পথের সন্ধান
পথের সন্ধান
অতনু চন্দ
---------------
“স্যার, আপনাকে অনেকদিন থেকেই বলছি চলুন একবার আমার গুরুজীর সঙ্গে দেখা করে আসি। এরপর হয়তো আর সুযোগ হবে না!”
Companyর Executive Engineer, অশেষ রায় তার বস্ General Manager নবারুণ ব্যানার্জীর Office Chamber-এ বসে একথা বললেন।
নবারুন ব্যানার্জী পশ্চিমবঙ্গের মানুষ কিন্ত চাকুরীর সুত্রে হরিদ্বারের, রানীপুর অঞ্চলে BHEL জয়েন করেছিলেন। Engineering পাশ করার পর তাও অনেকদিন হ'ল। মিঃ ব্যানাজী ছোট থেকেই বিজ্ঞানের ভাল ছাত্র, তাই অনুসন্ধানী মন নিয়ে তিনি সব কিছুর গভীরে গিয়ে দেখতে পছন্দ করেন। তবে আধ্যাত্মিক জীবন সম্পর্কে তার তেমন কোন কৌতুহল কোন দিনই ছিল না!
হরিদ্বারে থাকা কালিন ছুটি দিনে হরকিপ্যারী/ব্রহ্মকুন্ডতে সপরিবারে গিয়ে ঘাটে বসে থেকে সময় কাটান,সন্ধ্যা আরতি দেখেন তারপর ওখানকার বিখ্যাত 'মালাই কুলপি' খেয়ে কম্পানির ফ্ল্যাটে ফেরেন, মোটামুটি এটাই রুটিন। তবে কখনও চন্ডী মন্দির বা রোপওয়ে করে মনোসা মন্দিরেও যান সময় কাটাতে। এছাড়া ঋষিকেশ,লছমনঝোলা তো আছেই। এভাবেই কবে কখন যে নবারুণ ব্যানার্জী আধ্যাত্মিক জীবনের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন তা তিনি নিজেই জানতেন না।
তাই হয়ত অশেষ রায়কে দিয়ে ইতিমধ্যে বেদ উপনিষদের খন্ড গুলি সংগ্রহ করে গভীর ভাবে পড়া হয়ে গেছে তার। আর সে কারনেই অশেষ রায় ওনার Boss এর এই আগ্রহ বা কৌতুহল বেশ ভাল ভাবে উপভোগ করছিলেন। এর আগেও ব্যানার্জী সাহেবকে উনি কয়েক জায়গায় নিয়ে গেছেন আধ্যাত্মিক জগতের কিছু সুক্ষ প্রশ্নের ব্যাখা শোনার জন্য কিন্তু ব্যানাজী সাহেব যে তার প্রশ্নের উত্তর পাননি বা তৃপ্ত হননি সেটা বলাই বাহুল্য!
সে বিষয়ে লক্ষ্য রেখেই অশেষ রায় বললেন, “চলুন না স্যার আবার একদিন আমার গুরুজীর সাথে দেখা করে আশীর্বাদ নিয়ে আসি,দেখবেন এবার আপনার ভালো লাগবে।”
মিঃ ব্যানার্জী অফিসের দরকারি কাগজে চোখ বোলাতে ব্যস্ত তাই চোখ না তুলেই বললেন, "হ্যাঁ এবারে কোথায় যেতে হবে বলুন?"
প্রতি উত্তরে মিঃ বিশ্বাস উৎসাহী হয়ে বললেন, “কেন স্যার আমাদের চেনা সেই পাহাড়ের পাকদন্ডী পথ ধরেই যাব, তবে অনেকটা উপরের দিকে উঠতে হবে তাই বাইক নিয়ে যাওয়াটাই ভালো।”
অবশেষ একদিন ছুটির দিন দেখে দু'জনে সকাল বেলা বাইক নিয়ে রওনা হলেন পাহাড়ের পথে। একটানা তিন ঘন্টা অশেষ রায় বাইক চালালেন আর পেছনে নবারুণ ব্যানার্জী বসে রইলেন পথের দিকে চেয়ে…
শেষে বিরক্ত হয়ে জানতে চাইলেন, “আর কত দূর বলুনতো! এ যে দুপুর হয়ে এল।”
উত্তরে অশেষ রায় বললেন, “এই তো প্রায় এসে গেছি স্যার, এখন কোথাও বাইকটাকে রেখে shortcut করব তাই কিছুটা খাড়া ভাবে পাহাড়ে উঠতে হবে স্যার।”
“Shortcut করার জন্য পাহাড়ের খাঁড়া পথ এভাবে বাইতে হবে জানলে আমি আসতাম না,”পাহাড়ে উঠতে উঠতে বিরক্ত হয়ে বলেন ব্যানার্জী সাহেব।
কিন্ত কিছুটা উঠতেই হঠাৎ পাহাড়ের আবহাওয়ার আমূল পরিবর্তন হয়ে গেল। আকাশ কালো করে চারদিক থেকে দমকা বাতাস ধেয়ে আসতে লাগল বজ্র-বিদ্যুৎ সহ বৃষ্টি আরম্ভ হলো! পাহাড়ের বিপজ্জনক খাঁজে কোন রকমে গাছের ডাল ধরে দু'জনে দু'জনকে কোন রকমে রক্ষা করতে লাগলেন।
কিন্তু কি আশ্চর্য ঝড় বৃষ্টি যেন হঠাৎই থেমে গেল! মনে হলো যেন কোন এক অদৃশ্য শক্তির যাদু মন্ত্রেই সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে গেল!
আর তখনই দেবদূতের মত গুরুজীর একজন চেনা শিষ্যকে দেখতে পেয়ে অশেষ রায় আশ্বস্ত হয়ে জিগ্গ্যেস করলেন, “ভাই গুরুজী এখন কোথায় আছেন?”
একথা শুনে শিষ্য বললেন, এখনতো আপনারা গুরুজীর কাছে যেতে পারবেন না। গুরুজী এখন তুলসী শুদ্ধি করছেন,এরপর বায়ু শুদ্ধি করবেন তারপর নিজের পথে গমন করবেন। তাই উনি ক'দিন আগে সেচ্ছা সেবকদের বলেদিয়েছেন ওনার কাছে কাউকে যেতে না দিতে।
মিঃ রায় অনেক বুঝিয়ে কোন রকমে শিষ্যকে ম্যানেজ করে দু'জনে অরো একটু চড়াইয়ে উঠে গিয়ে দেখেন অল্প একটু সমতল ভুমিতে বাঁশের মাচায় অল্প, প্রায় বস্ত্রহীন অবস্থায়, কঙ্কালসার গুরুজী চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন।
ওনার কপালে, চোখের পাতায়, কানে ও বুকে তুলসীপাতা দেওয়া আছে। আর গুরুজীকে ঘিরে রয়েছেন পাঁচ/ছয় জন শিষ্য। ওনাদের প্রত্যেকের হাতেই গঙ্গা জলের শিশি।
কাল বিলম্ব না করে অশেষ রায় গুরুজীর পায়ের কাছে বসে, পা হাতাতে হাতাতে বলতে লাগলেন, “গুরুজী আমরা আপনার আশীর্বাদ নিতে এসেছি। আমাদের আশীর্বাদ দিন,পথ দেখান গুরুজী।”
গুরুজী কিছুক্ষন নিঃশব্দে থাকার পর ধিরে ধিরে চোখ খুলে ক্ষীণ কন্ঠে তাঁর নিজেশ্ব ভাষায় বলতে লাগলেন, “তোমরা আমার কাছে বারবার আশীর্বাদ নিতে কেন আস? আমি আশীর্বাদ দেওয়ার, পথ দেখানোর কে? আমার নিজের মুক্তির জন্য আমি সাধনা করে যাচ্ছি।”
বললেন, “বরং আমিই তো সর্বশক্তিময় সৃষ্টিকর্তার কাছে আশীর্বাদ,পথের সন্ধানে মুক্তির প্রতিক্ষায় প্রতিনিয়ত তপস্যা করে চলেছি।” আরো বলতে থাকলেন খুব অস্পষ্ট সুরে, "আমিতো এখানে বিভুতি বিতরন করতে সাধনা করছি না তাই আমার ভক্তদের এখন আমার কাছে আসতে নিষেধ করেছি। কারন আমার কাছে আসতে গিয়ে কেউ যদি বিপদে পরে তখন আমাকে সাধনার মার্গ থেকে কয়েক ধাপ নেমে এসে তাদের রক্ষা করতে হয়। মনটা তাই ওদিকে পরে থাকে এবং তাতে আমার অর্জিত শক্তি খরচ হয়। এতে আমার সাধনা আরো দীর্ঘতর হতে থাকে। আমি এখন আর এটা চাই না, আমার এতে প্রচন্ড কষ্ট হয়। আমি এখন মহাপ্রস্থানের পথে যাত্রা করব সেটাই আমার এক মাত্র লক্ষ্য ও সাধনা,সেটাই আমার আনন্দ ও মুক্তির পথ কারন আমি সন্ন্যসী। কিন্ত তোমরাতো গৃহী, তাই সংসারধর্মই তোমাদের আনন্দ এবং মুক্তির পথ। তোমরা সেটাই মনদিয়ে সৎনিষ্ট ভাবে করো। সর্বশক্তিমান ঈশ্বরই তোমাদের জীবন ও মুক্তির পথ দেখাবেন। তাই হয়ত আমাদের চাহিদা এক কিন্ত পথ ভিন্ন।”
এই কথা বলতে বলতে গুরুজী ভবসাগরের সাধনায় নিমজ্জিত হয়ে গেলেন নিমেষে!
মিঃ রায় ও ব্যানার্জী সাহেব গুরুজীকে প্রনাম জানিয়ে আস্তে আস্তে পাহাড় থেকে নেমে এসে বাইক নিয়ে অন্ধকারের মধ্যে চেনা পথে ফিরতে থাকলেন। হেডলাইটের আলোতে নিঃস্তব্ধ অচেনা পথও যেন খুব উজ্জ্বল হয়ে ধরা দিল, দু'জনেই কোন কথা না বলে তা দেখতে দেখতেই ফিরে চললেন তাদের জীবন স্রোতের দিকে…!
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴