পশ্চিমের উড়ান/চিত্রা পাল
পশ্চিমের উড়ানে
চিত্রা পাল
যদিও মধ্যপ্রাচ্য হিসেবেই পরিচিত, তবু আমার কাছে পশ্চিমে যাওয়া। কেননা সত্যি হিসেবে আমাদের দেশ থেকে আরব দেশ তো পশ্চিমেই। তাই দুবাই যাওয়া মানে পশিমেই যাওয়া।পাঁচ ঘন্টা পশ্চিমের দিকে উড়ে যাবার পরে এসে গেলাম দুবাই শহরে। দুবাই শহরটা যেন পটে আঁকা ছবির মতো। এয়ারপোর্ট থেকে কয়েক দিনের সাময়িক পান্থশালায় আসার পথেই চোখে পড়েছিলো তাকে, কয়েকদিন অবস্থানের পরে আরো বেশি করে মনে হল যেন।এখন মনে হতে পারে সব ছেড়ে দিয়ে আমি হঠাৎ দুবাইএর কথা বলছি কেন, তার উত্তরে আমি বলি যে, আমি সদ্যই গিয়েছিলাম দুবাই নগরে তাই।
দুবাইএ পা দিয়েই প্রথম আমার মনে হলো সময়ের কথা। কারণ আমি পুব থেকে এসেছি, সেখানে সময় এখানের থেকে এগিয়ে প্রায় ঘন্টা দেড়েক। মানে এখানে যখন এলাম তখন সময় সাড়ে বারোটা, ওদিকে কলকাতায় তখন দুপুর দুটো হয়ে গেছে।মহাশূন্যে, কখনও মেঘের ওপর্ ভাসতে ভাসতে এসে পৌঁছলাম এই নগরে ঠিক দুপ্পুরবেলায়, পরেরটা আর বললাম না।
দুবাই সংযুক্ত আরব আমিরাতের সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে জনবহুল শহর। এটি দুবাই আমিরাতের রাজধানীও। পারস্য উপসাগরের কূলে অবস্থান থাকা দুবাই একেবারে বৈশ্বিক শহর, মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান ব্যবসায় কেন্দ্র।
এদিন বিকেলে চলে এলাম একেবারে খোদ মরুভূমি অঞ্চলে। মরুভুমির বালি রাজ্যে পৌঁছতে সময় লাগলো খানিক। আসলে দুবাই সরাসরি আরব মরুভূমির অন্তর্গত।এখানে এসে দেখি মরুভূমিতে এডভেঞ্চার করার নানান উপায়। এখানকার এই লিউয়া ডেসার্ট বড় বড় বালিয়াড়ির জন্য বিখ্যাত। সেই বালিয়াড়িতে কেউ যাচ্ছে বাইক নিয়ে, কেউ যাচ্ছে গাড়িতে, কেউ যাচ্ছে জিপে চড়ে।যে যেরকম পছন্দ করছে সেভাবে গাড়ি নিয়ে মরুভূমির দিকে চলে যাচ্ছে। আমরা কয়েকজন ছিলাম, আমাদের মরুভূমি সফরের জন্য একখানা জিপ ঠিক করে হলো।যাবার আগে ওখানেই আমাদের কয়েকজনের চা পানের বাসনা হওয়ায় গেলাম চা কিনতে। শুনলাম এককাপ চা পাঁচ দিরাম বা দেরহাম। সেটা কোন ব্যাপার নয়। কিন্তু যখন টাকার সঙ্গে হিসেব করলাম তখন চক্ষু চড়কগাছ। ওখানে এক দিরাম বা দেরহাম মানে আমাদের তেইশ টাকা। তার মানে এককাপ চা এর দাম তেইশ গুণ পাঁচ মানে একশ পনের টাকা। যা হোক সে দিয়েই খাওয়া হলো। এই প্রথম ওদেশের দোকানের সঙ্গে আমাদের কেনাকাটার লেনদেন হল।
জিপ আমাদের নিয়ে একটু এগিয়ে একটা গ্যারেজ কাম গাড়ি সারাই এর জায়গায় নিয়ে এলো। আমরা সবাই ভাবলাম যে,গাড়িতে পাম্প ঠিক আছে কিনা দেখে নেবে। পরে দেখি তা নয়, ওখানে গাড়ির টায়ার থেকে হাওয়া বের করে দেওয়া হচ্ছে, তাহলে মরুপথের বালির রাজ্যে চলতে সুবিধে হবে। এরপরে শুরু হলো পথ চলা। ওই ধূ ধূ মরুভূমিতে চলতে শুরু করলো গাড়ি। সে গাড়ি একবার এদিকে হেলে তো আর একবার ওদিকে হেলে। প্রথমে আমি বেজায় ভয় পেয়ে গিয়্বেছিলাম, পরে দেখলাম এটা গাড়ি নিয়ে চালক মজা করছে।একবার এতো হেলিয়ে দিলো যে আমরা সবাই চিৎকার করে উঠলাম। গাড়ির চালকের হাসি শুনে বুঝলাম এটাও ভীতি প্রদর্শনের কারসাজি।এই মরুরাজ্যের তো কোন দিশা নেই। একবার পথ হারিয়ে যদি বালির পাহাড়ের ওপারে চলে যাই তাহলে তো কেউ খুঁজেই পাবে না। মরুভূমি সফর সেরে চলে এলাম সন্ধ্যে সন্ধ্যেই এক সান্ধ্য আসরে। যেখানে নাচ গানের সঙ্গে হবে রাতের খাওয়া দাওয়া। এই খানে এক আরবিয়ানের হাতে দেখলাম ফেলিকান পাখি।যাকে খুব সম্ভব শা বাজ পাখি বলা হয়। এর আগে সুতপা বসুর হুবারা বাস্টার্ড উপন্যাসে এই পাখি সম্পর্কে নানা কথা পড়ে ছিলাম। আজ এখানে একেবারে কাছে গিয়ে পাখিটাকে দেখে এলাম।
জাবেল পার্কে গিয়ে দুবাই ফ্রেম দেখা হলো দুপুর বেলায়। খুব সুন্দর ফুলে ফুলে ভরা এই জাবেল পার্ক। সেখানে আছে এই দুবাই ফ্রেম। বলা হয় এটি বিশ্বের বৃহত্তম ফ্রেমের রেকর্ড। এটা এমন জায়গায় প্রতিষ্ঠিত একদিকে দেখা যায় আধুনিক দুবাই আর অন্য দিকে পুরনো দুবাই।দুবাই ফ্রেম সোনার জলে রঙ করা স্টেনলেস স্টিলের তৈরি। আমরা লিফটে করে উঠলাম একেবারে ওপরে। সেখানে অপেক্ষা করেছিলো আর এক বিস্ময়। এক ধরণের কাঁচের তৈরি ছাদ যেখান দিয়ে এপার ওপার করা যায়, আমরা পেরোতে গিয়ে দেখি একেবারে তলা দিয়ে ছোট্ট পিঁপড়ের মতো গাড়ি যাচ্ছে। বেশ ভয়ের ব্যাপার।
মিউজিয়াম অব দ্য ফিউচার দেখে বেশ মজা লাগলো। এই মিউজিয়াম ভবিষ্যতের চিন্তা ভাবনা আর কিছু এগিয়ে যাবার মতো ভাবনার প্রদর্শনী স্থান। এই জাদুঘরের লক্ষ্য হলো প্রযুক্তিগত উন্নয়ন আর উদ্ভাবন বিশেষ করে রোবটিকস,এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার। ভবিষ্যতে মানুষের ভাবনা সম্বলিত অনুষ্ঠানও দেখলাম। এটা বেশি দিন আগে হয়নি এই ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে উদবোধন হয়েছে।
সন্ধ্যায় ধাও ক্রুইজে ঘোরা হলো দুবাই ক্রীক বা সমুদ্র খাঁড়িতে। এ এক অসামান্য অভিজ্ঞতা। ধাও এক ধরণের বড় নৌকো, প্রায় স্টিমারের মতো। সেখানে আগে থেকেই আমাদের গ্রুপের টেবিল বুক করা ছিলো। আমরা সকলে বসার পরে নৌকো চলতে শুরু করলো। ওদিকে স্টেজে শুরু হলো নাচ গান। এদিকে অলৌকিক জলযানে চলেছি যেন। যেদিকে তাকাই দেখি অপরূপ আলোক সজ্জ্বায় সজ্জিত দুবাই নগরী পারস্য সাগরের জলে প্রতিবিম্বিত, কি দেখবো, কোনটা দেখবো ভেবে পাই না। আমার নাচ গানের দিকে মন ছিলো না, ছিল আলোক সজ্জ্বার বিম্বিত প্রতিভাসে। এদিকে টেবিলে সুখাদ্যের আয়োজন। কখন যেন আমরা আমাদের সফর সেরে কূলে ভিড়লাম, কে জানে। তখন রাত গড়িয়ে গেছে মধ্যযামে। ঘরে ফিরেও তা স্মৃতির স্নায়ুতন্ত্রে লেগে রইল অনুক্ষণ।
দুবাই এর গোল্ডসুখ বা সোনার বাজার পৃথিবী বিখ্যাত। একদিন গ্রুপের প্রায় সবাই গেলো ওখানে। আমি যাইনি। বরং বাজারের এক ঘড়ির দোকানে বসে দোকানির সাথে গল্প করে তার দোকানদারি দেখে ওখানকার লোকজন দেখেই ভালো লাগল। দোকানদারের নাম মাধব, নেপালের ছেলে, তার মা বোন থাকে দিল্লীতে, তাই মাঝে মাঝেই যেতে হয় দিল্লী। যদিও নেপালেই বড় হওয়া, তবু নেপালে এখন বিশেষ যাওয়া হয়ে ওঠে না। শুনেই মনে হলো কোথাকার মানুষ কোথায় এসে কাজ করে চলেছে।
এরমধ্যে একদিন যাওয়া হলো বুর্জ খলিফা।কবে থেকে শুনছি বুর্জ খলিফার নাম। পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু বাড়ি, কালী পুজোয় প্যান্ডেল হয় এই নামে,এতো বিখ্যাত যে কি বলবো, তাকে এবার দেখতে পাবো স্বচক্ষে সে এক মহা উত্তেজনা। যাই হোক শেষমেষ যাওয়া হলো বুর্জ খলিফা।
বুর্জ খলিফা হলো সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইতে অবস্থিত এক আকাশচুম্বি ভবন। এর মোট উচ্চতা ৮২৯.৮ মিটার বা আধ মাইলেরও বেশি। ২০০৯ সাল থেকে এটাই বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবন।শুনলাম এই পৃথিবী বিখ্যাত আকাশচুম্বি ভবনের প্রচুর তলা আর ফ্ল্যাটের মালিক একজন ভারতীয় ব্যবসায়ী, তাঁর নাম বি আর শেঠি। শোনা যায় ,তিনি নাকি প্রথমে নিভিয়া ক্রীমের সেলসম্যান হিসেবে আবু ধাবিতে কাজ শুরু করেন। পরে পরে তাঁর কাজে এতো উন্নতি করেন, যে তাঁর নিজের প্রাইভেট জেট ও ছিলো। কিন্তু পরবর্তিতে সেটা আর স্থায়ী হয়নি।
আমরা নানা ধরণের লিফটে করে উঠতে থাকলাম। 148 level অবধি উঠতে দেয়। আমরা 125-124 level বারান্দা থেকেই দেখলাম দুবাইকে।এত উচ্চতায় কোনদিন আসা হয়নি। এও এক এশ্চর্য অভিজ্ঞতা। তারপরে নামার সময় হলো আর এক অন্য অভিজ্ঞতা। এত লোকের ভীড় ,সামাল দিতে কর্তৃপক্ষের হিমসিম অবস্থা। অনেক অপেক্ষার পরে এ লিফট থেকে ও লিফটে এসে কতক এত বাড়ীর গোলক ধাঁধাঁয় ঘুরে ক্রমে আমাদের ভূ পৃষ্ঠে অবতরণ হলো। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
এখানে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম,ভারতীয়ের সংখ্যা প্রচুর। সে নানান প্রদেশের।তবে বাংলায় কথা বলছে মানেই ধরে নাওয়া যাবে না, সে ভারতীয়। ওখানে প্রচুর বাংলাদেশি আছে, যারা শুধু উপার্জনের তাগিদেই ওখানে গিয়েছে। আমরা মিরাকেল গার্ডেনে গিয়েছি।সেখানে যে গাড়িতে করে বাগান ঘুরে বেড়ালাম,সে গাড়ির চালক বাংলাদেশের চট্টগ্রামের। মিরাকেল গার্ডেন হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক ফুলের বাগান। প্রত্যেক ঋতুতে ফুলসজ্জা ঋতু অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়। কাজেই দর্শকরা ঋতু অনুযায়ী সতেজ ফুল অবশ্যই দেখতে পাবেন, সে যে ঋতুতেই আসুক না কেন।আমরা যখন গিয়েছি তখন এমনিতেই ফুল ফোটার কাল, বসন্তের মাঝ বরাবর। কি অফুরন্ত ফুল যে ফুটে আছে ,আর কত রকম যে সজ্জা তাদের সে আর বলে শেষ করা যাবে না।
আর দুবাইয়ে এসে যদি আনন্দ করতে হয়, কেনাকাটা করতে হয় তাহলে আসতেই হবে গ্লোবাল ভিলেজে। এটাতে পৃথিবীর বহু দেশ তাদের নিজস্ব পণ্য নিয়ে স্টল দিয়েছে। আমরা ভারতীয় স্টল দেখলাম, সামনের দিকটায় লালকেল্লার ধরণের গঠন শৈলি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ জনের জনসমাগম দেখলাম। আরও দেখা হলো কত কিছু। না দেখা থেকে গেলো অনেক। এর মাঝে একদিন যাওয়া হলো আবুধাবি, সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী। সে কাহিনী পরে বলব।
ছোট থেকে নিজের দেশ সম্পর্কে জেনেছি, শক হুনদল পাঠান মোগল এক দেহে হলো লীন। ভাবতাম এটা হয়তো আমাদেরই বৈশিষ্ট্য। কত জাতি কত শাসকদল কত ধর্ম দিয়ে তৈরি হয়েছে আমাদের দেশ। দুবাইতে এসে দেখি সারা পৃথিবীর কত জন কত মানব এসে মিলেছে আজ এই পারস্য উপসাগরের তীরে। কয়েক দশক আগেও যা ছিলো মাছ ধরার সাধারণ একটা গ্রাম, আজ সে রীতিমত গর্বিত জনবহুল বৈশ্বিক শহর, মধ্য প্রাচ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা কেন্দ্র। এটি যাত্রিবাহী ও পণ্যবাহী বিমানের প্রধান কেন্দ্র। মাটির তলার তরল সোনার বিভায় উজ্জ্বল, দুবাই আজ নিজের তারুণ্যে নিজেই বিভোর।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴