নিভৃতলোকের এক নারী/বেলা দে
নিভৃতলোকের এক নারী
বেলা দে
নিভৃতলোকে বসে যারা রেখে গেছেন প্রতিশ্রুতির স্বাক্ষর তাদের তিনি উৎসর্গ করেছেন "প্রথম প্রতিশ্রুতি" যে সময় নারী পর্দানশীন, পর্দার আড়ালে ঢাকা আগল খুলে তাদের আলোর জগতে আনতে পেরেছেন রাজা রামমোহন রায়, রোধ করেছেন সতীদাহর মতন কূ-প্রথা আর বিদ্যাসাগর দিয়েছেন বর্ণমালা উপহার, রোধ করেছেন কৌলিন্যপ্রথায় বহুবিবাহ, তালিকাভুক্ত নতুন নতুন শশুরবাড়ি যাওয়া উদ্দেশ্য বছরভর উপঢৌকন সংগ্রহ, নাই বা হল প্রবৃদ্ধর শতাধিক স্ত্রীর সাথে ঘর সংসার। বহির্বিশ্বের ভাঙাগড়ার কাহিনী নিয়ে রচিত হয় ধ্বনিমুখর ইতিহাস, সে ইতিহাস পরবর্তী কালের জন্য সঞ্চিত রাখে প্রেরণা উৎসাহ। সেখান থেকে রংবদল হয় সমাজের, যুগের, সমাজের মানুষের মানসিকতা। এমনি এক নারী প্রথাগত বিদ্যার জন্য অন্দরমহলের বাইরে যেতে পারেনি সংস্কারের চৌকাঠ মাড়িয়ে, বাড়িতে ভাইদের পাঠ শুনে শুনে সঞ্চয় করেছেন জ্ঞান অন্ত:পুরের অন্তরালে বসে রচনা করেছেন যুগান্তকারী ত্রয়ী উপন্যাস "প্রথম প্রতিশ্রুতি (১৯৬৪),সুবর্ণলতা (১৯৬৭), বকুলকথা(১৯৭৪)। আশাপুর্ণা দেবীর অভ্যুদয় বাংলায় এক বিশিষ্ট ঘটনা, তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ক্ষুরধার লেখনি বাঙালির সংসার জীবনের উপরকার মোহজাল ছিন্নভিন্ন করে সত্যিকারের যে রূপ দেখিয়েছেন ইতিপূর্বে কোনো নারী এই অসমসাহসীকতা দেখাতে পারেনি।নারী শুধু সন্তান
তৈরির কারখানা এই ধারণাকে খানখান করে দিয়েছেন, তাঁর সমৃদ্ধ লেখা কঠিন আঘাত করেছে সেকালের অনেক পুরুষ পাঠককে। তাঁর সত্যদৃষ্টির নিকষে টেকেনি প্রায় কোনো আঘাত, তিনি কী শুধু জীবনের অমলিন দিকটাই দেখিয়েছেন তা নয়, তাহলে তাঁর "প্রথম প্রতিশ্রুতি " র সত্যবতী সৃষ্টি ও কল্পনা সম্ভব হত না। সমাজ সংসারের অন্তপুরে যে অভাবনীয় অকল্পনীয় পরিবর্তন ঘটে গেছে বহু অসমসাহসী বীরাঙ্গনার বুকের রক্তই সেটা ঘটিয়েছে, মা সত্যবতী ছিলেন প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিত্বপূর্ণ এক মহিলা, সত্যবতীর বিদ্রোহ ছিল পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে অত্যন্ত দাপুটে প্রতিবাদী আত্মপ্রতিষ্ঠায় তৎপর ছিলেন নারীবাদীর বুনিয়াদ। সত্যর স্বামী নবকুমার এবং শাশুড়ী এলোকেশি মিলে ৯ বছরের সুবর্নকে গৌরীদান করে দিয়েছিল তাকে লুকিয়ে,অথচ নবকুমার কথা দিয়েছিল সুবর্ণকে লেখাপড়া শেখাবে, সে ছোট্ট মেয়েটির মধ্যে সত্য দেখেছিল হীরের খনি।স্বামীর বিশ্বাসঘাতকতার প্রত্যুত্তর দিয়েছে চিরকালের জন্য সংসার ত্যাগ করে।বাংলা সাহিত্যে বিস্ময়কর আবির্ভাব কথাসাহিত্য "প্রথম প্রতিশ্রুতি" বাংলা ভাষাভাষি জনতা চিরকাল এই উপন্যাসখানির জন্য কৃতজ্ঞ ও ঋণী তবু বাংলার ইতিহাসগুলি চিরদিন অন্ত:পুরের ভাঙাগড়ায় উদাসীন, অন্ত:পুরের
প্রথম প্রতিশ্রুতির স্বাক্ষর বহনকারী এই গ্রন্থ অনামী মেয়েদের একজনের জীবন কাহিনী। তুচ্ছ দৈনন্দিন পৃচ্ছপটে আঁকা এই ছবি যদি বহন করে যেতে পারে বিগতকালের ইতিহাস তাতেই আমি খুশি" সেখানেই আমার সার্থকতা। ২৪শে পৌষ ১৩১৫ ইং ৮ই জানুয়ারী ১৯০৯ কলকাতা পটলডাঙায় মামাবাড়িতে তাঁর জন্ম।মাতৃসান্নিধ্যে ছোট থেকেই সাহিত্যে অনুরাগ প্রথম কবিতা দিয়ে শুরু ১৩২৯ সালে "শিশুসাথী" পত্রিকায় প্রকাশিত।
এরপর আর তাকে অপেক্ষা করতে হয়নি প্রথম পুরস্কার পানমাত্র ১৫ বছর বয়সে, ছোটদের বইপ্রকাশ ১৩৪৫ সালে, প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত ১৩৫১ সালে।
শেষ নি:শ্বাস পর্যন্ত কলম তাঁর বিশ্রাম নেয়নি, দেড় হাজার ছোট গল্প আড়াইশোর বেশি উপন্যাস লিখে বাংলা সাহিত্যে নজীর রেখে গেছেন, পেয়েছেন জ্ঞানপীঠ পুরস্কার, লীলা পুরস্কার, রবীন্দ্র পুরস্কার এবং স্বর্ণপদক সহ আরও বহু পুরস্কারে ভুষিত তিনি।প্রতিবাদী নারী লেখিকা অনেকেই উল্লেখযোগ্য তবু বলবো আশাপূর্ণা দেবী বাংলা সাহিত্যে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে, স্যাতস্যাতে বাংলার এই বিদ্রোহিনী নারী আজ সমগ্র নারীজাতির প্রেরণা তাঁর অন্তদৃষ্টি আর প্রবল ইচ্ছেশক্তি থেকে শিক্ষা নিলে আজও প্রচলিত সমাজের নারীজীবনে প্রাত্যহিক অত্যাচার পুরুষের বিরুদ্ধে মুখোমুখি দাঁড়াবার সাহস সঞ্চয় করে, আজ বুঝি বিষন্ন সময়ে তোমার মতো অনমনীয় ব্যক্তিত্বপূর্ণ এবং প্রতিবাদী ধারালো লেখিকার বড়ই প্রয়োজন ছিল কলমের ঝড় আর গলার স্বর সমন্বয়ে সমবেত মিছিলে স্লোগান তুলতে "জাস্টিস ফর আর জি কর।"
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴