পরাণ সখা, বন্ধু হে আমার/শ্রুতি দত্ত রায়
পরাণ সখা, বন্ধু হে আমার
শ্রুতি দত্ত রায়
---------------------------------
প্রিয় সখা,
তখন আমি ছিলাম নিতান্ত বালিকা। সন্ধ্যাবেলা লেখাপড়ার পাট চুকে গেলে মায়ের কোল ঘেঁষে এসে আবদার করতাম গল্প বলার। মা গল্প বলার আগে আউড়ে যেতেন একটার পর একটা কবিতা। কখনও "আমি আজ কানাই মাস্টার, পোড়ো মোর বেড়ালছানাটি" কিংবা "আমি যদি দুষ্টুমি করে চাঁপার গাছে চাঁপা হয়ে ফুটি" অথবা "মাগো আমায় ছুটি দিতে বল সকাল থেকে পড়েছি যে মেলা" ....! শুনতে শুনতে নিজেকে একবার কানাই মাস্টার, একবার চাঁপা ফুল, কখনও আবার পঠন-ক্লান্ত, ছুটি-পিপাসু খোকা খুকু বলে মনে করতাম। আর মনে মনে ভাবতাম, কে সেই বন্ধু যে আমার মনের নানান ইচ্ছেগুলো এমনি করে যাদুবলে জেনে গেল? মাকে জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম এসব নাকি তোমার লেখা কবিতা। তুমি 'রবি কবি'। বেশ লাগত সেই নতুন বন্ধুর নাম, অন্ত্যমিলের ছন্দে ভারি শ্রুতিমধুর।
এরপর যখন শৈশবের দিনগুলোতে হাতে পেলাম তোমার 'সহজ পাঠ', পড়তে বসে দুলে দুলে চলত সরব পাঠ, চোখের সামনে ভেসে উঠত জীবন্ত সব ছবি। কখনও কোন এক "শুক্রবারের হাট"এর, কখনও বা ছোট নদীর, যে নদী চলে বাঁকে বাঁকে,,,,বৈশাখ মাসে যে নদীতে থাকে হাঁটুজল। কখনও বা তিনটে শালিক পাখির, যারা ঝগড়া করে রান্নাঘরের চালে। পাঠ্যবই-এর কবিতা যেন সত্যি হয়ে ধরা দিত প্রকৃতির মাঝে। শরতের সকালে তাই ঘাসের আগায় শিশিরের রেখা খুঁজতে যেতাম বাড়ির লাগোয়া সবুজ জমিতে। অথবা স্কুলের আমলকীতলায় ঘুরে বেড়াতাম তার দুরু দুরু বুকের খবর নিতে। সত্যিই কি ওর পাতা খসানোর সময় এসে গেছে? তোমার মত বন্ধু পেয়েছিলাম বলেই তো সেই কোন ছোট্টবেলায় এভাবে প্রকৃতিকে চিনতে,জানতে,আপন করে নিতে শিখেছিলাম শব্দ ছন্দের মাধ্যমে।
আর বৈশাখ মাসে যেদিন তোমার জন্মদিন আসত কি যে আনন্দ হত কি আর বলব। সকাল হলেই বাড়ির উঠোন আলো করে থাকা দুধেল সাদা ফুলেল টগর সাজি ভরে তুলে আনতাম। এরপর চলত মালা গাঁথার কাজ। তোমার ছবিতে পড়াতে হবে যে!! আঁকতে হবে চন্দনের আল্পনা!! আর সন্ধ্যাবেলা সমবয়সী পাড়ার সব ছেলেমেয়েরা জমা হত বাড়ির উঠোনে। সেখানেই মায়েদের শাড়ি আর বিছানার চাদর দিয়ে বানানো হত ঘরোয়া, আটপৌরে মঞ্চ। হলুদ বাল্বের আলোছায়ায় একটা টুলের ওপর মায়ের হাতের এমব্রয়ডারী করা টেবিল ঢাকনা পেতে বসাতাম তোমার চন্দনচর্চিত ছবিখানি। সামনে জ্বলত ধূপ। আর মঞ্চে তখন আমাদের মত কচিকাঁচার গলায় "তুমি",,,,,আবৃত্তি, গানে,,,,,"অমল ও দইওয়ালা" কিংবা "নগরলক্ষ্মী"র ভূমিকায়। প্রত্যেকেই তখন তোমাকে ঘিরে, আনন্দে।
একটু যখন বড় হলাম পাঠ্যবই-এর গন্ডী পেরিয়ে এলাম আমি "গল্পগুচ্ছ" এবং "সঞ্চয়িতা"য়। সর্বোপরি "গীতবিতান"এ। কত রোদ হাসা সকাল, বেহিসেবী সন্ধ্যে কেটেছে তোমাকে ঘিরে। বৈশাখের তপ্ত সন্ধ্যায় মাঝে মাঝেই আমাদের মফঃস্বলী শহরে হত লোডশেডিং। প্রাকৃতিক হাওয়ার আশায় মোড়া পেতে বসতাম নিকোনো উঠোনে। বাতাসে ভাসত বেলি আর জুঁই ফুলের সুবাস। মাথার উপরে তখন হাজারো হীরের চুমকি বসানো অনন্ত চাঁদোয়া। বাবার গলায় অন্ধকারেই সুরের তরঙ্গ খেলে বেড়াত, "আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্ব ভরা প্রাণ,তাহারই মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান" অথবা "মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল মাঝে, আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে"। মাঝেমধ্যে বাড়ির সামনের ফাঁকা মাঠের ধারে গজিয়ে ওঠা শেয়ালকাঁটা-ভাট-বিছুটির ঝোপের ওপর মিটমিট করে জ্বলত জোনাকির আলো। মা গাইতেন - "ও জোনাকি, কি সুখে ওই ডানা দুটি মেলেছ"।
এভাবেই একরত্তি মেয়েবেলা থেকে আমার মননে, চিন্তনে, প্রতিদিনের যাপনে সঙ্গী হয়ে গেলে তুমি। শিশুমনে রোপিত হওয়া রবি কবির বীজ কখন যে ধীরে ধীরে ডালপালা শিকড়বাকড় ছড়িয়ে মহীরূহ হয়ে উঠল পরিণত 'আমি'তে, জানতেই পারিনি। সেই থেকে আনন্দ-বিষাদে,হতাশা-একাকীত্বে,প্রেমে-বিরহে, প্রতিদিনের ঘাত প্রতিঘাতের জীবনে তুমি হয়ে গেলে 'চিরসখা'। প্রতি মুহূর্তেই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে থাকা এক শাশ্বত মানব।
আজ যখন দেখি সমগ্র পৃথিবী জুড়ে সভ্যতা বিপন্ন, উগ্র জাতিপ্রেম, হানাহানি, ক্ষমতার উন্মত্ত লড়াই, লোভ-লালসা,স্বার্থ, অহমিকার তমসা ঢেকে দিচ্ছে মানবিকতার মুখ, শ্বাসরোধ হয়ে পড়ছে মূল্যবোধ - তখন তোমার দর্শনকেই অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক মনে হয়। একমাত্র তোমার সৃষ্টিই পারে "অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো"র সন্ধান দিতে। ফিরিয়ে দিতে পারে শান্তির ললিত বাণী। কারণ মানুষকে ভালবেসে, প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়ে জীবনের যাত্রাপথের আনন্দ গান গাইতে যে শিখিয়েছিলে তুমিই। তাই তো আজও আকুল হয়ে বলি,
"হে বন্ধু মোর,হে অন্তরতর, এ জীবনে যা কিছু সুন্দর/সকলই আজ বেজে উঠুক সুরে" তোমার টানে, তোমার গানে, তোমার দানে ।।
ইতি -
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴