পরশ/দেবব্রত সান্যাল
পরশ
দেবব্রত সান্যাল
এই এক হয়েছে! প্রতি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় এই একই কেত্তন! স্পেশ্যাল অর্ডার দিয়ে বানানো আট বাই সাতের বিছানা, তাতেও তিনজনের জন্য জায়গা কম পড়ে!
মেয়ে বাবলিকে নিয়ে বর্ণা আগেই বিছানায় চলে যায়। প্রায় এগারো বছর হতে চলল কিন্তু এখনও মেয়ে একা ঘুমাতে শিখলো না! প্রতিদিন ঘুমানোর সময় মাকে চাই! আর মেয়েকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে প্রতিদিনই মা-ও ঘুমিয়ে কাদা! সব সেরে চঞ্চল বিছানায় আসে খানিক বাদে। আর এসেই প্রতিদিন ওই এক কেত্তন, মা- মেয়ে মিলে প্রায় পুরোটা বিছানা দখল করে ঘুমাচ্ছে! মা- বেটি শোয়, তাদের দু'টো ঢাউস কোলবালিশ শোয়, আর তারপরেও জায়গা থাকলে তখন চঞ্চলের শোয়ার ভাবনা!
বিছানার একপাশে মেয়ে, মাঝখানে মা আর অন্যপাশে প্রায় বিন্দুর মতো জায়গা নিয়ে চঞ্চল! হ্যাঁ, ঠিক বিন্দুর মতোই অবস্থা, যার অস্তিত্ব আছে কিন্তু দৈর্ঘ্য- প্রস্থে অবস্থান বর্ণনা করা মুস্কিল! আর এখন তো বিছানার প্রায় পচাঁশি শতাংশ দু'জনার কব্জায়!
যাও বা অনুরোধ- উপরোধে বর্ণাকে সামান্য সরানো গেল কিন্তু চঞ্চলের ভাগ্যে আজ আর ঘুম নেই বলেই মনে হচ্ছে। বর্ণার এই এক অতি কুঅভ্যাস- ঘুমের ঘোরে প্রায়শই গায়ে পা তুলে দেয়! সামান্য চোখ লেগে এলেই অনেকটা ওই পুরানো গ্রামাফোনের ডিস্কের উপর পিন এসে পড়ার মতো করে চঞ্চলের গায়ে ঘুমন্ত বর্ণার পা এসে পড়ছে আর ঘুমের দফারফা! ইতিমধ্যেই তিনবার একই কান্ড হলো! সারা দিনের ক্লান্ত, অবসন্ন শরীরে এবার বিরক্ত লাগছে।
তবে একযুগেরও বেশী বিবাহিত জীবনের অভিজ্ঞতায় জানে যে বিবাহত পুরুষদের রাগ করতে নেই! নামে চঞ্চল হলেও কান্ডজ্ঞানে অচঞ্চলই থাকতে হবে আর এবার মা- মেয়েকে একটু ডানে- বাঁয়ে সেটিং করে নিজের জন্য জায়গা বানিয়ে ঘুমানোর ব্যবস্থা করতে হবে। নাইট বাল্বের আলোয় সবটা ঠিকঠাক বোঝা যাচ্ছেনা। বাধ্য হয়েই চঞ্চল টর্চ জ্বালালো।
বাঁ কাত হয়ে শোওয়া মেয়ের মাথা বালিশের ঠিক নীচে পড়ে আছে, বাঁ হাত বুকের নীচে চাপা আর ডানহাত উল্টিয়ে পিঠের উপর! অনেকটা যেন ইংরেজির এস- এর মতো অবস্থা! মা চিত হয়ে ঘুমোচ্ছেন কিন্তু তেনার পদযুগল স্ট্রেচিং করার মতো দু'দিকে বিস্তৃত! আর দু'জনারই কোলবালিশ দ্বয় চঞ্চলের জন্য বরাদ্দ জায়গা দখল করে আছে! প্রথমেই এদিকওদিক করে কন্যাকে ঠিক করে শুইয়ে দিল। বাচ্চাটা একটু আরামে ঘুমোক। এবার ঠ্যালা গুঁতো করে ইস্তিরি দেবীকে লাইনে আনতে হবে! সে উদ্দেশ্যে বর্ণার হাত ধরতেই এই মাঝরাতে, হঠাৎই, অকারণে প্রায় ২১ বছর আগের কথা আচমকাই চঞ্চলের মনে পড়ে গেলো!
আজ বিরক্তিতে, অবলীলায়, কিছুটা অবহেলায় বর্ণাকে ঠেলে সরাতে ওর হাত ধরেছে কিন্তু একদিন, সেই ছাত্রাবস্থায় বা চাকরি পাওয়ার আগে এক পলকের তরে ওর হাত স্পর্শ করার জন্য অনেক কসরত করতে হয়েছে! ভালোবাসা যথাযথ পরিণতি পেলে এমনই হয়ে যায় নাকি!
মা, মেয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। খুব সাবধানে টর্চটা আরও একবার জ্বালিয়ে চঞ্চল দু'জনাকে দেখে নিল। অনেকে বলে মেয়ে নাকি বাপের মতো দেখতে, আবার অনেকেই বলেন যে মেয়ে মায়ের মতোই হয়েছে। আজ, এই মুহূর্তে ঘুমন্ত মাকে দেখে তো মেয়ের মতোই মনে হচ্ছে! বাস্তবে দু'জনার মধ্যে খুব বেশী অমিল চঞ্চল দেখতে পাচ্ছেনা! অতি সাবধানে মা- মেয়ের মাঝে এসে সে আলতো করে দু'জনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴