পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর আলোচনায় শুক্লা রায়-এর বই 'মেয়েটি ও অদৃশ্য জোছনা গাছ'
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর আলোচনায় শুক্লা রায়-এর বই 'মেয়েটি ও অদৃশ্য জোছনা গাছ'
"জল নেমে গেলে জেগে থাকে রাত্রির বিষাদ", "সে জগত থেকে শহর অনেক দূরে", "সন্ধ্যা নামতেই বিকেল উধাও, উড়ে যায় " "আরও শক্ত হয়ে মাটি জমাট বাঁধে" এই লাইন গুলো রাত্রির বিষাদ, অলীক জগৎ, আকাশ নিভে গেলে, অন্ধকারের নৌকো .. কবিতাগুলোকে সম্মৃদ্ধ করেছে। কবি শুক্লা রায়ের "মেয়েটি ও অদৃশ্য জোছনা গাছ" কাব্যগ্রন্থে চল্লিশটি কবিতা পড়ে আমার মনে হয়েছে কবি নিজে ইতিহাসের শিক্ষক হলেও ভালো একজন কবিতার শিক্ষক হতে পারতেন। শিক্ষক যেমন একজন ছাত্রের হৃদয়কে আলোকিত করেন, কবি শুক্লা রায় তার কবিতার মধ্যে দিয়ে পাঠকের হৃদয়কে আলোকিত করবার চেষ্টা করেছেন। হৃদয়ই একজন মানুষের মন্দির, সেই মন্দিরে যা কিছু উপকরণ প্রয়োজন কবি তার কবিতার স্নিগ্ধ শব্দচয়নে, একটা একটা কবিতা নির্মাণ করে সেই সব উপকরণ থরে থরে সাজিয়ে তুলেছেন। কবির সাথে দার্শনিকের মতাদর্শগত বিরোধ থাকতেই পারে কিন্তু আর্টের ওপর নিজের ঠিকানা পাঠক খুঁজে পায় প্রকৃতি এবং তার পরিবেশের মধ্যে। এই সহজ সরল কবিতাগুলোর মধ্যে পাঠক তার নিজের যাপনচিত্র খুঁজে পায়।
একটা নিটোল সহজ, সরল, সবুজ মনকে টেনে নিয়ে যায় এক গ্রাম্য জীবনের মধ্যে। তার প্রতিটি কবিতার শিরোনাম খুবই নিঁখুত এবং যথার্থ। সব কবিতাগুলো এক একটা যাপনচিত্র। একটা গ্রাম্যজীবনের স্নিগ্ধ বাতাস বইছে তার বইয়ের মধ্যে। ঈশ্বরের সৃষ্টি এই প্রকৃতিকে দুই চোখ দিয়ে দেখেছেন, তার সুক্ষ্ম অনুভূতি দিয়ে উপলব্ধি করেছেন এবং তিনি অন্তর দিয়ে ভালোবেসেছেন।
তার কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতা একটা ঝকঝকে ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। বৈরাগী জ্যোৎস্না, কুরুয়া পাখি, গুড় মেশানো মুড়কি, তুলতুলে অন্ধকার, প্রজাপতি রঙা ফ্রক, গ্রাম্য চারণভূমি, ধুলো মাটির পুরনো গন্ধ, মুখাবাঁশি, নিশ্চুপ ধানবতী মাঠ, সন্ধ্যা গামী নৌকা, বারোয়ারী উঠোন, ডানাওয়ালা আরশোলা, বুড়ো বটতলা, কেরোসিন কুপী প্রভৃতি শব্দ যা আলাদা আলাদা এক একটা বিষয় তার কবিতায় ছবি হয়ে ধরা দেয়। তার কবিতার শব্দচয়ন একজন নিবিড় পাঠকের মনকে স্পর্শ করবে। তার গদ্য লেখার স্বাতন্ত্র আমরা যারা ইতিমধ্যে সহজ উঠোনের ধারাবাহিক "পৈলা সানঝির কথা" পড়েছি, তারা তার শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় পেয়েছি এবং মুগ্ধ হয়েছি তার বিষয়ভিত্তিক বহিঃপ্রকাশ দেখে। অসাধারণ তার দেখবার চোখ। কোনো অনাবিষ্কৃত বস্তু বা দৃশ্যপট তার দৃষ্টি ক্যামেরায় ধরা দেয়। উদয় ভৌমিকের অনন্যসাধারণ প্রচ্ছদ বইটিকে নান্দনিক করে তুলেছে। বইটির বাঁধন অত্যন্ত মজবুত। স্বল্প মূল্যে উপলব্ধ। তার বইয়ের প্রতিটি অক্ষর নির্ভূল এবং ঝকঝকে। সেই জন্য চিকরাশী প্রকাশন প্রশংসার দাবি রাখে।
তার কাব্যচর্চার এই নিদর্শন নতুন প্রজন্মের কবিদের কবিতা লেখবার উৎসাহ যোগাবে। প্রকৃতিই ঈশ্বর, সেই গ্রাম্য প্রকৃতিই তার কবিতার মুখ্য উপাদান। "মেয়েটি ও অদৃশ্য জোছনা গাছ" পাঠক সমাদৃত হবে। ঈশ্বরের প্রতি তার এই সমর্পণ এবং কৃতজ্ঞতা তাকে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেবে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴