নির্জন এক হারানো সুর : অন্নপূর্ণা দেবী/মাল্যবান মিত্র
নির্জন এক হারানো সুর : অন্নপূর্ণা দেবী
মাল্যবান মিত্র
ভারতবর্ষের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর নাম শ্রীমতি ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনি গান্ধী, শ্রোতা হিসেবে ইন্দিরার পছন্দের রক এন্ড রোল ব্যান্ড বিটলসের অন্যতম সদস্য জর্জ হ্যারিসন ও পৃথিবীর প্রবাদ প্রতিম বেহালা বাদক ইয়েহুদি মেনুহিন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠালেন দুটি অনুরোধ পত্র এবং বক্তব্যস্বরূপ এলো একটি আর্জি, জর্জ হ্যরিসন ও ইয়েহুদি মেনুহিন দুজনেই প্রত্যক্ষ করতে চান একজন ভারতীয় সঙ্গীতগুরুকে এবং শুনতে চান তার সুরবাহার ও সেতার বাজানো। চিঠিতে লেখা নামটি দেখে অস্বস্তি পরলেন ইন্দিরা। ভারতীয় মার্গ সঙ্গীত এর দীর্ঘদিনের শ্রোতা ইন্দিরা জানতেন এটা সম্ভব নয় ; তবু তিনি চিঠি লিখলেন । মাইহার থেকে কোলকাতা, নিউইয়র্ক থেকে সেসময়ের বোম্বে তথা অধুনা মুম্বাইয়ের একটি ঠিকানায় পৌছলো প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার সেই চিঠি। পৌঁছনোর পর, চিঠিটির প্রাপক জানালেন তিনি প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবে সম্মত নন তিনি শুধুমাত্র জর্জ হ্যরিসন ও ইয়েহুদি মেনুহিনকে নিজের বাড়িতে, নিজের রেওয়াজ এ একটিমাত্র দিন উপস্থিত থাকার অনুমতি দিতে পারেন। তবে কিছুতেই ইন্দিরা বা অন্যকোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে তিনি তার সাধনাকক্ষে আসবার অনুমতি দেবেন না। ইন্দিরা এই প্রত্যাক্ষান মেনে নিয়েছিলেন, হয়তো একজন নারী হিসেবে সন্মান দিয়েছিলেন আরেকজন নারীকে,শ্রোতা হিসেবে একজন শিল্পীকে এবং স্বীকৃতিস্বরূপ পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালে পদ্মভূষনে ভূষিত করেন ঐ চিঠির প্রাপককে। সেই চিঠিটির প্রাপকের নামটি হল সেতার সম্রাট নিখিল ব্যানার্জি, বাঁশি বাদক পন্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া, ওস্তাদ বাহাদুর খান, ওস্তাদ আশিষ খান এবং পন্ডিত নিত্যানন্দ হলদিপুরের মতো প্রতিভাবান সঙ্গীতশিল্পীদের গুরু-মা সঙ্গীতগুরু পন্ডিত আলাউদ্দিন খান এর কনিষ্ঠা কন্যা অন্নপূর্না দেবী।
অন্নপূর্ণা দেবী ১৯২৭ সালে ভারতের বর্তমান মধ্যপ্রদেশে মাইহার রাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম রোশেনারা আলী। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান তখন মাইহার মহারাজ ব্রিজনাথ সিংয়ের রাজসভার প্রধান সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। মহারাজ তাঁর নাম রাখেন অন্নপূর্ণা। তাঁর কাকা ফকির আফতাবউদ্দিন খান এবং তাঁর ভাই আলী আকবর খানও ভারতের ইতিহাসের অন্যতম সেরা একজন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই অন্নপূর্ণা দেবীর সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহ ছিল অপরিসীম। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, তাঁর তালিমপ্রাপ্ত বড় বোন জাহানারার বিবাহিত জীবনে সঙ্গীতসাধনার কারণে সমস্যা সৃষ্টির কারণে বাবা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান তাঁকে সঙ্গীতের তালিম দিতে চাননি। তাঁকে গৃহস্থালি কাজেই আবদ্ধ রেখেছিলেন। কিন্তু অন্নপূর্ণা দেবীর সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহ ছিল প্রচন্ড। তাই ছোটবেলা থেকেই লুকিয়ে তাঁর ভাইয়ের তালিম নেওয়া দেখতেন আর সেটি রেওয়াজ করতেন। একদিন তাঁর ভাই রেওয়াজ করছিলেন আর সেটি তিনি শুনছিলেন। একপর্যায়ে তিনি তাঁর ভাইকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “ভাইয়া, বাবা এভাবে না, এভাবে শিখিয়েছিলেন”, বলেই নিখুঁতভাবে তাঁর বাবার সেই তালিম বাজানো শুরু করলেন। সেদিনের ঘটনা নিজের মুখে তিনি এভাবে বর্ণনা করেন, “আমি তখন সঙ্গীতে এতটাই মগ্ন হয়ে গিয়েছিলাম যে, কখন বাবা এসে আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন আমি খেয়ালই করিনি। যখন বুঝতে পারলাম অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু বাবা তখন আমাকে বকার পরিবর্তে আমাকে তাঁর ঘরে ডেকে নিলেন। তিনি সঙ্গীতের প্রতি আমার সত্যিকারের আগ্রহের কথা বুঝতে পেরেছিলেন আর আমর তালিম শুরু হয়ে গেলো।”
তাঁর তালিম শুরু হয়েছিল প্রথমে ধ্রুপদী কণ্ঠসংগীতের মাধ্যমে, পরে তিনি সেতার শেখেন এরপর উস্তাদ আলাউদ্দিন তাঁকে সুরবাহার শেখার কথা বললেন। অন্নপূর্ণা দেবীর কথা অনুযায়ী, “তিনি বললেন, আমি তোমাকে আমার গুরুর বিদ্যা শেখাতে চাই, কারণ তোমার মধ্যে কোনো লোভ নেই। এটা শিখতে হলে অনেক ধৈর্য্য আর শান্ত মন দরকার। আমার মনে হয় তুমি আমার গুরুর এ শিক্ষাটি আয়ত্ত্ব করতে পারবে, কারণ তুমি সঙ্গীত নিঃসার্থ ভাবে ভালোবাসো।” তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় তার সুরবাহার প্রশিক্ষণ। পরবর্তীতে মাইহারে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের কাছে সঙ্গীতের তালিম নিতে আসেন তখনকার বিখ্যাত শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্করের ভাই রবিশঙ্কর। অন্নপূর্ণা দেবীর বয়স তখন তের বছর। দুজনের মধ্যে একটি আকর্ষণের সৃষ্টি হয়। যদিও অন্নপূর্ণা দেবী তাদের বিয়েকে প্রেমের বিয়ে হিসেবে মানতে নারাজ, সম্বন্ধ করেই বিয়ে হয়েছিল বলেন। রবিশঙ্করের বড় ভাই উদয়শঙ্কর তার বাবার কাছে তার ভাইয়ের জন্য অন্নপূর্ণার পাণি-প্রার্থনা করেন। ১৯৪১ সালে তাদের বিয়ে হয়। অনেকেই হয়তো ভেবেছিলেন, এত গুণসম্পন্ন দুজন সঙ্গীতজ্ঞের মধ্যে বিয়ে হয়তো এক অনন্য দাম্পত্যের সৃষ্টি করবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।
অন্নপূর্ণা দেবী একজন অসামান্য প্রতিভাবান সঙ্গীতসাধক ছিলেন। স্বয়ং আলাউদ্দিন খান তাকে মূর্তিমতী মা সরস্বতী বলে ডাকতেন। তাঁকে নিয়ে ওস্তাদ আমির খান একটি বিখ্যাত কথা বলেছিলেন, “অন্নপূর্ণা দেবী ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের ৮০ ভাগ পেয়েছেন, যেখানে আলী আকবর পেয়েছেন ৭০ ভাগ আর রবিশঙ্কর পেয়েছেন ৪০ ভাগ।” তার ভাই আলী আকবরও একথাটির সাথে একমত পোষণ করে বলেন, “অন্নপূর্ণাকে দাঁড়িপাল্লায় একপাশে রেখে অপর পাশে রবিশঙ্কর, পান্নালাল আর আমাকে রাখলেও অন্নপূর্ণার পাল্লাই ভারী হবে।” ইমনকল্যাণ, খামাজ আর কৌশিকি এই তিনটি রাগ অন্নপূর্ণা দেবী ও পন্ডিত রবিশঙ্কর ১৯৪৬ থেকে ১৯৫৬ একসাথে কয়েকটি অনুষ্ঠানে প্রধানত বাজিয়েছিলেন। অন্নপূর্না দেবী বাজাতেন সুরবাহার আর রবিশঙ্কর সেতার। কিন্তু এরপরেই ঘটে ছন্দপতন, অজ্ঞাতকারনে অনুষ্ঠান এমনকি যে কোনো রকমের পাবলিক এপিয়ারেন্স বন্ধ করে দেন অন্নপূর্ণা দেবী ও নিজেকে প্রায় গৃহবন্দী করে ফেলেন। এরপর শুধু একবারই ১৯৬০ সালে কোলকাতার একটি অনুষ্ঠানে তিনি সেতার এ ইমন কল্যান রাগটি বাজিয়েছিলেন। সেটিই তার একমাত্র অনুমোদন প্রাপ্ত রেকর্ড বলে মনে করেন কেউ কেউ। এরপর আর কোনোদিন অন্নপূর্ণা দেবী কোনো অনুষ্ঠান বা রেকর্ড করেননি।
অনেকে বলেন, অন্নপূর্ণা দেবী এবং পন্ডিত রবিশঙ্করের দাম্পত্যজীবনের ঘটনাকে উপজীব্য করেই বিখ্যাত পরিচালক ঋষিকেশ মুখোপাধ্যায় তাঁর “অভিমান” সিনেমাটি তৈরি করেছিলেন। সিনেমাটি বেশ জনপ্রিয়তাও অর্জন করে। ছবিতে দেখা যায়, বিখ্যাত এক গায়কের (অমিতাভ বচ্চন) চেয়ে তার প্রতিভাবান স্ত্রীর (জয়া ভাদুড়ী) জনপ্রিয়তা বেশি হয়ে গেলে তাদের দাম্পত্যজীবনে টানাপোড়েন শুরু হয়। সিনেমার গল্পে তারা সুখী জীবনে ফিরে গেলেও অন্নপূর্ণার প্রথম বিয়ের পরিণতি ছিল বিয়োগান্তক। শোনা যায়, অন্নপূর্ণা দেবী সংসার টিকিয়ে রাখতে জনসমক্ষে আর কখনো সুর পরিবেশন না করার শপথ নিলেও তা আর টেকেনি। অন্নপূর্না দেবী ১৯৯১ সালে নাটক একাডেমি অ্যাওয়ার্ড এবং বিশ্বভারতী থেকে ১৯৯৯ সালে সম্মানজনক দেশিকোত্তম উপাধি দেওয়া হয়। যদিও কোনো সম্মাননা বা কনসার্টে নিমন্ত্রণই তাঁকে তাঁর বদ্ধঘরের বাইরে আনতে পারেনি। অন্নপূর্ণা দেবীর সুর না শুনতে পাওয়ায় বিশ্ববাসীর একটা আফসোস রয়েই গিয়েছে। পন্ডিত রবিশংকর নিজের আত্মকথায় বলেছিলেন “ অন্নপূর্ণার বাজনা অবশ্যই অতি উন্নত স্তরের বাজনা। … লোকের সামনে বাজায় না বলে ওর যেটা তালিম, যেটা শিখেছে, জীবনে সেটা বজায় রাখতে পারে। ঠিক তালিম বাজায়। এবং ভগবানের একটা আশীর্বাদ যেন ওর সংগীতে, সব বড় ঘরের শিল্পীদেরই যেটা আসে না। কিন্তু যাদের আসে তারা তো যেন রক্তের ভেতর সংগীত নিয়েই জন্মায়। যেমন আলি আকবরভাইয়ের কথা ধরো। সেই ভাবটা চিরদিন সেই ছোট থেকেই ছিল।খুব সুরে, খুব মিষ্টি হাত; এবং মেয়ে বলেই যে হয় তা নয়, তবে মহিলাসুলভ একটা নমনীয়তা, কমনীয়তা, রসে-ভরা হাত। এবং বাবার যে অঙ্গটা ও বাজায় সেটা নিখুঁত বাজায়; কারণ লোকজনের সামনে বাজালে মানুষকে যে কমপ্রোমাইজ করতে হয়, সেটা তো ওকে করতে হয়নি। লোককে খুশি করতে হয়নি এটা-ওটা করে। এবং সেটা করেওনি। সেই অসম্ভবটাই ও করতে পেরেছে; সেটা ওর বাজনায় আছেও। ওর সুরবাহারকে যে পিওর, বিশুদ্ধ সুরবাহার বলা হয়, সেটা সত্যি। অন্তত আমি তো তাই বলব।’
কিন্তু এমন প্রতিভাবান সঙ্গীতশিল্পীর সুর দূর্ভাগ্যজনকভাবে হারিয়ে গেছে। তিনি কখনোই তাঁর কোনো গান রেকর্ড করেননি, তবে তাঁর বাজানো ইমন কল্যান রাগ এর একটিমাত্র রেকর্ড আছে এছাড়া অন্নপূর্না দেবী ও রবিশঙ্করের একটি যুগলবন্দী রেকর্ড রয়েছে অনুষ্ঠানে বাইরে রাখা স্পিকার থেকে এই বাদনটি রেকর্ড করা হয়েছিল। অন্নপূর্ণা দেবী চেয়েছিলেন নিজের শিষ্যদের মাধ্যমে বেঁচে থাকতে, সেতার সম্রাট নিখিল ব্যনার্জি, পন্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া প্রমুখদের মাধ্যমে তাঁর সেই আশা পূরণ হয়েছিল বলেই মনে হয়।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴