নিভৃত প্রাণের দেবতা/সরমা দেবদত্ত
নিভৃত প্রাণের দেবতা
সরমা দেবদত্ত
রাত্রি হল ভোর
আজি মোর
জন্মের -স্মরণ -পূর্ণ বাণী
প্রভাতের রৌদ্রে-লেখা লিপিখানি
হাতে করে আনি
দ্বারে আসি দিল ডাক
পঁচিশে বৈশাখ " (পঁচিশে বৈশাখ ---পুরবী কাব্য গ্রন্থ)
সেই যে কবে পাড়ার মোড়ে চৌকি পেতে তার উপর একটি বিছানার চাদর ঢাকা দিয়ে স্টেজ বানিয়ে তাতে অভিনয় হত ডাকঘর নাটক, কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি, বৃষ্টি পরে টাপুর টুপুর, আলো আমার আলো ওগো-----তখন জানবার তাগিদ ছিল না কেন এসব করছি। শুধু অমলকে কয়েকদিন খুব মনে পড়ত।বাইরে বের হতে পারত না বলে খুব কষ্ট হত। দইওয়ালার সেই লম্বা টেনে টেনে ডাকে মনটা উদাস হয়ে যেত।বড়ো বড়ো দিদিরা কী সুন্দর দু'দিকে বিনুনি দুলিয়ে লালপাড় শাড়ি পরে স্টেজে ওঠানামা করত হারমনিয়াম বাজিয়ে গাইত " আমরা সবাই রাজা"---
সত্যি তখন সবাই রাজা। এ গান কে লিখেছেন কে জানে? কীন্ত ভীষণ মন টানত।দুঃখ একটাই ছিল আমি ছোট বলে কেউ পাত্তা দিত না। শুধু বলতো 'তুই থাম তো পরে শুনব'।আমার মনেও কত প্রশ্ন আনাগোনা করত অমলকে ঘিরে।
তারপর স্কুলে ---বেশ কিছুদিন ধরে রিহার্সাল হত।পরিচিত হলাম "রবীন্দ্র জয়ন্তী " নামের সাথে। ধীরে ধীরে বুঝতে শিখলাম বিশ্ব কবির জন্মদিন পালন---"তুমি কোন সকালে ডাক দিয়েছ কেউ তা জানে না "
রবি ঠাকুরের ছবি ফুল মালা, গান,নাচ,কবিতা ব্যস---
তারপর অনেক দিন গড়িয়ে শৈশব পেড়িয়ে কিশোরী বেলায় পা রাখলাম। শরীর মনের পরিবর্তনের সাথে সাথে অনেক সহজ সরল ভালোলাগা গুলো অকারণে মনকে নাড়া দিতে শুরু করল। যে কথা আগে অনেক বার শুনেছি কিন্তু দোলা লাগল এই প্রথম। শরীর মনে শিহরণ জাগায় কে ---
"নীরব বাঁশরি খানি বেজেছে আবার
প্রিয়ার বারতা বুঝি এসেছে আমার "
তখনও রবীন্দ্রনাথকে চিনিনি।শুধু মনের চাহিদা গুলোকে প্রাধান্য দিতে শিখছি।
একসময় কিশোরী পেরিয়ে যৌবন কখন যেন উদাত্ত কণ্ঠে বিঘোষিত করল----
ভালোবাসার খেলাঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছি তাঁরই পথ ধরে। তিনিই আমার ভালোবাসা প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম
"সখী ভাবনা কাহারে বলে সখী যাতনা কাহারে বলে
তোমরা যে বল দিবস রজনী
ভালোবাসা ভালোবাসা----"
"কেন গো এমন স্বরে বাজে তবে বাঁশি
মধুর সুন্দর রূপে কেঁদে ওঠে হিয়া
রাঙা অধরের কোণে হেরি মধু হাসি
পুলকে যৌবন কেন উঠে বিকশিয়া"
যৌবনের উদ্দমতায় কখন যে বেলা গড়িয়ে সূর্য দেব পশ্চিম দিগন্তে পাটে বসেছেন খেয়াল করিনি। শান্ত স্নিগ্ধ সৌম্য কান্ত প্রৌঢ়ত্ব জীবনের দ্বারপ্রান্তে নীরবে কিছুটা নত মস্তকে এ জীবনের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছেন
তখন রবীন্দ্রনাথ কে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইছি। মনে হচ্ছে তিনি শেষ আশ্রয় কিন্তু তাঁকে বুঝতে পারছি না। শুধু মনে মনে গেয়ে উঠি----
"হে সখা মম হৃদয়ে রহো"
কিন্তু কে সে!
রবীন্দ্র সমুদ্রের অতলে তলিয়ে মুক্তো খুঁজে আনার ব্যর্থ চেষ্টা না করে তাঁর কাছে মুক্তি প্রার্থনা করি
তবু আজীবন জ্ঞানে অজ্ঞানে তাঁকে অনুসরণ করেই কেটে গেল জীবন রঙ্গমঞ্চের সকল পাট।
তাঁর কবিতা গানের মানে খুঁজেও কিছু বুঝি না শুধু বুঝি রবীন্দ্রনাথ আমার শ্বাসে প্রশ্বাসে, শেষ পারানির কড়ি।
রবীন্দ্রনাথ আমার ধ্যানে জ্ঞানে আমার হৃদয়ের দেবতা। তাঁর সঙ্গে হৃদয়ের তারে তারে যে সুর বাঁধা তা যেন কখনো ছিন্ন না হয়----
"আজি প্রণমি তোমারে চলিব নাথ সংসার কাজে
তুমি আমার নয়নে নয়ন রেখ অন্তর মাঝে "---
প্রৌঢ়ত্বের শেষপ্রান্তে এসে দেখি আমার পরিপূর্ণ নারী জীবনের প্রতিটি বাঁকে তাঁর ছোঁয়া। তুমি যেন নির্ভয় হয়ে স্মিত হেসে আমাকে এগিয়ে দিয়েছো অনিশ্চিত আগামীর পথে
" তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুব তারা "
জীবন সমুদ্রে দিশেহারা হলেও আর ভয় রইল না সঙ্গে নিয়ে চলি সেই অভয়বাণী
"যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে
তবে একলা চলো রে"
আমার অন্ধকার জীবনে তুমি একমাত্র আলোর দিশারি।
নিজের হাতে লাগানো বাগানের ফুল গুলি শেষ বসন্তের বীতলগনে যখন পরিস্ফুট হয়ে ওঠে নতুন রবির আলোয় স্নাত হয় ঠিক তখনই চারিদিকে ধূপের ধোঁয়া য় ফুলের সুবাসে মনে জাগে তাঁর কথা। এই আলোই তো আমার রবীন্দ্রনাথ! সকল গ্লানি সকল ক্লান্তি সকল মলিনতা ভুলে আমার অন্তরাত্মা গেয়ে ওঠে
"আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে
দেখতে আমি পাইনি
তোমায় দেখতে আমি পাইনি "
এ-ই তো আমার রবীন্দ্রনাথ! আমার নিভৃত প্রাণের দেবতা। যাঁকে বোঝা যায় না অনুভব করা যায় জীবন দিয়ে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴