নীরব বলিদান ভাস্বতী/শ্যামচৌধূরী
নীরব বলিদান
ভাস্বতী শ্যামচৌধূরী
দুর্গাপুজো শেষ, মৃন্ময়ী মায়ের বিসর্জনও হয়ে গেল। এবারের পুজোতে মনে কোন আনন্দ ছিল না। উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা হয়নি শহরবাসী। কেবল পুজো হয়েছে। কারণ মৃন্ময়ী মা আসার আগেই চিন্ময়ী মায়ের বিসর্জন হয়ে গেছে। কর্মরত এক তরুণী ডাক্তারকে তার কাজের জায়গায় সন্মানহানী করে, নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে । পৃথিবীর ইতিহাসে এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা। । সমগ্র পৃথিবী প্রতিবাদ জানিয়েছে। । জুনিয়ার ডাক্তাররা আন্দোলন করছে বিচারের জন্য। তাদের সঙ্গে সমস্ত সাধারণ মানুষেরা যোগ দিয়েছে। এটা কোন রাজনৈতিক আন্দোলন নয়, এটা জনগণের আন্দোলন। জানিনা বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদবে কিনা?
এতসবের পরেও ধর্ষণ করে খুনের ঘটনা হয়েই চলেছে। নয়- দশ বছরের মেয়ে থেকে শুরু করে বয়স্ক মহিলারাও ছাড় পাচ্ছে না। এমন একটা সময় এসেছে মেয়েদের কোন নিরাপত্তাই নেই। আমরা ভুলতে বসেছি যে আমরা একটা সভ্য দেশের নাগরিক। এদিকে নারীরা সমস্ত দিক থেকে পুরুষদের সমকক্ষ হয়ে উঠেছে। মহাকাশেও যাচ্ছে,এরোপ্লেনও চালাচ্ছে ,বৈজ্ঞানিকহচ্ছে, ,কলেজ ,বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছে,ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছে। তবু তাদের নিরাপত্তা নেই। এক শ্রেণির কুরুচিকর পুরুষেরা নারীকে ভোগ্যবস্তু হিসেবেই মনে করে।
এই প্রসঙ্গে আমার দেখা একটা সত্য ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে । আমি কলকাতায় যাদবপুরে থাকি,এখানে প্রতিদিন দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে., ট্রেনে করে বহু মেয়েরা কাজের জন্য কলকাতায় আসে, তারা অনেকেই, যাদবপুর, ঢাকুরিয়া, বাঘাযতীনে নেমে লোকের বাড়ি পরিচারিকার কাজ করে ।
তাদের ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা বাড়িতে থাকে, কেউ কেউ স্কুলে যায়, কেউবা বাড়িতে ছোট ছোট ভাই বোনদের সামলায়। এরকমই একটা মেয়ে ছিল সুজাতা। ওর মা আমাদের বাড়িতে কাজ করত। সুজাতা খুব ভালো মেয়ে, ও ক্লাস নাইনে পড়ত, মাঝে মাঝে মায়ের সাথে আমার বাড়িতে আসত। শান্ত স্বভাবের মেয়েটা খুব মন দিয়ে কাজ করতো । আমি ওর সাথে পড়াশোনার আলোচনা করে দেখেছি ও অংক, ইংরেজি, বাংলা,সবেতেই খুব ভালো। আমি বলেছিলাম মন দিয়ে পড়াশোনা কর তুই অনেক বড় হবি। আমি ওর পড়াশোনার দায়িত্ব নেব বলেছিলাম, ও খুব খুশি হয়েছিল।
তারপর অনেকদিন ওর সাথে দেখা হয়নি। ওর মাকে জিজ্ঞাসা করাতে জানতে পারলাম ও বালিগঞ্জে একটা বাড়িতে কাজ করছে । আমি বললাম মেয়েটাকে পড়াশোনা ছাড়িয়ে কাজে দিয়েছো! বলেছিলো কাজ না করলে বিয়ের জন্য পয়সা কোথায় পাবো।শুনে আমার খুব রাগ হল, বলেছিলাম এতোটুকু মেয়ের বিয়ে দেবে? তখন বলেছিল পড়াশোনা করে কি হবে? আমি দেখলাম এদের সঙ্গে কথা বলা বৃথা।
এদিকে সুজাতা যে বাড়িতে কাজ করে, ওখান থেকে ওকে প্রায়ই বাজারে পাঠায়। ও দোকানদারদের সাথে কথা বলে, ওখানে অনেকেই ওর ওপর কুনজর দেয়। এরকমই একটা ছেলে, ও যখন বাজার যায় ওর পেছন পেছন আসে, ভালো ভালো কথা বলে। কিছুদিন বাদে ওকে নানা রকম জিনিস দিতে শুরু করল, সুজাতারও ভালো লাগছিল। একদিন হঠাৎ ওকে একটা মোবাইল ফোন দিল, ফোন পেয়ে সুজাতাতো খুব খুশি। ও ভাবল ছেলেটা ওকে না জানি কত ভালোবাসে। তারপর একদিন সিনেমায় নিয়ে গেল, রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে খাওয়ালো,। সুজাতা তো অভিভূত ,এসব ছেলেরা জানে গ্রামের ছোট ছোট মেয়েদের চুরি করা একটা মোবাইল দিলে,একদিন সিনেমা দেখালে, আর রোল চাউমিন খাওয়ালে, ওরা সহজেই পটে যায়। সুজাতা ভাবছে ছেলেটা ওকে কত ভালোবাসে। তারপর একদিন ওকে কালীঘাটে নিয়ে গিয়ে, মাকে প্রণাম করেই , আচমকা সিঁদুর নিয়ে মেয়েটার মাথায় পরিয়ে দেয়, সুজাতা চমকে ওঠে! ও ভাবতেও পারছিল না কি করবে? হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। বলছিল এটা তুমি কি করলে? আমি তো তোমাকে বিয়ে করব বলিনি, তুমি কেন এটা করলে? তুমি জানো না হিন্দু মেয়েদের সিথিঁতে একবার সিদুর উঠলে, তা আর মোছা যায় না। মুছে ফেলব বলে তো পরাইনি। সুজাতা বলেছিল ও বাড়ি যাবে কেমন করে ? ছেলেটা বলছিলো এখন তোমার বিয়ে হয়ে গেছে তুমি আমার সঙ্গে যাবে। মেয়েটা ভাবল ও বাপের বাড়িতেও যেতে পারবে না এক মুহূর্তে ওর জীবনটা পাল্টে গেল। এক চিমটি সিঁদুরের বোঝা বইতে ওর কষ্ট হচ্ছে। ছেলেটা সিঁদুর পরিয়ে ছাড়পত্র পেয়ে গেল মেয়েটাকে ভোগ করার ।ওর জীবিকা হচ্ছে লেক মার্কেটে মুরগি কাটা। মুরগি বলি দিয়ে ও অভ্যস্ত তাই একটা মেয়ের জীবন বলি দিতে কোন দ্বিধা হয়নি।
এরপর মেয়েটাকে নিজের ডেরায় নিয়ে গিয়ে দুদিন থাকলো মেয়েটা ওর লালসার শিকার হল ।এবার ওকে ওর বাপের বাড়ি নিয়ে গেল। বাবা মা বকাঝকা করলো কিন্তু বাবা মার কাছেই ওকে রেখে চলে গেলো। তখন একবার আমার কাছে এসেছিল। আমাকে সবকিছু খুলে বলেছিল। আমারতো শুনে খুব রাগ হলো। বলে ছিলাম তুই পুলিশের কাছে গেলি না কেন? ১৮ বছর না হলে বিয়ে হয় না তুই থানায় ডায়েরি করলে ওর জেল হত। ও বলেছিল পুলিশের কাছে গেলে ওরা ওকে মেরে ফেলত। আমি বলেছিলাম যা হবার হয়ে গেছে,তুই পড়াশোনাটা ছাড়িস না ও বলেছিল বিয়ে হয়ে গেছে এখন কেমন করে পড়বে ? তারপর শুনলাম ও মা হতে চলেছে। শুনে আমার মাথায় হাত,! ওর মা ওকে জোর করে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিল। ছেলেটা গন্ড গ্রামে ওদের বাড়িতে রেখে এলো ওখানে ওর শ্বাশুরী আর ননদ ওর ওপর অত্যাচার শুরু করে, ওকে খেতে দেয় না, যখন তখন গায়ে হাত দেয়। বলে আমাদের হীরের টুকরো ছেলের জন্য কত সুন্দরী বৌ পেতাম। এভাবে কয়েক মাস চলার পর ও অসুস্থ হয়ে পরে তখন বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। একদিন ওর মা এসে বলেছিল ওর শরীর খুব খারাপ। পরের দিন সকালে ফোন করে জানিয়েছিল, ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। সারাদিন খুব চিন্তায় ছিলাম। সন্ধ্যেবেলা ফোন করে খোজ নিলাম সুজাতা কেমন আছে? যা শুনলাম আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। ওরা জানালো সুজাতা একটা পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়ে মারা গেছে। আমি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছু বলার ক্ষমতা ছিল না। পরের দিন শুনলাম ওর মা হাসপাতালে না নিয়ে গ্রামের হেলথ সেন্টারে নিয়ে গিয়েছিল ওখানকার হাতুড়ে ডাক্তার কিছুই করতে পারেনি।এইভাবে একটা নিষ্পাপ চিন্ময়ী মায়ের বিসর্জন হয়ে গেল কিছুই করতে পারলাম না। মাঝে মাঝে মেয়েটার মুখটা মনে পরে নিজেকে অপরাধী মনে হয় চোখের সামনে এত বড় একটা অন্যায়ের নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করলাম। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন একটা দেশ তখনই উন্নত হতেপারে যখন নারীশিক্ষার
প্রসার হয় এবং তারা সন্মান পায়। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে নারীরা যতই শিক্ষিত হোক না কেন এক শ্রেণির মানুষের কাছে ওরা ভোগ্যবস্ত হয়েই রয়ে গেছে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴