নীল পাহাড়ের দেশে/জয়িতা সরকার
নীল পাহাড়ের দেশে
জয়িতা সরকার
-------------------------
আমার শহরের এক পরিবর্তনীয় পরিবেশচিত্র। ফোন করলেই শুনতে হচ্ছে আর পারছি না। সূর্য যেন তার সমস্ত শক্তি প্রদর্শনের খেলায় নেমেছে। এই অস্বস্তি থেকে পরিত্রাণ পেতে মন বলছে ছুটে যাই ওই পাহাড়ের কাছে। কিন্তু সেখানেও নাকি রেহাই মিলছে না, চেনা ছন্দ হারিয়ে ফ্যান ঘুরছে পাহাড়ি হোম-স্টে গুলোতে। আর মানুষের ভিড়ে থিকথিক করছে দার্জিলিং-এর ম্যাল থেকে অনামি যে কোন পাহাড়ি গ্রাম। এই উষ্ণ বাতাসে একমুঠো শীতল বাতাস পেতে তবে কোনো এক পাহাড়ে বেড়ানোর গল্পেই স্বস্তি খুঁজি আমরা।
উত্তরের নয়, দক্ষিণের পাহাড়ের শীতলতা আর সৌন্দর্য্য চাক্ষুষ করতে বেরিয়ে পড়েছিলাম বইয়ের পাতায় পরিচিত পাহাড় নীলগিরির উদ্দ্যেশ্যে। ব্যাঙ্গালোরবাসী হওয়ার সুবাদে গরমের জেহাদে নাস্তানাবুদ হতে হয় না যদিও, কিন্তু এবার এখানেও সূর্য বেশ দাপুটে মনোভাব নিয়েই আছে। সূর্যের এই বাড়বাড়ন্ত থেকে মুক্তি পেতে নীলগিরিমুখো হয়নি, শীতের সময়ে উপভোগ করে আসা হিমবাতাসের স্মৃতিচারণে এক টুকরো স্বস্তি খুঁজছি।
স্কুল জীবনে ভূগোল বইয়ের পাতায় প্রায় প্রতি ক্লাসেই নীলগিরি-র নাম উঠে এসেছে। ম্যাপ পয়েন্টিং হোক কিংবা দক্ষিণের পাহাড় পরিচিতি সবেতেই এর ছিল অবাধ বিচরণ। প্রথম থেকেই এই পাহাড়ের নাম নিয়ে একটা আগ্রহ ছিল, পরে জানতে পেরেছিলাম, নীলাকুরুণ্জি নামে পাহাড়ের ঢালে এক ফুল ফোটে, আর তাতেই নাকি নীল রুপ নেয় দক্ষিণের এই অঞ্চলটি, সেখান থেকেই নীলগিরি পাহাড়ের নামকরণ। ফুলের কথা যখন বলাই হল, তখন এটাও বলি বারো বছর পরপর এই ফুল ফোটে। আর সেই সময় পাহাড় জুড়ে থাকে পর্যটকের ভিড়। তবে শুধু নীলগিরি নয়, কর্ণাটকের পাহাড়ি অঞ্চলে, কেরালার আনাইমুদি সহ অন্যান্য পাহাড়ে এই নীল ফুলের দেখা মেলে বারো বছর অন্তর। তবে সামান্য পরিমাণে প্রায় প্রতি বছরই দক্ষিণের কোথাও না কোথাও এদের দেখা মিলবে।
নামকরণের সার্থকতা তো অবশ্যই আছে, যদিও সেই ফুলের সাক্ষী আমরা হতে পারিনি, তবে পাহাড় জুড়ে একটা নীলাভ বিষয় খেয়াল করেছি। নীলগিরি দেখতে হলে যেতে হবে দক্ষিণের বহুল পরিচিত জায়গা উটি। আমরাও চললাম উটির দিকে। প্রায় মাঝ রাতেই বেড়িয়ে পড়া, আসলে উদ্দ্যেশ্য ছিল ভোর ভোর বান্দিপুর জঙ্গলের রাস্তায় পৌঁছনো। সেই হিসেব কষেই রওনা দিলাম আমরা। ব্যাঙ্গালোর-মাইসোর এক্সপ্রেসওয়ে তখনও আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের অপেক্ষায় , তবে গাড়ি চলাচল শুরু হয়ে গিয়েছে। আমরাও ছুটছি, ভোরের আলো ফুটছে, প্রায় মাইসোর শহরের কাছে, কিন্তু মূল শহরে না ঢুকে আমরা ডানদিকের রাস্তা নেব, তার আগে চা-বিরতি।
বাইরে হালকা শীতের হাওয়া, চায়ের উষ্ণতায় কিছুটা আরাম মিলেছে, এবার চলছি জঙ্গলের পথে, বান্দিপুর টাইগার রিজার্ভ এর ভেতর দিয়ে সুন্দর পিচ কালো রাস্তা। বড় গাড়ির বেশ লম্বা পড়েছে, সন্ধ্যের পর থেকে ভোর ছ'টা পযর্ন্ত এই রাস্তা বন্ধ থাকে নিয়ম মেনে। বন্যপ্রাণীদের যেন কোনো অসুবিধে না হয় সে কথা ভেবেই এই ব্যবস্থা। গেট পেড়িয়ে জঙ্গলের পথ ধরতেই দু'পাশে হরিণের পাল। নির্ভয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে ওরা। কিছুদূর এগোতেই প্রায় রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে রয়েছে ময়ূর। দূরে পাহাড়ের হাতছানি, সবটা মিলিয়ে এক সুন্দর সকালের সাক্ষী আমরা। বান্দিপুরের জঙ্গল পেরোতেই ওপারে ওয়েলকাম টু মুদুমালাই টাইগার রিজার্ভ। একই জঙ্গলের একদিকে কর্ণাটক অন্যদিকে তামিলনাড়ু। চেকপোস্টে টিকিট কেটে, নিজেদের পরিচয় বৃত্তান্ত দিয়ে এগিয়ে চলেছি আমরা।
উটি যাওয়ার দুটো রাস্তা রয়েছে, যারা একটু রোমাঞ্চকর পাহাড়ি পথে যেতে ভালোবাসেন তারা অবশ্যই মাসিনাগুড়ির দিক দিয়ে উটি যাবেন, এই পথে 36 টি হেয়ার পিন বেন্ড পড়বে। কিন্তু আমরা ওই খাড়াই পথে না গিয়ে সোজা পথেই রওনা হলাম। খানিকটা যেতেই ইউক্যালিপটাসের বন, আর তার মাঝ দিয়ে নরম সূর্য-এর আলো এসে পড়েছে পাহাড়ি পথে। আমরা এগিয়ে চলেছি। এই পথেই পড়বে পাইন বন, পাইকারা লেক, পাইকারা ফলস। উটি শহর থেকে আমরা 20কিলোমিটার দূরে রয়েছি। সিদ্ধান্ত হল, যাওয়ার পথেই আমরা পাইকারা ফলস দেখব। পার্কিং-এর লম্বা লাইন, ক্যালেন্ডার বলছে ডিসেম্বর মাস, কিন্তু বাইরে বেরোতেই মনে হল এপ্রিল-মে।
কিছুটা ওপরে উঠে এসে ম্যাগি, ইডলি, চা খেয়ে আমরা চললাম ফলসের দিকে। টিকিট কেটে ঢুকে পড়তেই চোখ আটকাল সাদা জলরাশি বেশ ধাপে ধাপে নীচে নেমে আসছে। চারিদিক সবুজে মোড়া, রয়েছে সুন্দর ছোট্ট বাগান। দেখা মিলল ওয়াটার বাফেলো-র। নীলগিরিতে এই প্রাণীটির বেশ আধিপত্য রয়েছে। বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে আমরা চললাম উটি শহরের দিকে। হোটেলে আগে থেকে বুকিং ছিল না আমাদের। তাই দু-চারটে হোটেল খুঁজে আমরা উটি লেকের কাছেই একটা হোটেলে সেইদিনের আস্তানা করলাম।
উটি নিয়ে খুব বেশি উৎসাহ আমার ছিল না কোনদিনই। খুব ঘিঞ্জি একটা পাহাড়ি শহর, প্রাচীনত্ব আছে, তাই হয়ত সবার কাছে বেশ গ্রহণযোগ্য। তবে আমার আসার উদ্দ্যেশ্য ছিল একদম অন্য। আমার মা-এর নীলগিরি ট্রেক বাতিল হয়েছিল কলেজ জীবনে ব্যক্তিগত কারণে। সেই আক্ষেপ মা-এর রয়ে গিয়েছিল, মা-বাবাকে নীলগিরি দেখাতেই আমাদের এই ট্রিপ। উটিতে পা রাখতেই মায়ের মুখের হাসিটা ছিল সব পেয়েছি গোছের। সে যাই হোক, এবার আমরা ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে পড়লাম উটি ভ্রমণে। ভিড় পছন্দ নয়, তাই আগেই বাদ পড়েছে rose garden, botanical garden, আর নীলগিরির বিখ্যাত টয়ট্রেন।
আমরা চললাম দোদাবেত্তা পিক-এর দিকে। উটি থেকে 10কিলোমিটার দূরে বেশ খাড়াই পথ ধরে পৌঁছলাম নীলগিরির সর্বোচ্চ শিখরে। বেশ খানিকটা হেঁটে উঠলাম। ওয়াচ টাওয়ার থেকে একদিকে উটি শহর, অন্যদিকে কুন্নুর, সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। পশ্চিমঘাট পর্বত ঘিরে রয়েছে চারিদিকে। রয়েছে একটা নীল আভা। মা যেন মন-প্রাণ ভরে নীলগিরির বাতাসকে আত্মস্থ করছিল। ফিরতি পথে ঢুকে পড়লাম উটি লেকে। বোটিং করছিল অনেকেই, আমাদের সেসবে মন নেই। এতো ভিড়ে বিকেলটা কেমন হাঁসফাঁস করছিল। মুক্তির খোঁজে কোথায় যাব ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ল এক স্টেশনের কথা।
অবস্থান আর পরিবেশ মিলিয়ে এক নরম বিকেলে ভালবাসার গল্প লেখা রয়েছে এই স্টেশনে। জীবনের রেলগাড়ির এমন ভালবাসা মাখা একটা স্টেশন অবশ্যই দরকার। পাহাড়ের মাঝে ছোট্ট স্টেশন, রেলের পথ এঁকেবেঁকে চলেছে। নিঃঝুম, নিস্তব্ধতায় মোড়া সেই বিকেলের lovedale আমার উটি ভ্রমণের সেরা জায়গা। শহর থেকে 5কিলোমিটার দূরে নীরবে দাঁড়িয়ে ছোট্ট এক স্টেশন। উটি থেকে কুন্নুর টয়ট্রেনের পথে দেখা মিলবে এর। তবে ট্রেনে চেপে ভিড়ের মাঝে এর নীরব সৌন্দর্য্য হয়ত তেমনটা উপভোগ করা যাবে না।
রাত বাড়ছে ঠাণ্ডাও বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে, খেতে বেড়িয়ে বুঝলাম দক্ষিণের পাহাড়েও ঠান্ডার দাপট রয়েছে। খাওয়া দাওয়া সেরে লেপ কম্বল মুড়িয়ে সারাদিনের ক্লান্তির পর শান্তির ঘুম। ভোর হতেই আবার তৈরি হলাম, বেড়িয়ে পড়লাম কুন্নুর-এর উদ্দ্যেশ্যে। প্রথমেই সিম পার্ক। যখন আমরা পৌঁছেছি সবেমাত্র পার্কের গেটের তালা খোলা হয়েছে। আসলে সকাল সকাল যাওয়ার কারণ ছিল, পাখি দেখার উদ্দ্যেশ্যে। বেশ সুন্দর সাজানো গোছানো পার্ক, বাহারি ফুল থেকে পাতা বাহার গাছ সঙ্গে পাখিদের কিচিরমিচির। প্রায় দু'ঘন্টা পার্কে কাটিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম চা-বাগান দেখতে। উটি থেকে কুন্নুর বেশ গোছানো লেগেছে আমার। সবুজ গালিচা আর মেঘের রাশিতে এক মোহময়ী সকাল। কুন্নুরেও বেশকিছু দেখার জায়গা রয়েছে, তবে আগেই বলেছি ভিড়টা খুব বেশি ভাল লাগে না। তাই কুন্নুর ছাড়িয়ে আমরা চললাম আজকের রাত্রিবাসের ঠিকানা কোটাগিরি। নীলগিরি রেঞ্জের এই ছোট্ট জায়গাটি বিখ্যাত হয়েছে চা বাগান-ফলস-পাখি আর নির্জনতা মিলিয়ে।
চা বাগানের মাঝে ছোট্ট একটা বাড়ি, চারপাশ সবুজে মোড়া, কোথাও যেন কেউ নেই, শুধুই প্রকৃতি। পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ সেরে বেড়িয়ে পড়লাম ক্যাথরিন ফলস-এর দিকে। পাহাড়ের গা বেয়ে জল পড়ছে, পড়ন্ত বিকেলের আলো নেমেছে ঢালে। অপরূপ এক দৃশ্য, ফিরতে না চাইলেও ফিরতে হবে, তবে পথেই পড়ল ভিন্ন প্রজাতির পাখিদের আনাগোনা। দাঁড়িয়ে চলল ছবি তোলা। সন্ধ্যে নামার ঠিক আগে আমরা পৌঁছে গেলাম কিল-কোটাগিরি। দু-পাশে চা বাগানের মাঝ দিয়ে চলছি আমরা, ছোট একটা জনপদ, শুধুমাত্র চা বাগান দেখতেই এই পথে আসা।
রাত নেমেছে পাহাড় জুড়ে, ঠান্ডা লাগছে বেশ। খাবার খেয়ে জলদি শুয়ে পড়া ছাড়া তেমন কিছুই করার নেই। কোটাগিরির সকালটা ছিল একদম অন্যরকম। দূর থেকে ভেসে আসছিল গির্জার ঘণ্টার আওয়াজ, জানলার পর্দা সরাতেই প্রথম রোদের আলো পড়েছে পাহাড়ের কোলে, চা বাগান যেন একটু বেশিই সবুজ হয়ে উঠেছে। সকালের খাবার সেরেই বেড়িয়ে পড়লাম আমরা। আজ বাড়ি ফেরার পালা। কিন্তু কোথাও যেন একটা খামতি থেকে গেল নীলগিরি দর্শনে। হ্যাঁ, অবশ্যই, টোডা-অধ্যায় তো একদমই বাদ থেকে গেল। নীলগিরির এই উপজাতিদের কথা কতবার পড়েছি। ফিরতি পথে গুগল ম্যাপের সাহায্য নিয়ে পৌঁছে গেলাম টোডা টেম্পলে। উটি থেকে মাইসোরের পথে এদের একটা গ্রাম রয়েছে, এছাড়া নীলগিরি জুড়েই এরা রয়েছে এবং অনেক মন্দিরও রয়েছে।
সেখানে পৌঁছে জানতে পারলাম, এই মন্দির নাকি বহু পুরনো। আর এখানে মেয়েদের প্রবেশ নিষেধ। প্রাচীনতায় মোড়া এই টেম্পলের চারিদিক পাথর দিয়ে ঘেরা। কুঁড়ে ঘরের মত দেখতে মন্দিরে রয়েছে ছোট কাঠের দরজা। মন্দিরের দেওয়ালে রয়েছে সূর্য-চাঁদ-মহিষের ছবি। চেনা মন্দিরের ছবি থেকে টোডা উপজাতির এই প্রার্থনা গৃহ সম্পূর্ণ ভিন্ন। উটি শহরের বিভিন্ন জায়গায় টোডাদের এই স্থাপত্য-এর চিহ্ন পাওয়া যায়। তবে আমরা যেখানে পৌঁছেছিলাম, সেটা ছিল ছোট্ট একটা জনপদ, জঙ্গলে মোড়া। খুব বেশি পর্যটক ওই পথে যায় না, সেটা স্থানীয় মানুষরাই জানালো। এবার ফেরার পালা। ফিরতি পথে কিছুটা সময় পাইন বনে কাটালাম, পথে একটু বাজার সেরে নেওয়া হল, বিখ্যাত উটি গাজর, বাঁধাকপি ব্যাগে পুড়ে ভিড় শহরের দিকে ছুটলাম আমরা।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴