পার্বতী/চিত্রা পাল
পার্বতী
চিত্রা পাল
সব পুজো উৎসব শেষ। সবে শীত পড়তে শুরু হয়েছে, অথচ জাঁকিয়ে পড়েনি। এসময় একখানা চাদর গায়ে দিয়ে বা হালকা গরম জামা পরে এককাপ চা নিয়ে বসলে জোর আড্ডা জমে যায়। সেরকমই আড্ডা চলছে আজ। আড্ডার বিষয়বস্তু হাড় হিম করা ভূতের কথা। ক্লাবের কেয়ারটেকার ধীরেনকে চা করার কথা বলে সবাই সেই ভূত নিয়েই পড়েছে। একজন বলল, রাজস্থানে ভানগড়ফোর্ট নামে একখানা ফোর্ট আছে যেটা একেবারে ভূতের বাড়ি বলেই বিখ্যাত। সঙ্গে সঙ্গে পাড়ার ভানুদা বললেন, ওসব রাজস্থান ফাজস্থান ছাড়ো, বেশীদূরে নয়, এই শিলিগুড়ি পেরিয়ে কার্শিয়াং যাও না, সেখানে ডাওহিল ভিক্টোরিয়া ইন্সটি্টুউশন আছে, নামকরা স্কুল, ঐ জায়গাটা আবার নাকি ভূতের রাজ্যি। শুনেছি সেখানে রাত্তির বেলায় রাস্তায় মাথাকাটা একটা নেপালি ছেলে ঘুরে বেড়ায়। ভানুদার কথা শেষ হয়েছে কি হয়নি, ধীরেন গরম চাএর কেটলি আর কাগজের চাপ নিয়ে ঢুকল, আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এলেন সৌরিনদা, চাদরে একেবারে মাথামুখ ঢেকে। ওনাকে অমনভাবে আচমকা ঢুকতে দেখে দুএকজন আবার ভয়ও পেয়ে গেল। বোধহয় ভূতের গল্প শুনছিল বলে। বিকাশদা ওনার সিনিয়র, উনি বললেন, কি সৌরিন বাইরে এত ঠান্ডা পড়েছে? তুমি একেবারে মাথামুখ ঢেকে ভূতের মতো এলে? উত্তরে বললেন, তোমরা সবাই ঘরে আছ তো তাই বোঝোনি, বাইরে বেশ ঠান্ডা। আর আমার বয়স হয়েছে, তাই একটু সাবধানেও থাকি। বলে বেশ আরাম করে বসে ধীরেনের হাত থেকে চাএর কাপ নিয়ে একটা চুমুক দিয়ে বললেন, তা তোমাদের কি গল্প হচ্ছিল?রঞ্জু বলে ভুতের। তাই নাকি? তা তোমরা কি কেউ ভূত দেখেছ? অনেকেই বলল না বাবা। ভানু বলে ভূতের গল্প শুনেই সবাই চমকাচ্ছে, ভূত দেখলে তো আর কথাই নেই।
আমি একটা গল্প বলতে পারি। সকলেরই এখন শোনার মতো মন। সবাই বলে উঠল - হ্যাঁ বলো বলো। তখন সৌরিনদা শুরু করলেন। এখন সৌরিনদারগল্প।
সৌরিন একেবারেই উত্তরবঙ্গের মানুষ, স্কুলের পড়াশোনা এখানেই। কলেজ জীবন কেটেছে, কোলকাতার কাছে মামার বাড়িতে, তারপরে সরকারি চাকরির প্রথমদিকটাও ওদিকে। মা বাবা না থাকায় মামারাই বিয়ে দেন, ওনার শ্বশুরবাড়ি আবার সেই দক্ষিণে, জয়নগরে। তখনকার জয়নগর-মজিলপুর এক বর্ধিষ্ণু অঞ্চল। সেরকম এক বর্ধিষ্ণু পরিবারেই ওনার বিয়ে হয়। বিয়ের পরে স্ত্রী সতীকে নিয়ে প্রথমে কোলকাতার দিকেই থাকেন, পরে উত্তরবঙ্গে ট্রানস্ফার হয়ে চলে আসেন নিজের বাড়িতে। নিজের বাড়িতে বাস করার মতো আনন্দ আর আছে? যা হোক, আসার পরে যেবার জয়নগর যান্, সেসময় সতী দেবী ওনার ছোটবেলায় মেলায় কেনা শিবঠাকুরের মূর্তিখানিও সঙ্গে আনেন। মূর্তিখানি দেবাদিদেব শিবের ত্রিশূলধারি মূর্তি। সেটি এখানে শোবার ঘরের দেওয়ালে একখানা ছোট র্যাকে রেখে দেন।
সতীর ছোটবোন পার্বতী যেবার প্রথম দিদির বাড়িতে এলো, সেবার শোবার ঘরে শিবের মূর্তিখানা দেখে বলে, বারে, তুই এটাকেও নিয়ে এসেছিস্? আমি এবার যাবার সময়ে নিয়ে যাবো কিন্তু।মনে আছে তোর,সেবার কালিবাড়ির বেশের মেলায় এটা কিনেছিলুম দুজনে। সতী বলে, হ্যাঁ, খুব মনে আছে।তবে ও এখানেই থাক্, ঠিক ঠিকানায়। তোর আবার কবে বিয়ে হয়ে যাবে, কোথায় তোর শ্বশুরবাড়ি হবে তুই চলে যাবি, আমি ওকে নিয়ে এসেছি, থাকবার রাখবার জায়গাও করে নিয়েছি, ও এখানে থাকবে।তুই আর বায়না করিস্নি। তো সেবারে ও নিয়ে যায়নি। পরে যতবার এসেছে, দিদিকে বলেছে, দিদি দিতে রাজী হয়নি, দেয়ও নি।
পার্বতীর বিয়ে হয় বিহারের কাটিহার। ওর শ্বশুর বাড়ি খুব শিবভক্ত। ওরা প্রায়ই যায় দেওঘরে বাবার পুজো দিতে। বেশ ভালই চলছিলো। ও নিজেও বিহারের পরিবেশে মানিয়েও নিয়েছিলো।ওর স্বামী বিশ্বনাথও ছেলে ভালো। কিন্তু কপাল মন্দ, বিয়ের তিনবছরের মাথায় এক স্কুটার এক্সিডেন্টে মৃত্যু হয় বিশ্বনাথের। ওখনও ওর বাবা বেঁচে। উনি পার্বতীকে নিজে গিয়ে ওখান থেকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে আসেন। সেই থেকে পার্বতী বাবার কাছেই থেকে যায়।
এর পরে সতী যখন বাপের বাড়ি যায়, তখন কি জানি কি মনে হয়েছে, ওই শিবমূর্তিখানি নিয়ে যায় আর বোনকে দিয়ে আসে। বলে তখন তুই এতো করে চেয়েছিলি, এখন তুই একে তোর কাছেই রাখ। বলে সতী ওকে দিয়ে দেয়। পার্বতীও নিয়ে যত্ন করে রেখে দেয়।
এরপরে কেটে গেছে বেশ অনেকগুলো বছর। সৌরিন তার সংসার সার্ভিস নিয়ে ব্যস্ত। ছেলেমেয়েরা স্কুল পেরিয়ে কলেজে। এর মধ্যে শ্বশুর মশাই চলে গেলেন যেবার সেবারের পরে আর বিশেষ যাওয়া আসা নেই। হঠাৎ্ ব্রেন স্ট্রোকে সতীর মৃত্যু হলে শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক প্রায় ক্ষীণ হয়ে আসে। এর মধ্যে ছেলের জন্য একবার জয়নগর যেতে হয়। জয়নগর আর লক্ষ্মীকান্তপুরের মাঝখানে এক গ্রামের বাড়িতে নাকি রোজ মাঝ রাত্তিরে এক অশরীরীকে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়, সেই ব্যাপারটাকে ও চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করতে চায়। ও আবার নিজের কাজের পাশাপাশি এসব আধিভৌতিক ব্যাপারস্যাপার নিয়ে একটু আধটু চর্চা করে।
অনেক বছর পরে আবার শ্বশুরবাড়িতে এলেন সৌরিন, সঙ্গে ছেলে। ছেলেই বলল - বাবা চলো, তোমার চেনা জায়গা আবার একবার দেখে আসবে। রিটায়ারমেন্টের পরে এখন ওনার অবসরের কাল। তাই ছেলের কথাতে রাজী হয়ে গেলেন। ছেলে অবশ্যই ছোটমামাকে ফোনে জানিয়ে দিয়েছিল ওদের আগমনবার্তা।
আগে যে ঘরে থাকতেন সেই ঘরেই ওনার থাকার ব্যবস্থা। ঘরের কুলুঙ্গীতে রয়েছে সেই শিবঠাকুরের মুর্তি। তবে মুর্তিটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, যত্ন করে মোছা। ঘরের জানালা খুললেই দেখাযায় শান বাঁধানো পুকুরঘাট, সেই পুকুরের চারপাশ জুড়ে আম কাঁঠাল শবেদা এসব নানারকম ফলের গাছ। আবার একদিকে কতগুলো নারকেলগাছ, সুপুরিগাছ। ওনার যখন বিয়ে হয়েছিল তখন ইলেকক্ট্রিসিটি ছিল না, গরমকালে ষষ্ঠী মানে জামাইষষ্ঠীতে এসে সন্ধ্যা বেলায় ওই ঘাটের সিঁড়িতে বসেছেন সতীর সঙ্গে। সেসব যেন ছবির মতো উঠে এলো মনের এয়ালবাম থেকে। সন্ধে হয়ে এসেছে। কিন্তু লোডশেডিং। এখানে আবার লোডশেডিং দীর্ঘক্ষণ চলে। তাই একজন এসে ঘরে একটা বড় মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে গেল।
উনি ঘর সংলগ্ন বারান্দায় পায়চারি করছিলেন।তারপরে কি মনে হতে ঘরে ঢুকলেন। আগামীকাল সকালেই চলে যাবেন। ওনার মনে হয়েছে, মূর্তিটা এবারে এদের বলে উনি নিয়ে যাবেন সতীর স্মৃতি হিসেবে। তাই ওটাকে নিজের সুটকেশের ওপরেই রেখেছেন। মোমবাতির কাঁপা কাঁপা আবছা আলোয় ঘরে ঢুকেই দেখেন কে একজন মূর্তিটাকে সুটকেশের ওপর থেকে নিয়ে মুছে আবার আগের জায়গায় সাজিয়ে রাখছে। প্রথমে উনি বুঝতে পারেননি। কিন্তু মূর্তিটা হাতে নিয়ে সে যেই সামনে ফিরে ওনার দিকে তাকিয়েছে, উনি তাকে দেখে একেবারে অজ্ঞান হয়ে সেখানেই পড়ে গেলেন। জ্ঞান আসতে সবাই জিজ্ঞেস করছে, কি হয়েছে? উনি ভয় তরাসে হয়ে কেবল বলে চলেন, পার্বতী পার্বতী। ছোটমামা বললেন, সে তো নেই।
কারণ বছর পাঁচেক আগে এক ঝড়ের রাতে নারকেল কুড়তে গিয়ে মাথায় ওপর থেকে খসে পড়া নারকেলে ঘায়ে পার্বতী জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যায়, তারওপরে নারকেলের গাছটাই ভেঙ্গে ওর ওপরে পড়ে, সেই আঘাতে পার্বতী মারা যায়। আজ সেই পার্বতীকে আবার জলজ্যান্ত মূর্তি নিতে দেখে জ্ঞান হারাতেই পারেন, সে আর বেশি কথা কি।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴