নতুন জামা/জয়িতা সরকার
নতুন জামা
জয়িতা সরকার
অফ হোয়াইট ক্রেক-বাটিক পিউর সিল্কের সঙ্গে গত বছর হস্তশিল্প মেলা থেকে কেনা সাদা-কমলা শিউলি ফুলের গয়নাটা বেশ মানাবে ভাবতে ভাবতেই ফোনে ভেসে উঠল আজকের প্ল্যানের উদ্যোক্তা ইচ্ছের নামটা। ফোনটা রিসিভ করে হ্যালো বলার আগেই নিজ ভঙ্গিতে ওপার থেকে চেঁচিয়ে উঠল, 'নিশ্চয়ই এখনও বিছানা ছাড়তে পারিস নি? আজকেও দেরি করবি তুই? আজই তো শেষদিন, প্লিজ আজ আর লেট করিস না' , প্রত্যুত্তরের তোয়াক্কা না করেই এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে গেল ইচ্ছে। 'না-রে লেট রাইজার হবো এমন সুযোগ এই পুজোর বাজারে হয় নাকি? ভোর থেকেই তো গান বাজছে পাড়ার পুজোতে, ঠিক আছে চল রাখছি এখন, ঠিক একটায় লেবুতলা পার্ক, বাকিরা আসছে তো?' শান্ত স্বভাবের বেদত্রয়ী ওদিক থেকে হ্যা-টা শুনেই ফোন কেটে দিল।
স্নানের জিনিস গুছিয়ে নিয়ে নিজের ঘর থেকে বেড়িয়ে ভাইয়ের ঘরে টেবিলে রাখা ল্যাপটপের দিকে চোখ পড়তেই একটু যেন হোঁচট খেল। বেদত্রয়ীর ভাই, বেদায়ন পেশায়-নেশায় ফটোগ্রাফার। পুজোতেও কোন ছুটি নেই, কালকেও গিয়েছিল কোন বনে-বাদাড়ে ছবি তুলতে। রাতে খাওয়ার সময় গল্পটা শুরু করলেও পুরোটা না শুনেই ঘরে চলে এসেছিল সে। সকালে হয়ত সেই ছবিগুলোই দেখছিল ভাই, ল্যাপটপ খোলা থাকায় চোখ আটকাল তারও। সোজা টেবিলের ওপর গিয়ে খানিকটা হামলে পড়ার ভঙ্গিতে বারবার দেখতে লাগল ছবিখানা। বেশ কয়েক মিনিট দাঁড়িয়েও রইল ল্যাপটপের সামনে।
ঘরে ভাইকে দেখতে না পেয়ে চিৎকার করে ডাকতেই মা উত্তর দেয়, ' ও তো এই বেড়িয়ে গেলো ,বলল কি একটা বিশেষ ছবি তোলার আছে আজ, তোর আবার ওকে এখন কি দরকার?' মায়ের প্রশ্নের জবাবে সে বলে, ' ও ল্যাপটপ বন্ধ করেনি, তাই ডাকছিলাম, আচ্ছা মা, ভাই কালকে কোথায় ছবি তুলতে গিয়েছিল তুমি জান?' 'রাতে বলছিল যে, ওই সাউথ লাইনের কোন একটা গ্রামের কথা, তোকেও তো বলছিল।' মায়ের কথা যেন কানেই পৌঁছল না বেদত্রয়ীর। আবার ভাইয়ের ঘরে ঢুকে ল্যাপটপে হাত রাখতেই ভেসে উঠল ছবিটা। হ্যা ঠিক দেখছে ও, জুম করতেই বিষয়টা আরও স্পষ্ট হল।
'বেলা হয়ে গেল তো, তোদের নাকি একটায় মিট করার কথা, এখনও স্নান সারতে পারলি না, পুজোর দিনে তো একটু তাড়াতাড়ি করতে পারিস, ' মায়ের চিৎকারে সম্বিৎ ফেরে বেদত্রয়ীর। ঝটপট পা বাড়ায় বাথরুমের দিকে। আগে থেকে বেছে রাখা শাড়ি, গয়নায় নিজেকে সাজিয়ে বেড়িয়ে পড়ে সে। রাস্তার মোড় থেকে অটো ধরে সোজা স্টেশন। পুজোর ভিড়ে বাস বা ট্যাক্সিতে উঠলে সঠিক সময়ে আর পৌঁছতে হবে না। তাই ট্রেনে যাতায়াতই ভাল। তবে সোজা স্টেশনের দিকে যাওয়ার অটোতে না উঠে উল্টোদিকের অটোতে উঠেছে বেদত্রয়ী।
ফোন বাজছে, ঘড়ির কাঁটা একটা পেড়িয়ে দু'য়ের দিকে পা বাড়িয়েছে। ইচ্ছে, রিমা, অনয় থেকে রূপসা একের পর এক নাম ভেসে উঠছে মোবাইলের স্ক্রিনে। সবটা দেখেও কেমন নির্বাক হয়ে জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছে বেদত্রয়ী। হোয়াটসআপে মেসেজ ভেসে আসছে, 'কিরে ফোনটা তোল, অন আছিস তবুও রিপ্লাই করছিস না, কাকিমা বললেন তুই এগারোটা নাগাদ বেড়িয়েছিস।' এরমধ্যে মায়ের নম্বর থেকেও ফোন, না কারোর ফোনই ধরছে না সে। রেললাইনের ইস্পাতের আওয়াজে ফোনের শব্দ ম্লান হয়েছে, চেনা পথের একের পর এক স্টেশন পেড়িয়ে যাচ্ছে। 'আরে দিদিমণি, পুজোর দিনে এই পথে,' ছোলা-বাদাম হকারের ডাকে যেন চমকে উঠল। পরের স্টেশনেই তো নামবেন , না কি আজ অন্য কোথাও যাবেন , হকারের প্রশ্নে ঘোর কাটে বেদত্রয়ীর, 'না না, অন্য কোথাও নয়, পরের স্টেশনেই নামব।' বলতেই অভ্যাসমত সিট ছেড়ে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। ট্রেন থামতেই নেমে পড়ল, তবে চেনা স্টেশন আজ একদম অচেনা।
নিস্তব্ধ দুপুর, নীলাকাশ, সাদা মেঘের মাঝে রোজকার সেই ভিড় চোখে পড়ছে না। আসলে ব্যস্ত দিনের সঙ্গে আজকের অনেকটা পার্থক্য। আজ নবমী, পুজোর শেষদিন। বন্ধুদের সঙ্গে চুটিয়ে মজা করার দিন। না হলেই আবার এক বছরের অপেক্ষা, তবে সে কেন আজ উল্টোপথে এলো, একা এই খাঁখাঁ করা দুপুরে নির্জন স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে কেন ? আসলে কাউকে খুঁজছে, কিন্তু কোন দিকটায় গেলে তাকে খুঁজে পাবে সেটা বুঝতেই ট্রেন ছেড়ে চলে যাওয়া রেল লাইনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। স্টেশনের বাইরে থাকা ভ্যান রিক্সার মালিক চেনা মুখ দেখেই এগিয়ে এলো, 'দিদিমণি আপনি আজকে? কোন জরুরি কাজ আছে নাকি?' 'আচ্ছা মুষলডাঙ্গার পুজোটা কোনদিকে হচ্ছে তুমি জানো?' ' দিদিমণি ওটা তো স্কুলের উল্টোপথে, আপনি কি ওইখানে যাবেন?' মাথা নেড়ে হ্যা বলতেই ভ্যান চলল মুষলডাঙ্গা পুজো মন্ডপের দিকে।
পুজোর মাঠ, ধূলো উড়ছে, ছোট রঙ্গিন কাপড়ের মন্ডপ, সাবেকি প্রতিমা, কচিকাঁচার ছোটাছুটি, মাইকে গান বাজছে, আর তাতেই হাত-পা ছুঁড়ে তাল মেলাচ্ছে একটা চেনামুখ। এই তো সেই ছবিটা, একদম হুবুহু সেই মুখটা, ভাইয়ের ল্যাপটপের সেই ছবি, যা পাল্টে দিল নবমীর সকাল, আর ক্যাপশনটা, বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়। পুজোর ছুটির দু'দিন আগে স্কুলের ঘটনাটাও তাড়া করছে ভেতরে। ভ্যান থেকে নেমেই গতি বাড়িয়ে এগিয়ে গেলো মন্ডপের দিকে। জড়িয়ে ধরতেই চোখের জল বাঁধ মানছে না। ' 'আরে ত্রয়ী দিদিমণি, আপনি পুজোর দিনে আর আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন কেন?' নেভি-ব্লু-সাদা জামা, ধূলো মাখা পা আর এলোমেলো চুলে হেয়ার ব্যান্ড লাগান মাধবী, দিদিমণির ব্যবহারে খানিকটা স্তম্ভিত। 'ও দিদিমণি আপনি আজকে কেন এসেছেন? এখন তো স্কুল ছুটি।' তৃতীয় শ্রেণীর মাধবীর প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারছে না বেদত্রয়ী। সঙ্গে আনা কাগজের ব্যাগটা মাধবীর হাতে তুলে দিয়ে বলে-'সন্ধ্যেবেলা এটা পড়ে পুজো মন্ডপে আসিস, আমি চলি।'
ট্রেন ছুটছে, বাড়ির পথে বেদত্রয়ী, জানলায় মাথা রেখে, একটু স্বস্তিতে চোখ বুজেছে সে। পুজোর ছুটির আগে স্কুল ড্রেস পড়ে না আসায় খুব বকেছিল মেয়েটাকে, সকালে ভাইয়ের ফটো আর ক্যাপশনে নিজেকে অপরাধী মনে হয়েছিল নিজেকে, বিশেষ পুজোর ফটোতে ভাইয়ের তোলা সেই ফটো পাল্টে দিয়েছে নবমীর সকাল। 'স্কুলের নতুন পোষাকে অষ্টমীর খুশিতে মাতোয়ারা শিশু' তাতেই ভাসছিল মাধবীর হাসি মুখ। স্কুলে ছেঁড়া পোষাকে এসে স্কুল থেকে দেওয়া ইউনিফর্ম তোলা ছিল পুজোর জন্য। এমনটা ভাবতেই আবার জল ভরে এলো চোখে। পরের স্টেশনে নামতে হবে ভেবে সিট ছেড়ে দরজায় এসে দাঁড়ায় বেদত্রয়ী।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴