নদী কিংবা বাঁশবন/অমিত কুমার দে
নদী কিংবা বাঁশবন
অমিত কুমার দে
ওই রাস্তাটা ধরে অর্ধেক যেতে যেতেই থেমে যেতে হয়। প্রান্তে পৌঁছনো হয় না কোনওদিন। ‘বাবুনদা’ বলে ডাকতে ডাকতে এক গ্লাস জল নিয়ে যে আসছিল, সেও আর আমাকে খুঁজে পায় না। আমিও না।
তার নাম ‘বাচ্চা বুড়ি’ না ‘বড় বুড়ি’ ভুলে গেছি। ধবধবে দুটো ফর্সা পা, একটা রূপোর মল এবং অঢেল সকালি সবুজ ঘাস শুধু মনে পড়ে। এবং ওইসব পায়ের ছাপের ওদিকটায় আমার খেলার মাঠটা ছিল, বাতাবি লেবুর গাছটাও ছিল।হাফ প্যাডেল দিতে দিতে দুলাল বলত “চল পালাই”। ক্যারিয়ারে অনেকগুলো মার্বেল। জামগাছটার আড়াল থেকে হঠাত বেরিয়ে মীনা বলত “বলে দেব কিন্তু!”
আমার যে নিজেকেই অনেক কিছু বলবার বাকি থেকে গেল, মীনা! কিশোরবেলার আগেই তুই হারিয়ে গেলি, কিংবা আমি। পরে একবারই তোকে দেখেছিলাম। তাকাতে পারিনি ভালো করে। কাউকে কীভাবে এত দ্রুত বার্ধক্য ছোঁয়!
আজও রেতি নদীর হাওয়ায় আমার সাদা চুল উড়ছিল। যেভাবে ধর্লার তীরে দাঁড়িয়ে আমার কালো চুল উড়েছিল! দলমণি ডিভিশনে বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে নির্ভেজাল বাতাস গিলতে গিলতে সাধন বছরের শেষ দিনটায় আমায় নদীবৃত্তান্ত বলছিলেন। একটা নদীর চার চারখানা নাম – রেতি, ডিমডিমা, শুখা, কলি। তারপর সে গিয়ে ডুডুয়ায় মেশে। আমারও কি চারখানা নাম ছিল? কিংবা চার পর্ব? তারপর ভাসতে ভাসতে রাজেশ্বরী নামে একটা নদীতে মিশে যাওয়া?
নদী কি সম্পূর্ণভাবে নেয়? নিতে পারে?
আসলে রাস্তাটা ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটা নদীর পাড়েই পৌঁছনো। জল, বালু বা ভাঙন ... কিছু একটা তো থাকবেই!
নিজের নৈ:শব্দে যতটা যাওয়া যায়, ততটাই একা হয়ে পড়া। আমি সেখানে একটা অদ্ভুত নিস্তেজ বাঁশি শুনতে পাই। আর কেমন যেন আবছায়া, এবং অনেকগুলো সুতির শাড়ি! শাড়ির গায়ে একটাই শরীরী গন্ধ। আগে তার নাম ছিল ‘মা’, এখন ‘রাজেশ্বরী’!
নিজের কাছে পৌঁছতে পারাটা খুব সহজ নয় জানি। যাকে বহু অলিগলি পেরিয়ে যেতে হয়েছে সে জানে ফেলে আসা চোরা গলি আবার খুঁজে পাওয়া দুরূহ। মেঘালয়ের পাহাড়ি শহরে বৃষ্টি আর মোরগের সমাহারে একটা কিশোরসন্ধ্যা, জলশহরের নীল নীল নীলাভ দিন, মহালয়ায় এক বিসর্জনের সূচনা, ‘বাবা’ বলে গলা খুলে ডাকবার না-পাওয়া ইচ্ছেগুলো, পিঠের ওপর বসে-যাওয়া কালসিটে দাগসমূহ, কারোর জমিয়ে রাখা পাহাড়প্রমাণ ভুলবোঝার বোঝা – এসব বৈপরীত্যেই নিজের সঙ্গে আকস্মিক দেখা হয়ে যায়।
কবিতা শব্দ গান সব নি:শর্তে উড়িয়ে পুড়িয়ে দিয়ে একা একা হাঁটবার জন্য যার আঙুল ছুঁই, সে তো আমিই!
আজ টোটোপাড়ার ধনীরাম টোটো অকৃত্রিম বাঁশের কথা বলছিলেন। বাঁশের ছায়া, বাঁশের আশ্রয়, বাঁশের আহার, বাঁশের প্রতিরোধ ...। আবার বাঁশ দেবার রূপককথা। শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল এই আমিও তো বাঁশেই ঘেরা। একটা জীবন আমার পড়ে রইল ‘উকিলবুড়োর’ বাঁশের মাচায়। একটা জীবন কেটে গেছে বাঁশের ধারার বেড়ায় হেলান দিয়ে দিয়ে। একটা অলৌকিক জীবন বাঁশঝোপের আলোআঁধারিতে কোনও অলীককে খুঁজতে খুঁজতে। বাঁশের প্রতিরোধ গড়তে পারিনি কোনওদিন। কিন্তু বাঁশের খোঁচা অবধারিত হয়ে আজও ছড়ে দিচ্ছে ভেতর। অনর্গল! শুধু পার্থক্য এখন বাঁশের আঘাতের ওপর একটা দুরন্ত নির্লিপ্তি এসে বসে। উদাস পাখির মতো!
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴