পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর আলোচনায় অমিত কুমার দে-এর কাব্যগ্রন্থ 'বিসমিল্লার সানাই চৌরাশিয়ার বাঁশি'
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর আলোচনায় অমিত কুমার দে-এর কাব্যগ্রন্থ 'বিসমিল্লার সানাই চৌরাশিয়ার বাঁশি'
"তোমার মেঘের রুমালে মুছে দাও চশমার কাচ
কাচ খুলে শঙ্খ আঙুল রাখো চোখের পাতায়", "এমন গোধূলিতে কেউ তোমাকে আকাশ দেখতে বলল
আর তুমি রাজেন্দ্রাণীর মতো বললে
এই দ্যাখো আমার আকাশ আমারই মুঠোয়"
প্রকৃতি প্রেমী ডুয়ার্স কবি অমিত কুমার দে, তার কাব্য গ্রন্থ 'বিসমিল্লার সানাই চৌরাশিয়ার বাঁশি' কাব্য গ্রন্থের তিন 'শ তেত্রিশটি কবিতায় প্রকৃতি পুজোর বিবিধ উপকরণের অন্যবদ্য ডালি সাজিয়ে তুলেছেন। মোট তিন'শ ছেষট্টিটি কবিতার মধ্যে রাজেশ্বরী সিরিজের বিরানব্বইটি কবিতা স্থান পেয়েছে এই কাব্যগ্রন্থে। অসাধারণ এই কবিতা গুলোতে এক জীবন দর্শন ফুটে উঠেছে। মানুষ এবং প্রকৃতি কবির কবিতাগুলোর মুল উপাদান। বৃষ্টি নিয়ে দুটি কবিতা এই কাব্যগ্রন্থে, দুটিই ভিন্ন ভাবে পরিবেশিত হয়েছে। বৃষ্টি শিরোনামে একটি কবিতায় কবি বলছেন,
"তীব্র কষ্টের ওপর
ডুয়ার্সের বৃষ্টিদের রাখলে
কষ্টরা ভাসতে শেখে
হাতিনালার ওপর দিয়ে
তারা চলে যায় চা বাগানের দিকে
বন্ধ বাগানের দরজা খুলবার জন্য
জলচিঠি পৌঁছে দেয়
ম্যানেজার বাংলোয়।"
একই শিরোনামে অন্যটিতে মেঘ কে বলছেন,
"রোমকুপে যে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো থাকলো
তারা তো পর হবার নয়
তাই মনখারাপ করো না মেঘ
অন্য কোথাও ঝরে পড়লে
এসব বৃষ্টি আমারই থাকল"
প্রকৃতিকে এবং প্রকৃতির সাথে নিবিড়ভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে কবির যাপন।
সুন্দর কবিতায় ঝরে পড়েছে সেই একই বাঁশির অন্য সুর,
"গেটের খুব কাছেই দাঁড়িয়ে রয়েছে আশ্বিন
মুঠোয় শিউলি নিয়ে
তার পিছনেই রয়েছে কাশবন
খুঁজে বের করো আগমনী গান"
বর্তমান কালে উত্তর আধুনিকতার নাম করে আধুনিক কবিতায় দুর্বোধ্য ভাষা প্রয়োগের প্রবনতা লক্ষ্য করা যায়। কবি একজন পোস্ট মর্ডানিজম যুগের কবি হয়েও তাঁর কবিতাগুলিতে অপূর্ব শব্দচয়ন করে কবিতা গুলি প্রাঞ্জল করে পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন। তার কোনো কবিতাই পড়তে কষ্ট হয় না। এত স্নিগ্ধ উচ্চারণ সুন্দর কবিতাকে আরও সুন্দর করে তুলেছে। পৃথিবীর সব থেকে বড় সৌন্দর্য্য ভাষার সৌন্দর্য্য। কবি তার কবিতাগুলোতে অপূর্ব ভাষার মাধুরি ঢেলে দিয়েছেন।
"ভোরের সব নিয়ে বসে আছি রাজেশ্বরী
ফিরে এসো তোমার নদীর কাছে
কষ্ট জল শুদ্ধ হয়ে আছে
রৌদ্রের প্রতিফলনে তোমার মুখমণ্ডল
আহিরী ভৈরব বাজছে বুকের বাঁশিতে
ফিরে এস.... "(রাজেশ্বরী ২৮২)
এই আকুতিতে অদ্ভুত এক সারল্য আছে
কখনো এক চিরন্তন সত্য কবিতার লাইনে উঠে এসেছে। রাজেশ্বরী সিরিজের ১৮৯ সংখ্যক কবিতায় লিখেছেন,
"তোমার জন্য অপেক্ষারা দাঁড়িয়ে থাকে রাজেশ্বরী
হাজার বছর ধরে দাঁড়িয়ে ছিল, আরও হাজার বছর যাবে..... "
"ভাষা সরস্বতী" কবিতায় তিনি বলছেন,
"তোমার বিগ্রহের সামনে
প্রথম যেদিন হাত পেতেছি
আমার জন্মান্তর হয়েছে
তুমি আমাকে অক্ষর দিয়েছ
শব্দ দিয়েছ বাক্য দিয়েছ
আমার ভাষা সরস্বতী
তোমাকে প্রণাম করি আজ
প্রণামের ভেতর আমার প্রেম
আমার অকাল বসন্ত"।
একটা অকপটে স্বগতোক্তি ব্যক্ত হয়েছে। মৃম্ময়ী মানস চোখে চিন্ময়ী রূপে ধরা দিয়েছে।
এই পবিত্র ঈশ্বরীয় প্রেম এক সানাই এর সুর হয়ে ভেসে বেড়িয়েছে তার কাব্য গ্রন্থে।
রাজেশ্বরী সিরিজে তিনি বলছেন,
"চারিদিকে বেজে উঠুক বসন্ত বীণা
একটা দূরগামীট্রেন ভরে আসুক রাঢ় দেশের সব শিমুল
সমস্ত কামরায় লেবু ফুলের গন্ধ ভাসুক
তোমাকে ঢেকে দিই তীব্রতর পলাশে শিমুলে
এখানেই দাঁড়াও আমার সরস্বতী
তোমাকেই আজ রাজেশ্বরী বলে ডাকি"। (রাজেশ্বরী ২২৩)
রাজেশ্বরী কবির মানসপ্রতিমা, সেই ঈশ্বরের বন্দনা উঠে এসেছে সারাটা কাব্যগ্রন্থ জুড়ে। সেখানে অতৃপ্তির কোনো স্থান নেই। ইংরেজিতে যাকে বলে selflessness তা বিমূর্ত ভাবে ফুটে উঠেছে তাঁর জীবন দর্শনে। তাঁর নিজস্ব কোনো চাওয়া পাওয়া নেই। সব দেওয়ালগুলো সরিয়ে দিয়ে এক আকাশকে ছাদ করে ভাবতে শিখেছেন।তাই নিজের নয় সবার জন্য সাহিত্যে ব্রতী হয়েছেন এক আকাশ, এক উঠোনে।
ছন্দের জাদুকর কবি অমিত কুমার দে, তার এক'শ ছড়ার বইয়ে ছন্দের নিপুণতার স্বাক্ষর রাখবার পাশাপাশি কবিতায় অন্তমিলের এক অসাধারণত্ব পাঠকের মনে বিশেষ ভাবে ছাপ ফেলেছে। এই কাব্যগ্রন্থে অনেক কবিতায় অন্তমিল পাঠকদের মুগ্ধ করবে। তার আকাশ কবিতায় তিনি লিখেছেন,
"ইচ্ছে হলে ভাঁজ করে রাখ
ইচ্ছে হলে খোল
ইচ্ছে হলে বানিয়ে নিবি নিজস্ব সম্বল।"
একই ভাবে তিনি আবারও বলেছেন,
"আকাশটাকে বইতে হলে
নদীর মতো থাক
অনেক নীলে বিষ হয়ে যাক
তোর শরীরের বাঁক।"
দীপাবলি কবিতায় ঠিক তেমনই ছন্দ ঝরে পড়েছে এক অতি অন্তর্নিহিত জীবন দর্শনে,
"আকাশ প্রদীপ জ্বলতে থাকুক গাছে
তোমার আমার আগুন খেলার কাছে
এই যে আগুন, তোমার আমার পোড়া
আজকে দ্যাখো সারা আকাশ জোড়া।"
এখানেও কবির কবিতার মধ্যে ঈশ্বরের প্রতি সমর্পণ ফুটে উঠেছে। "ভাষা সরস্বতী" কবিতায়
ঈশ্বর এবং সঙ্গীত সমার্থক। রাজেশ্বরী কবির মানস প্রতিমা। কবি শ্রী অমিত কুমার দে তার কবিতার বইটির কবিতাগুলো কোনো না কোনো ভাবে ঈশ্বরের কাছে সমর্পিত এক পুস্পার্ঘ্য এই বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। মানুষের ঈশ্বরের কাছে চাওয়া পাওয়ার কোনো শেষ নেই। আমরা সারাদিন পরে যখন ঘরে ফিরে আসি তখন নিজেকে প্রশ্ন করলে বুঝতে পারি আমাদের চাওয়া পাওয়ার হিসেব নিকেশ। তখন পাঠকের হাতের সামনে "বিসমিল্লার সানাই চৌরাশিয়ার বাঁশি" থাকা খুব প্রয়োজন। এক একটা কবিতা পাঠকের ক্লান্তি দূর করবে। সানাই আর বাঁশীর সুর আমাদের নিয়ে যাবে পরম কাঙ্খিত ঘুমের দেশে। রবি ঠাকুর তার গীতবিতানে বোধ হয় এই কাব্যগ্রন্থের নির্যাসটুকু সংকলিত করেছেন,
"প্রভু, আজি তোমার হাত রেখো না ঢাকি।
এসেছি তোমারে হে নাথ, পরাতে রাখি।
যদি বাঁধি তোমার হাতে, পড়ব বাঁধা সবার সাথে,
যেখানে যে আছে কেহই রবে না বাকি।
আজি যেন ভেদ নাহি রয় আপন পরে,
তোমায় যেন এক দেখি গো বাহির ঘরে।
তোমা সাথে যে বিচ্ছেদে ঘুরে বেড়াই কেঁদে কেঁদে
ক্ষণেকতরে ঘুচাতে তাই তোমারে ডাকি।"
......রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (গীতবিতান, পূজা পর্য্যায়, ৩৬৪)।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴