পরান সখা বন্ধু হে আমার/অতনু চন্দ
পরান সখা বন্ধু হে আমার
অতনু চন্দ
কবিগুরু রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরকে নিয়ে আজ কিছু লিখব বলে বসে ভাবছি -কি লিখব! এ যে এক অতল সমুদ্র। তার কত টুকুই বা আমি জানি! রবীন্দ্রনাথের দর্শন, রবীন্দ্র প্রজ্ঞা, রবীন্দ্র নাটকের রূপকধর্মীতা এসব অনেক গভীর ভান্ডার। তাঁর সে সব কথা বলা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য।
তাই সে দিকে না গিয়ে আজ তাঁকে ঘিরে আমার কিছু স্মৃতি মেদুরতার কথা এখানে তুলে ধরছি কেমন? আর সেটা আমার পক্ষে বলা অনেক সহজ হবে।….না হলে, - ফটিক চাঁদের মতন - এক বাঁও - দো বাঁও কেন?কোন বাঁও-ই আমার মিলবে না যে..!
ছোটবেলার ‘ছুটি’র দিন গুলিতে বিশেষ করে ‘রবিবার’ আমাদের একান্নবর্তী পরিবারের ভাই-বোনরা বিশেষ একটি সময়ে সবাই এক জায়গায় সমবেত হতাম কারন রাঙ্গাকাকু আমাদের যে গল্প বলে শোনাবে। কাকু সাহিত্যের ছাত্র ছিল তাই বিশ্ব সাহিত্যর গল্প, মহাকাব্যের গল্প বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের “শিশু কবিতা” ও “গল্পগুচ্ছ” থেকে পাঠ করে শোনাত এবং তা আমাদের বোঝার মতন করে সাথে সাথেই বলে দিত। ওখান থেকেই আমার রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের প্রতি আকর্ষণ ও ভালবাসা। এখনো সময় সুযোগ পেলে আমি রবীন্দ্রনাথের ‘ছোট গল্প’ পড়ি এবং এখনো আমার কাছে তা নুতন করে ধরা দেয়। অনেক লেখকের অনেক ছোট গল্প পড়েছি কিন্ত রবীন্দ্রনাথের ছোট্ট গল্পই আমার কাছে এখনও পর্যন্ত সর্বশ্রেষ্ঠ।
আমাদের পুরানো বাড়িতে ‘ঠাকুরদা’র একটি কলেরগান বা গ্রামাফোন ছিল সঙ্গে আট ব্যান্ডের একটা ঢাউস National Eco. রেডিও ছিল। তখনকার দিনে কারো বাড়িতে কলেরগান থাকাটা একটা বনেদিয়ানার পরিচয় বহন করত বলে শুনেছি! কাকুরা নানান ধরনের গান বাজাত সেই কলের গানে, যেমন- বিদেশী গান, মিউজিক,আধুনিক,কৌতুক নক্সা,শ্যামা সঙ্গীত ও রবীন্দ্র সঙ্গীত। বাড়ির সকলে গান শুনতে খুব ভালবাসত আর অতিথি এলে তো কথাই নেই। তখন মন দিয়ে লক্ষ্য করে দেখেছি একটা গান শেষ হলেই রেকর্ড ঘুরিয়ে অন্য পিঠে বসাত,পিন বদলাত এবং হেন্ডেল ঘুরিয়ে স্প্রীং টাইট দিত বা দম দিত গ্রামাফোনে। একটু বড় হওয়ার পর সে দায়িত্ব আমার কাঁধেই এসে চাপল। যদিও তখন আমার কাছে সেটা একটা খেলার মত ছিল তাই আনন্দের সাথে সে দায়িত্ব পালন করতাম। এভাবেই রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজতে বাজাতে আমি কিছু দিনের মধ্যে নিজের অজান্তেই রবীন্দ্র সঙ্গীতের ভীষন রকমের ভক্ত হয়ে উঠলাম। কি যে তার কথা- সুর ও ভাবনা! তাই সে বয়েসেই ঘন্টার পর ঘন্টা মগ্ন হয়ে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন পর্য্যায়ের গান এবং নৃত্যনাট্য গুলি রেকর্ড থেকে বারবার শুনতাম (অবশ্য তারপর আধুনিক একটা Garrard Record Changer বাড়িতে আনা হয়েছিল) । এর পরবর্তী কালে বিভিন্ন নামি দামি রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পীর অনুষ্ঠান হলেই- সেখানে যেতাম গান শুনতে। আর এভাবেই আমার শোনার কান তৈরি হলো। এখনো পুরানো কোন রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পীর গান রেকর্ডে বাজালে- আমি অনায়াসে বলে দিতে পারি, যে সেটা কোন শিল্পীর গান এবং কি গান, অথচ এ ব্যাপারে আমার কোনও প্রথাগত শিক্ষা ছিল না, আজও নেই। রবীন্দ্রসঙ্গীত ভীষণভাবে ‘আধুনিক’ আর সেজন্যই হয়ত আমাদের মন-প্রাণ-মননকে এভাবে প্রভাবিত করে!
আগেকার দিনে বিনোদনের তেমন কোন কিছু ছিল না, তাই বাড়িতে ‘অতিথি’ এলেই বড়রা আমাদের রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে তাদের শোনাতে বলত। আমি আর আমার খুড়তুতো বোন অবশ্য এ জন্য গানের ‘খাতা’ নিয়ে আগে ভাগেই তৈরি হয়ে থাকতাম! অতিথিদের, ”আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায়”, “মন মোর মেঘের সঙ্গী” বা অন্য কোনও গান নির্ভুলভাবে শুনিয়ে দিয়ে কিছুটা ঋতু চক্রে ঘুরিয়ে আনতাম! আর এ ভাবেই আমাদের রবীন্দ্র আবহে বেড়ে ওঠা। তবে এ ছবি হয়ত বাঙালির ‘ঘরে বাইরে’!
তারপর একদিন- স্কুল কলেজের গন্ডি পেরিয়ে - চাকরি হলো- সংসার হলো, দায়িত্ব বাড়ল কিন্তু তার মধ্যেই আমাদের প্রানের ঠাকুর রয়ে গেলেন চিরস্থায়ী হয়ে। সুখে-দুঃখে, আনন্দ-উৎসবে রবীন্দ্রনাথই আমাদের পরিবারের “পরান সখা হে বন্ধু আমার” হয়ে উঠলেন। আমাদের সন্তানদের মধ্যেও ক্রমে সে প্রভাব এমনি করেই ছড়িয়ে গেল।
তবে এরই মাঝে চলার পথে কিছু ব্যতিক্রমও লক্ষ্য করেছি জিবনে! ‘শেষ কথা’ বলার আগে অন্তত তার একটা না বলে পারছিনা এখানে! অবশ্য পাঠকের প্রশ্রয়েই সে কথা বলতে আমি চাই। তাই অনুরোধ করব এটাকে কেউ যেন অন্য ভাবে না নেয়, নির্ভেজাল একটু মজা করার জন্যই এই ঘটনাটা বলছি….
অনেকদিন আগে,কোন একটি “পঁচিশে বৈশাখের” দিনে রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা জানাতে, আমি আমার স্ত্রী এবং আমার বড়মেয়ে ছোট্ট মোহর, আকাশবাণীর একজন বিখ্যাত বাচিক শিল্পীর বাড়িতে গেছি-প্রতিবারের অভ্যেস মতো। আমি ওখানে কিছু না করলেও আমার স্ত্রী আবৃত্তি করত। কেউ কেউ ওখানে নাচ,গান করত। তারপর রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ টেনে অনেক রকম গভীর আলোচনা হত সেখানে, সে অনশঙ্গ আমার ভীষন ভাল লাগত হয়ত এভাবেই আমার ‘ইচ্ছেপূরণ’ হত। যাই হোক, অনুষ্ঠানের পূর্ববর্তী এমনি একটি মুহূর্তে ধূপের ধোয়ার মাঝে প্রদীপের আলোতে রবিঠাকুরের উজ্জ্বল উপস্থিতি আমরা যখন সকলে মনে প্রানে অনুভব করছি, ঠিক তখনই -হটাৎ ধুমকেতুর মতন এক যুবকের প্রবেশ ঘটল সেখানে! উপস্থিত সকলে সাময়িক বিব্রত হলেও তার আচরণেই প্রমাণ ছিল যে- সে এই বাড়ির পরিচিত ব্যক্তি! ঘরে ঢুকেই সেই যুবক বইয়ের আলামারির দিকে এগিয়ে গিয়ে তালা বন্ধ আলমারিতে সযত্নে রাখা পাশাপাশি “রবীন্দ্র রচনাবলীর” খন্ডগুলি কাঁচের মধ্যে থেকে আগ্রহভরে দেখতে দেখতে আকাশবাণীর সেই ভদ্রলোককে… হটাৎ প্রশ্ন করে বসল, ”আচ্ছা কাকু রবীন্দ্রনাথের একই বই পরপর এতগুলি আলমারিতে রাখার মানে কি!?”
ঘরের মধ্যে তখন এক নিমেষেই নি:স্তব্ধতা নেমে এল যেন! আমরা একে অপরের চোখের দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে চাইতে লাগলাম! সেদিন ঐ বিশিষ্ট ভদ্রলোক কিছু বলতে চেয়েছিলেন কিনা জানিনা…..কারন ওনার কিছু বলার আগেই কে একজন ওখানকার নীরবতা ভঙ্গ করে গুরু গম্ভীর কন্ঠে রবীন্দ্রনাথের “বোঝাপড়া” কবিটাটি আবৃত্তি করতে আরম্ভ করে দিল…..
নমস্কার, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের-
“বোঝাপড়া”
“মনেরে আজ কহ যে,
ভাল মন্দ যাহাই আসুক
সত্যরে লও সহজে।
কেউ বা তোমায় ভালবাসে
কেউ বা বাসতে পারে না যে,
কতকটা যে স্বভাব তাদের
কতকটা বা তোমারো ভাই,
কতকটা এ ভাবের গতিক…
সবার তরে নহে সবাই
……………………….
……………………….
তোমার মাপে হয়নি সবাই
তুমিও হওনি সবার মাপে
………………………….
………………………….
মনেরে আজ কহ যে,
ভালমন্দ যাহাই আসুক
সত্যরে লও সহজে।”
আমাদের ছোট্ট সেই শ্রদ্ধাঞ্জলির অনুষ্ঠানের এভাবেই এক সময় ‘সমাপ্তি’ ঘটল, আমরা সকলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে সেদিন বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। সে কথা এখনও “পঁচিশে বৈশাখ” এলেই মনে পরে।
এই বয়সে এসেও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে সে ট্র্যাডিশন আমাদের মধ্যে এখনো সমানে চলছে…..
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴