পাঁজরে ঢেকে রাখি নীরব শূন্যতা/সুকান্ত নাহা
পাঁজরে ঢেকে রাখি নীরব শূন্যতা
সুকান্ত নাহা
অনিন্দ্য সেনগুপ্তর সাথে আমার পরিচয় খুব অল্পদিনের। বরং সহজ উঠোনের পাতায় ওর লেখালেখির সাথে পরিচিত হয়েছিলাম বেশ কিছু আগে। চমকপ্রদ গদ্যভাষ্য ছিল অনিন্দ্যর। "বয়সের গাছ পাথর শরীর বেয়ে ঝুরি হয়ে নেমে এলে উদ্ভিদের ক্ষেত্রে নাম যদি হয় ঠেসমূল, মানুষের গোত্রে সে তখন শুক্রা ওরাওঁ, জঙ্গল লাগোয়া বনবস্তির এককালের একচ্ছত্র সরদার।" অথবা 'বিশ ফুট বাই বিশ ফুট' শীর্ষক গদ্যে বাল্যের স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি সম্পর্কে লিখতে গিয়ে অনিন্দ্য লিখেছিল, " ...আজ ভগ্ন প্রায় সেই বাড়িতে জানি না কোন বাস্তুসাপ পাহারা দেয় কিনা আমার এসব রত্নভাণ্ডার। শুধু জানি বাড়ির পেছনে ওই জারুল গাছ তার বেগুনি ফুলের ঝাঁক নিয়ে ফুটে রইবে আমার অন্দরমহলে।"
মায়াময় এমন গদ্যের চলন আমাদের টেনে নিয়ে পিছু নিতে বাধ্য করে। অনিন্দ্য কী কবিতাও লিখত? হয়তো লিখেছে, আমার পড়া হয়নি। এ কথা কেন মনে হল? কারণ ওর গদ্যের বাঁধুনিতে যে প্রচ্ছন্ন কাব্যের ইঙ্গিত ছিল। আমার জানা নেই ও ওর এই স্বল্পায়ু জীবনে আর কী কী লিখে গেছে? কতটুকুই বা পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমাদের। বেঁচে থাকলে ও যে আরো অনেক অনেক লিখতে পারত, অনেক শক্তিশালী লেখা যে আমরা ওর কাছ থেকে পেতে পারতাম তা ও ওর অল্প কিছু লেখাতেই তার স্বাক্ষর রেখে গেছে।
কোনরকম দ্বিধা না রেখে, রাখ ঢাক না করেই বলতে পারি, সহজ উঠোনের লেখক গোষ্ঠীর ভীড়ে শারীরিক উচ্চতা যেমন তাকে আলাদা করে চিনিয়ে দিত, ঠিক তেমনি অনিন্দ্য সেনগুপ্ত ছিল এমনই একজন লেখক যাকে সাধারণ, মাঝারি ও নিম্ন মাপের কলমের ভীড়েও সহজেই আলাদা করে চিনে নেয়া যেত। সে অর্থে অনিন্দ্য সেনগুপ্ত চলে যাওয়া মানে সহজ উঠোন তথা ডুয়ার্সের সাহিত্য জগতের এক অপূরণীয় ক্ষতি।
মানুষকে আপন করে নিতে ঠিক কতদিন লাগে? কেউ এক মুহূর্তেই আপন হয় কেউ আবার বহুকাল কাছাকাছি থেকেও ঠিক আপন হয়ে উঠতে পারে না। আপন হয়ে ওঠার কোন নির্দিষ্ট শর্ত থাকে না। চটজলদি কাউকে আপন করে নেবার ক্ষমতাও সকলের থাকে না। একজন মানুষের মধুর ব্যবহার ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব অচেনা মানুষকেও কাছে টেনে নেয়। অনিন্দ্য ছিল ঠিক সেই গোত্রের মানুষ। ওর সাথে আমার মুখোমুখি দেখা এবছর সহজ উঠোনের বার্ষিক সাহিত্য সভায়। তার আগে 'বীরপাড়ার রবিবারের সাহিত্য আড্ডায়' ও আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। সেখানে যেতে পারিনি ব্যক্তিগত কারণে। সেদিন সহজ উঠোনের সাহিত্যসভায় ও নিজে এসে আমার সঙ্গে আলাপ করেছিল। ওর ঐ অমলিন হাসিটুকু ভুলতে পারি না। স্কুলের বারান্দায় করিডোরে দাঁড়িয় আমরা তিনজন, আমি সৌগত ও অনিন্দ্য ছবি তুললাম। লেখক রাজর্ষি দত্ত সেদিন ছবিটি তুলে না দিলে অনিন্দ্যের সঙ্গে আমার কোনো ছবি থাকত না। সামান্য কিছু কথা হয়েছিল সেদিন। ও একটি পত্রিকার কথা বলেছিল। বলেছিল আমাদের পত্রিকায় আপনি লেখা দেবেন। আমি চেয়ে নেব আপনার থেকে। এর কিছুদিন বাদে হঠাৎ করে একদিন ওর ফোন এল। অনিন্দ্যর কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম ওপার থেকে। অনিন্দ্য বলল, "দাদা আমাদের 'তাতাসি' পত্রিকার জন্য আপনি একটি লেখা পাঠান।" বললাম, "ঠিক আছে। পাঠিয়ে দেব"।
'তাতাসি' শব্দের অর্থ কী আমি জানতাম না। পরে জেনেছিলাম তাতাসি একটি নদীর নাম। বড় সুন্দর লেগেছিল নামটি। কল্পনায় স্বচ্ছতোয়া তাতাসির একটি জলরঙে আঁকা ছবি চোখের সামনে ফুটে উঠেছিল। এর ঠিক কিছুদিন বাদেই সন্ধে নামার কিছু পরেই এল সেই দুঃসংবাদ। পায়ের নিচের মাটিটা যেন দুলে উঠেছিল। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না অনিন্দ্য নেই। কিছুক্ষণ কথা বলতে পারিনি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়েছিলাম। সারারাত সেদিন ঘুম এল না। যন্ত্রণার প্রকাশ ঘটাতে প্রায় ঘোরের মধ্যে লিখে ফেলেছিলাম একটি কবিতা, "তাতাসি, তাতাসি... তুমি কী শুনতে পাচ্ছ? এত নৈঃশব্দ্য কেন এখনও, তোমার আঁচলে?"
তারপর থেকে সহজ উঠোনের পাতায় প্রতি রোববার অনিন্দ্যর ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং পরিচিতদের কলমে একের পর এক উঠে আসছিল অনিন্দ্য সম্পর্কে নানান অজানা অচেনা তথ্য। পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল কিছু মানুষ কী মুছে গিয়েই স্পষ্টতর হয়ে ওঠে? মৃত্যুই কী কিছু মানুষকে আরো বেশী ঔজ্জ্বল্য দিয়ে যায়? খুব কাছের কিছু মানুষের অসামান্য গুণাবলী বেঁচে থাকতে কেন আমাদের চোখে পড়ে না!
ভেবেছিলাম অনিন্দ্যকে নিয়ে কিছু লিখব না আর। কেন যেন আশঙ্কা হত অনিন্দ্য সেনগুপ্তকে আমি কতটুকুই বা চিনি, ওকে নিয়ে লিখতে গিয়ে লেখাটি মেকি হয়ে পড়বে না তো? বড্ড বেশি আরোপিত হয়ে পড়বে না তো? তার চেয়ে বরং অনিন্দ্যর জন্য বুকের মাঝখানে শ্রদ্ধার আসনটি অমলিন হয়েই থাক না কেন? তারপরেই আবার মনে হতে লাগল, সহজ উঠোনে এই একমাস ব্যাপী অনিন্দ্য স্মরণে যাঁরা যাঁরা লিখেছেন তাঁদের পাশে এক কোণে যদি একটুখানি জায়গা করে নিতে না পারি তাহলে হয়ত কোথাও যেন একটা শূন্যতা রয়ে যাবে। মাস ফুরিয়ে গেলে কোথাও যেন একটা অপরাধবোধ মিশে রইবে বুকের ভেতর।
আসলে এটাও হয়ত ঠিক যে, আমরা কাউকে কতটুকু ভালোবাসি, কতটুকু শ্রদ্ধা করি তা বোঝানোর জন্য কখনও কখনও কিছু শব্দ, কিছু কথাও যেন বড্ড বেশি প্রয়োজন। নইলে নীরবতা হয়ত অশ্রদ্ধা কিংবা বিস্মৃতিরই নামান্তর হয়ে ওঠে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴