পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় -এর আলোচনায় দেবপ্রসাদ রায় -এর বই 'ডুয়ার্স থেকে দিল্লি'
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় -এর আলোচনায় দেবপ্রসাদ রায় -এর বই 'ডুয়ার্স থেকে দিল্লি'
একটা জীবন সংগ্রাম মিশ্রিত আত্মজীবনী যখন সাহিত্য হয়ে ধরা দেয়, লেখক সরাসরি তখন পাঠকের মনকে স্পর্শ করতে সক্ষম হন। দেবপ্রসাদ রায়ের লেখা "ডুয়ার্স থেকে দিল্লি" গ্রন্থটি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
বিভিন্ন সমসাময়িক পত্র-পত্রিকা, আনন্দবাজার পত্রিকা, উত্তর বঙ্গ সংবাদ, আজকাল, বর্তমান প্রভৃতি দৈনিক সংবাদ পত্রে দেশ কাল, সময়, সমাজ এবং অবশ্যই উন্নয়ন নিয়ে আমরা দেবপ্রসাদ রায়ের প্রবন্ধ পড়েছি। কিন্তু বিগত ২০১৮ সালে এখন ডুয়ার্স প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয় "ডুয়ার্স থেকে দিল্লি"।
এই গ্রন্থের প্রকাশে প্রাবন্ধিক দেবপ্রসাদকে পাঠক লেখক দেবপ্রসাদ হিসেবে দেখতে পায়। একটা নিটোল সহজ সরলভাবে গল্প বলার মতো এই আত্মজৈবনীক গ্রন্থটি লেখক দেবপ্রসাদ রায় ৩৭ টি পর্বে তার যাপনচিত্র খুব নিখুঁত এবং সুন্দরভাবে তুলে এনেছেন। জীবনের কঠিন বাস্তবের ছবি আঁকতে গিয়ে কখনোই সত্যিকে অস্বীকার করেননি। একটা আত্মজীবনী যে এতটা সাহিত্য রস সমৃদ্ধ হতে পারে, "ডুয়ার্স থেকে দিল্লি" বইটি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কয়েকটি বইমেলায় প্রথম প্রকাশিত বইগুলো নিমেষে উধাও হয়ে যাওয়ার পর দ্বিতীয় ও পরিবর্ধিত সংস্করণ এখন প্রায় নি:শেষিত। কলেজ পাড়ায় সব দোকানগুলোতে বেস্টসেলার তকমা পাওয়ার পিছনে প্রথম এবং প্রধান কারণ লেখকের সারল্য। তাঁর শৈশবের ডুয়ার্সের চা-বাগান, বনবস্তি, অরণ্য পাহাড়ের চালচিত্র আজ এতটুকু বদলায়নি। কিন্তু মানুষ ও তার যাপন কাহিনি অনেকটাই বদলে গিয়েছে। আর সেই সব দিনগুলোতে তাঁর পরিচিত মানুষের যে আচার ব্যবহার এবং যাপন চিত্র ধরা পড়েছে তা পাঠকের মনকে টেনে নিয়ে যায় এক পর্ব থেকে অন্য পর্বে। পাঠক অতি সহজে লেখক দেবপ্রসাদকে তাঁদের অন্তর্দৃষ্টিতে দেখতে পায়। লেখকের জীবন দর্শনের মধ্যে কোথাও পাঠক নিজেকেও দেখতে পায়। প্রতিটি পর্বের কাহিনির মধ্যে ফুটে উঠেছে অসাধারণ হাস্যরসের মাধুর্য। একটা পর্ব থেকে অন্য পর্বে পাঠককে টেনে নিয়ে গিয়েছেন তিস্তাবঙ্গের ভূমিপুত্র ভারত পরিব্রাজক দেবপ্রসাদ রায় ওরফে মিঠু।
তিনি একজন রাষ্টবিজ্ঞানের ছাত্র। কিন্তু এখানে তাঁর বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী এক অদ্ভুত বিষয় রচনা করেছে যা কেবলমাত্র রাজনৈতিক জীবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। জীবনের পাওয়া না পাওয়ার যে অদৃশ্য সংঘাত তাকে সঞ্চয়ে নিয়ে চলার পথে এগিয়ে গিয়েছেন। মানবসেবাকে ব্রত করে তিনি জীবন সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছেন। এইজন্য মানুষ তাঁকে দুই হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেছেন। তিনি পরিশ্রমী এবং সৎ একথা প্রমাণিত সত্য। সদা সর্বদা উন্নয়ন ভাবনা উত্তরের জনপদকে উন্নয়নে গতি দিয়েছে। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর বিশদফা কর্মসূচি রূপায়ণের জন্য প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর নির্দেশে জাতীয় কংগ্রেসের কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। দেশ জুড়ে কর্মীদের ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের আদর্শ, দলের ইতিহাস এবং সেবার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করতে সহায়তা করেছেন।
প্রথমবার রাজ্যসভার সাংসদ মনোনীত হলেও, দুই দুই বার অবিভক্ত জলপাইগুড়ি জেলার প্রান্তিক দুই কেন্দ্র থেকে বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছেন। মানুষের সুখে দু:খে নিবিড় ভাবে পাশে থাকার জন্যই তিনি সেই সব জয়কে নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছেন। একজন জনপ্রতিনিধির জীবনের প্রথম এবং শেষ কথা মানুষ। তাঁর লেখায় মানুষই হয়ে উঠেছে একমাত্র উপাদান। তাঁর জীবনের ছোট ছোট ঘটনাগুলোর বর্ণনার মধ্যে দিয়ে তুলে ধরেছেন সফলতার কাহিনি, সেই বিষয়টি সত্যিই প্রশংসনীয়।
কোচবিহারের নৃপেন্দ্রনারায়ন স্কুলের নলিনী স্যার তাঁকে উপেক্ষা, অবহেলা করে বলেছিলেন,
"মিঠু যদি পাশ করে, আমি হাতে চুড়ি পরে ঘুরে বেড়াব।"
নলিনী স্যারের এহেন মন্তব্য লেখক দেবপ্রসাদ রায়কে আরও বেশি অধ্যাবসায়ের পথে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।
মনের জেদ যে সাফল্যের পথে উত্তরণ ঘটায় এটা দেখলাম তার নবম শ্রেণির ষাণ্মাসিক পরীক্ষার ফলাফলের পর ক্লাসে খাতা দেখানোর দিন দীপেন স্যারের উক্তিতে উঠে এসেছিল সম্পূর্ণ বিপরীত মন্তব্য যা পাঠকের মনকে নাড়িয়ে দেবে।
দীপেন স্যার বলেছিলেন, "মিঠু খুবই ভালো লেখে। আমরাই মিঠুর লেখা বুঝে উঠতে পারি না।"
দীপেন স্যারের এই উক্তি লেখককে জীবনভর উৎসাহ যুগিয়েছে একথা বলবার অপেক্ষা রাখে না।
কর্মক্ষেত্রে পিতার বদলীর কারণে তিনি জলপাইগুড়িতে আসেন এবং সোনাউল্লা বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। খুব বেশি দিন তিনি সোনাউল্লা বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেননি একথা সত্য কিন্তু তাঁর উদ্যোগে শহীদ স্মৃতিরক্ষা কমিটির পক্ষ থেকে মুন্সি মহম্মদ সোনাউল্লার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সোনাউল্লা বিদ্যালয়ের শতবর্ষে বিষয়টিতে সেভাবে আলোকপাত করা হল না, এটা আক্ষেপের বিষয়।
তিনি লিখেছেন হার জিৎ তো জীবনের অঙ্গ। না মানলে জনজীবনে থাকা যায় না"
কিন্তু তাঁর রাজ্যসভার পরাজয় রাজনৈতিক মহলকে বিস্মিত করেছে।
তাঁর কথায়, "সোনিয়াজী ডাকলেন। শুনলেন কি হয়েছে। আমি ঠিকই করে ফেললাম আর ওনাকে বিরক্ত করব না। নজরুলের একটা কবিতা মনে পড়ছিল,
"তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু
আর আমি জাগিব না
কোলাহল করি সারা দিনমান
কারো ধ্যান ভাঙিব না।
নিশ্চল নিশ্চুপ
আমি আপনার মনে পুড়িব একাকী
গন্ধ বিধুর ধুপ"।
একজন অভিমানী মানুষের এই নজরুল স্মরণ পাঠককে আরও বেশি স্পর্শ করে। এখানে তাঁর ভাবনা সব চাওয়া পাওয়ার উর্ধ্বে এক selflessness চরিত্র পাঠকের মনে ধরা পড়ে। আত্মজীবনী ডুয়ার্সের মাটিকে ধন্য করে এবং হিমালয়সম উচ্চতায় পৌঁছতে সক্ষম হন।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴