পরশমণি রবীন্দ্রনাথ/কবিতা বণিক
পরশমণি রবীন্দ্রনাথ
কবিতা বণিক
আমার শৈশবে এক বৃষ্টি স্নাত দুপুরে আমার মা জানলা দিয়ে দেখালেন — ঐ দেখ ! গাছের ওপর বৃষ্টি পড়ছে। তোমার মতোই ছোট্ট ছেলে রবি ঠাকুর এরকম দেখে তাঁর খাতায় লিখেছিলেন ‘জল পড়ে পাতা নড়ে।' আমারও সেদিনই মনের ভেতর রবি ঠাকুরের প্রবেশ। আমারই বয়সী সে এত সুন্দর লিখেছে? মাঝে মাঝে মা আমাদের ভাইবোনদের জন্য দুধ, চিঁড়ে মেখে খাওয়াতেন এক অভিনব কায়দায়। আমাদের জন্য বাটি, চামচ রাখা আছে। মা এক বড় জাম বাটিতে চিঁড়ে, দুধ এনে বসতেন। বেশ সুর করে তাতে আমসত্ব দিতেন। তারপর কদলী দলতেন। এরপর সন্দেশ তাতে মেখে আমাদেরকে এক প্রতিযোগিতায় ফেলে দিতেন। সেটা ছিল শুধু এই খাবারেই নাকি হাপুস হুপুস শব্দ করে খেতে হয়।
একটুও মাটিতে পড়বে না। তখন দেখা যাবে পিঁপড়ে গুলো কেঁদে কেঁদে মরছে। রবি ঠাকুরের এত প্রিয় এই খাবার আমাদেরও ভাললাগত কিন্তু নিয়মটা বড্ড কঠিন ছিল। শব্দ করতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠতাম আর মাটিতে একটু হলেও পড়েই যেত। মায়ের কাছে শোনা ঠাকুরবাড়িতে 'এপ্রিল ফুল' হত। ঠাকুর বাড়ির মেয়েরা খুব নিষ্ঠা ভরে দক্ষতার সাথে যে কোন কাজ করতেন। বাড়ির মেয়েরা সাদা কাপড়ের সন্দেশ বানিয়েছে। থালা ভর্তি সন্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাতে আবার গোলাপ জলের সুগন্ধি। মাঝখানে যে সন্দেশ রাখা আছে তাতে গোলাপ ফুলের পাপড়ি দেওয়া। সেইটি শুধু আসল সন্দেশ। রবি ঠাকুরকে বলা হয়েছিল তিনি প্রথমে এটি তুলে মুখে দেবেন। যথারীতি পরের অংশটিতে হাসি, রাগ, হতবাক নানান অঙ্গভঙ্গিতে ভরা হয়েছিল। আরও শান্তিনিকেতনের নানান গল্প, নিয়ম ইত্যাদি বলতেন আমার মা। এতে হচ্ছিল কি রবি ঠাকুরে দিন দিন আমার মন বসে যাচ্ছে। শান্তিনিকেতনে পড়ার সাধ হল। মা বললেন অনেক দূর! একা একা থাকতে হবে। বড় হও তখন পারবে । মনের শান্তি, প্রাণের আরাম হয়নি আমার। শান্তিনিকেতন সত্যিই অনেক দূরেই রয়ে গেল। আমাদের ঘুম পাড়াতেন “দিনের আলো নিবে এল,…” বলে, আমরা এটা খুব শুনতে চাইতাম। মায়ের কাছে বিচিত্র সাধ শুনে আমাদের খেলা ছিল ফেরিওয়ালা সাজা, পুরোন লণ্ঠন নিয়ে মাথায় পাগড়ি পরে পাহারাওয়ালা সাজা । মাস্টার- বাবু হওয়ার বিড়ম্বনা ছিল। মনে হত রবি ঠাকুরের বেড়াল-ছানাটি অনেক বাধ্য। তাই খেলার মজা নিতে ভাইবোনেরাই এক একবার বিড়াল সাজতাম, আবার কানাই মাষ্টার সাজতাম। মা হয়ত সেলাই বা কাজ করছেন সেখানে গিয়ে বেড়ালের নামে নালিশ জানাতাম। আজ ভাবি মায়ের ধৈর্য ও উৎসাহের কথা। আমার দাদু মাঝে মাঝে সাইকেল নিয়ে দুপুরের দিকে আসতেন, বিশ্রাম করতেন আমাদের বাড়িতে। পরে চলে যেতেন। শুনতাম হাটে গিয়েছিলেন। হাট কি জিজ্ঞেস করাতে রবি ঠাকুরের 'হাট' কবিতাটি এমন সুন্দরভাবে মা বর্ণনা করেছিলেন পরে যখন শিলিগুড়ি শহরে কালীবাড়ি রোড়ের রবিবারের হাট দেখেছি মনে হয়েছিল এ তো আমার চেনা। কিন্তু গরুর গাড়ি তো পাইনি। মা বলেছিলেন আজকাল গরুরগাড়ীর বদলে ‘হাটবাস' চলে। তাড়াতাড়ি যাওয়া আসা যায়। মায়ের কাছে রাজার বাড়ির গল্প শোনা তো একটা নেশা ছিল। কিন্তু দুঃখের কথা ছিল তুলসী গাছের টবের পাশে কিছুই দেখতে পেতাম না। শুনেছিলাম কাবুলিওয়ালার গল্প । আমাদের মনের গভীরে মিনি আর কাবুলিয়ালার কথোপকথন চলত। এর পরে 'জীবনস্মৃতি' থেকে মা পড়ে শোনাতেন। শ্যাম চাকরের ওপর খুব রাগ হয়েছিল। ভালো লেগেছিল তাঁর বাবার সাথে শান্তিনিকেতন বেড়ানো, হিমালয়ে বেড়ানো। কত স্বাধীনতা দিয়েছিলেন তাঁর বাবা । এই রবি প্রেম বোধ হয় পূর্ণতা পেল স্কুলের প্রোগ্রামে ‘চণ্ডালিকা' নৃত্যনাট্যের রিহার্সাল দেখতাম। প্রতিদিন দেখতে দেখতে নাচ গান আমার সবই মুখস্হ হয়ে গেল। আজ মনে হয় শুধু ফুল কেন? আমি নিজেও সেদিন ধন্য হয়েছিলাম।
আজকাল তো রবি ঠাকুরের আটপৌরের প্রতি ভালোবাসা মুগ্ধ করে আমায়। রবি ঠাকুরের ইচ্ছেতেই আমি রচনা করি আমার অঙ্গসজ্জা, গৃহসজ্জা, ফুলবাগান আরও কত কি! আমার যা কিছু তা তোমারই সুরে ছন্দে গাঁথা রবি ঠাকুর! সবাই যখন বলে “সে গেল কোথায় ?" তুমি বলেছিলে “মুঠোয় করে ধরবার জন্য সে নয়। তার অসাজানো আটপহুরে পরিচয়কে অনাসক্ত হয়ে মানবার জন্য তার আপন স্হানে।” এখানেই তোমার সৌন্দর্যে তুমিই তুলনীয়। প্রণাম তোমায়! “নয়ন মম করিছে ছলো ছলো । হিয়ার মাঝে কি কথা তুমি বলো?"
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴