে পারিনা যে। একদিন, অফিসের অনেকে মর্নিংওয়াক করে দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমিও সক্কালবেলা হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। অফিসের অনেকের সঙ্গে দেখাও হোলো। তারপর অফিসে গিয়ে ওরা দেখে আমি অনুপস্থিত। সবাই চিন্তিত। কি ব্যাপার? সকালেই সুস্থ দেখলাম। এরমধ্যে আবার কি হোলো? এদিকে আমি মর্নিং ওয়াক থেকে ফিরে সেই যে ঘুমিয়েছি, বেলা বারোটায় সে ঘুম ভেঙেছে। অফিসে আর যাবো কি করে! পরে অনেক হাসাহাসি হয়েছে এ নিয়ে। আমিও আর ভোরে ওঠার চেষ্টা করিনি। কিন্তু চন্দনা টাইগার হিল থেকে সূর্য ওঠা দেখার মজা নেবেই। আমাকেও তাতে সামিল করবেই । সেদিন সারাদিন কাজকর্ম সেরে ক্যাভেন্টার্স ম্যাল গ্লেনারিজ হয়ে বেশ রাতে guest house এ ফিরলাম। পাহাড়ে গেলে আমি একটু ও ক্লান্ত হইনা। আমরা গল্প করতে শুরু করি। পাহাড়ে রাত বাড়ে।
শুয়ে পড়ার কোনো উদ্যোগ নেয়না চন্দনা। তারপর ওর উদ্দেশ্য বুঝতে পারলাম। আমি ভোরে উঠতে পারিনা বলে ও সারারাত আমাকে জাগিয়ে রাখবে। ভোর চারটায় বের হওয়ার মতো জামাকাপড় গায়ে চাপিয়ে বসে আড্ডা দিতে থাকলাম। সাড়ে তিনটেয় গাড়ি বলা ছিলো। আড্ডা দিতে দিতে কখন সাড়ে তিনটে বেজে গিয়েছে বুঝতে পারিনি। গাড়ির হর্ণের শব্দে টের পেলাম। আমরা তখন guest house এর রান্নাঘরে নিজেরাই লাল চা বানিয়ে পান করছিলাম। গাড়ি আসতেই বেরিয়ে পড়লাম। রাতের অন্ধকার পাহাড় দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম।এখন পাহাড় পুরো অন্ধকার। কোথাও কোনো ঘর থেকে আলোর তারাবিন্দু দেখা যাচ্ছে না। রাতজাগা আমার এতক্ষণ কোনো অসুবিধে হয়নি। যতো ভোরের দিকে যাত্রা করছি ততই আমার mood off হচ্ছে। আরো অনেক গাড়ি যাচ্ছে একই পথে একই উদ্দেশ্যে।। আমি চন্দনাকে উল্টোপাল্টা বলে বকাবকি করছি, নিকুচি করেছে সূর্যোদয়ের। ভীড়ে দাঁড়ানোর জায়গা পাবে না। তখন বুঝবে ইত্যাদি। ও কিছু বলছেনা। মিটিমিটি হাসছে। ও যে আমাকে ভোরবেলা বের করতে পেরেছে এতেই যেন বিশ্বজয় করে ফেলেছে, এমন হাবভাব। হঠাৎ গাড়ি থেমে গেলো। বাকিটা হাঁটতে হবে। এই অন্ধকারমাখা ভোরে আমি কিছুতেই হাঁটবোনা। বললাম আমি গাড়িতে ঘুমোচ্ছি।
তুমি দেখে এসো। ও-ও আমাকে ছেড়ে যাবেনা। অনেক টানাটানির পর গাড়ি থেকে নেমে রওনা দিলাম। অনেকটা হেঁটে একটা চত্বরে পৌঁছলাম। সেখানে একটা বিরাট কংক্রিটের structure , তার বারগুলোর ওপরে অনেক মানুষ বসে আছে। ঐরকম সুন্দর পরিবেশে সবটাই চরম বেমানান। তারপর যখন শুনলাম ওটা হোটেল হবে তখন মেজাজ আরেক পর্দা চড়ে গেলো। কাঞ্চনজঙ্ঘা, সূর্যোদয় পণ্য হয়েছে অনেকদিন, কিন্তু এ হেন রুচিবিকৃতি সকাল সকাল ধাক্কা দিলো। বিরস মুখে সামনের কাঁটাঝোপ সরিয়ে কয়েকজনের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কোনোকিছুই আমার মনের মতো ছিলো না। হঠাৎ সমস্বরে 'উঠছে উঠছে' শুনে পুবদিকে তাকালাম। দুই পাহাড়ের খাঁজে একটা বেগনে আলোর রেখা ফুটে উঠলো। আস্তে আস্তে রঙটা উজ্জ্বল হতে হতে ওপরের আলোর রঙ কালচে কমলা থেকে উজ্জ্বল কমলা। ভেতরে আলোর ছোট্ট বিন্দু। বিন্দুটি ক্রমশ বড়ো হচ্ছে। হঠাৎ পশ্চিমে চোখ পড়লো। সূর্যোদয়ের আলো মেখে রঙ বদলাচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। চোখ ফেরানো যাচ্ছেনা সেই অপরূপ দৃশ্য থেকে! তারপরের পুরো সময়টা মন্ত্রবৎ চেয়ে রইলাম বর্ণছটাময় কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে। ধীরে ধীরে বর্ণালীর সব রঙ মেখে তুষার -শুভ্র হয়ে উঠলো অপূর্ব শৃঙ্গশ্রেণী। 'জয় সূর্যদেব' শুনে আবার পুবমুখো হলাম। তিনি তখন ঘুম ভাঙার সমস্ত পর্যায়শেষে হাসিমুখে আকাশে জাজ্জ্বল্যমান। আমি বুঝলাম পাহাড়ের প্রেমে পড়ে জীবনের প্রথম সূর্যোদয় দর্শন হোলো না আমার। চন্দনার এত প্রচেষ্টা কাজে এলো না। কিন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপদর্শনে আমার রাতজাগা ভোরজাগার সব ক্লান্তি সব বিরক্তি ধুয়েমুছে এক নতুন ভোরে উপনীত করলো আমাকে। নবকুমারের মতো বলতে ইচ্ছে হোলো, 'যা দেখিলাম জন্ম-জন্মান্তরেও ভুলিবনা '! ফিরে আসার পর অনেকেই ঐ দৃশ্যের চলচ্ছবি দেখতে চেয়েছে। কিন্তু চোখের আলো ও মনক্যামেরা ছাড়া তখন আর কিছু ইস্তেমাল করার কথা বেমালুম বিস্মৃত হয়েছিলাম।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴