নতুন আলোর সন্ধানে/ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য
নতুন আলোর সন্ধানে
ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য
বাংলা নববর্ষ ১৪৩২। দেখতে দেখতে দিনের পর দিন পেরিয়ে দোরগোড়ায় এসে উপস্থিত আরও একটা আস্ত নতুন বছর। জীবনকালের ঘর থেকে আরও একটা দাগ কমে যাওয়া। আরও এক দাগ এগিয়ে যাওয়া মৃত্যুর দিকে। এই যে প্রতি বছর ঘুরে ঘুরে ফিরে আসে একেকটা নতুন বছর, সত্যিই কি তাতে পুরনো সব গ্লানি কষ্ট শোক মুছে গিয়ে আবারও একবার একেবারে নতুন করে সবকিছু শুরু করা যায়? নববর্ষের আনন্দমুখরতায় মিটিয়ে ফেলা যায় ফেলে আসা বছরের ছোট বড় অজস্র হতাশা, অপূর্ণতা আর অপ্রাপ্তি? সত্যি সত্যিই পুরোপুরি নতুন করে আবারও সুযোগ পাওয়া যায় জীবনটাকে গুছিয়ে নেওয়ার? এইখানেই বোধহয় জীবন অঙ্কের সবচেয়ে জটিল ধাঁধাটা লুকিয়ে আছে যার রহস্যভেদ আজও ধোঁয়াশা ঘেরাই। পুরনোর প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির হিসেবের সাথে নতুনের তালমেল মেলানোর অঙ্কটুকু সঠিক ভাবে করে উঠতে পারাটাই বুঝি নতুন বছরের সবচেয়ে কঠিন কাজ। আজকাল তাই এই নববর্ষ সত্যিই আর তেমন করে মনের ভেতরটায় সহজ আনন্দ বয়ে আনে না, শুধু অদ্ভুতভাবে বয়ে আনে কিছু আলুথালু চিন্তা, কিছু এলোমেলো ভাবনা, কিছু না কাটাতে পারা পিছুটানের কষ্ট। একটা সময় অবধিও যখন নববর্ষ বলতেই মনের মধ্যে শত আনন্দ উদযাপনের ঝিলমিল আলো জ্বলে উঠত নিমেষে, এখন তাই কিভাবে যেন অনেকটা ব্যক্তিগত, অনেকটা একান্ত, অনেকটা আড়াল প্রিয় হয়ে এসেছে। হয়তো এই বদলে যাওয়া উপলব্ধি বেড়ে চলা বয়সেরই দোষ। প্রায় মধ্য চল্লিশের দোরগোড়ায় পৌঁছে এখন তাই নববর্ষকে কেন যেন একটা উৎসবের দিন বলে আর সত্যিই ভাবতে পারি না, বিশেষ এ দিনটাকে সত্যি সত্যিই পেছনে ফেলে আসা বছরের সব ত্রুটি গ্লানি ভুল ভ্রান্তি সরিয়ে নতুন করে আবারও সব শুরু করার এক মহার্ঘ সুযোগ বলেই কেবল মনে হয়। ঈশ্বরের অসীম কৃপায় এ পৃথিবীতে বেঁচে বর্তে থেকে আরও একবার সেই সুযোগটুকু পাওয়ার জন্য নিজেকেই যেন ভীষণরকম ধন্য মনে হয় নিজের কাছে।
একটা নির্দিষ্ট বয়স অবধি জীবনটা বেঁচে ফেলার পর জীবনের ভাগে পড়া অপ্রাপ্তি, ভুল আর শোকের পাল্লাটা বেশ ভারীই হয়ে ওঠে। আমিও এ নিয়মের ব্যতিক্রম নই। চলতে চলতে কালের গহ্বরে হারিয়ে ফেলেছি যাদের, প্রতিদিনের কোলাহলমুখর ব্যস্ততার চাপে মনের গহনে আত্মগোপন করে থাকলেও এই বিশেষ আনন্দের দিনগুলোতে তাদের অনুপস্থিতি, তাদের অভাবটা বড় বেশি করে অনুভূত হয়, বড় বেশি বেদনা দেয়। এই হারিয়ে ফেলার দলে যেমন আছে আমার কিছু অতি প্রিয়জন, তেমনই আছে ফেলে আসা কিছু সময়ও। নববর্ষ বলতে এখনও সবচেয়ে বেশি করে মনে পড়ে ছোটবেলার কথাই। সম্পূর্ণ চিন্তাভাবনাবিহীন, নির্মল নির্ভেজাল সহজ আনন্দময় সোনায় মোড়া সব দিন! তখন কষ্ট কি, শোক কি বোঝার দরকারই পড়েনি। আশপাশ পরম স্নেহে মমতায় আদরে ঘিরে রেখেছিল মা বাবা, কাছের দূরের আত্মীয় পরিজনেরা, প্রিয়জনেরা। আর এত ভালবাসার ওমে মুড়ে থাকার কারণেই হয়তো সহজেই ভারী আনন্দ হত তখন, অল্পেতেই খুশি হত মন। আমার আর আমার ছোটবোনের একইরকম দেখতে জামা হত প্রতি নববর্ষে, সকালে সবাই একসঙ্গে বসে টেলিভিশনে নববর্ষের বৈঠক দেখা, দুপুরে বাড়িতেই মায়ের হাতের মাংস ভাত আর বিকেলে মা বাবার হাত ধরে কাছেপিঠেই একটু বেড়োনো, পরিচিত একটি কি দুটি দোকানের হালখাতায় যাওয়া, মিষ্টি খাওয়া, গুরুজনদের আশীর্বাদ, ব্যস্। বছরের পর বছর এই একই সোজাসাপটা রুটিন। তবু একঘেয়েমি আসত না কখনও, তবু প্রতি বছরই অধীর অপেক্ষা থাকত আরও একটা পয়লা বৈশাখের, সকাল থেকে রাত অবধি পরিবারের সকলে মিলে আবারও একসাথে সেই একরকমভাবেই দিনটাকে কাটানোর। তারপর, ধীরে ধীরে বয়স বাড়ল, সময় পেরোলো, আর, দেখতে দেখতে আমার চেনা নববর্ষও বদলে গেল কি দ্রুত!
মৃত্যুশোক বড় শোক। আর তা যখন খুব কাছের মানুষের হয়, এবং তাও ভীষণ অপ্রত্যাশিতভাবে, একেবারে ভেতর থেকে তা আমূলে বদলে দেয় মানুষকে। বাইরে থেকে দেখে এ শোকের ছাপ হয়তো সবসময় বোঝা যায় না, কিন্তু ভেতরের ক্ষতটা সবার অলক্ষ্যে অক্ষত হয়ে রয়েই যায় চিরকালের মতো, একান্তে তা থেকে রক্তক্ষরণ হয়ে চলে সবার অগোচরে, নিঃশব্দে। এই যে মানুষটা কিছুক্ষণ আগেও ছিল ঠিক পাশটিতেই, এই যে মানুষটা বলে গেছিল একটু পরেই বাড়ি ফিরবে একটা কাজ সেরে, হঠাৎই চমকে উঠে দেখি সে আর কোত্থাও নেই! কোনও প্রস্তুতি নেই, কোনও আগাম আভাস নেই, হঠাৎ করে একখানা জলজ্যান্ত তরতাজা প্রাণ এই গোটা পৃথিবী থেকে স্রেফ ভ্যানিশ হয়ে গেল! এ আঘাত যে পায়, একমাত্র সেই বোঝে এর মূল্য। এ আঘাত যে পায়, সে আর কখনও একরকম থাকে না, খুব গভীর থেকে বদলে যায় চিরতরে, বদলে যায় তার জীবনবোধ, বদলে যায় তার জীবন বাঁচার দৃষ্টিভঙ্গি। যে কাছের মানুষটা এভাবে পলক ফেলতে না ফেলতেই নিমেষে, কোনও সুযোগ না দিয়ে, হারিয়ে গেল চিরকালের মতো, যে কষ্ট অভিমান অভিযোগের বাকি পড়ে থাকা হিসেবগুলো আর মেটানোই হল না তার সাথে, সেই চির অপ্রাপ্তির দায়টুকু শেষমেষ কার? বছর ঘুরে ঘুরে গিয়ে যতই পোশাকি অর্থে পুরনো হয়ে যাক এ শোক, যারা এ শোক সয়ে পড়ে থাকে পেছনে, মনের ওই বাকি পড়ে থাকা হিসেব মিটিয়ে সত্যিই কি তাদের পক্ষে আবারও নতুন করে আরেকটা নতুন বছর শুরু করা সম্ভব? এ বাকিটুকু তো কোনদিনই আর ভরবার নয়, এ দেনাটুকুর ভার সঙ্গে নিয়েই তো তাদের চলতে হবে বাকি জীবনভর!
তবে বড় ব্যক্তিগত এসব শোক বোধহয় সবারই জীবনের অঙ্গ। একেক জন একেকরকম করে এ আঘাত পায়, একেক জন একেকভাবে মেনে নেয়। আর, না মেনে নিয়ে উপায়ই বা কী? এ জীবনে যার ভাগ্যে আছে যেটুকু শোকের ভাগ, সহনীয় হোক কি অসহনীয়, বেঁচে থাকলে সইতে তো তা হবেই। যারা চলে গেল, সময়ে কি অসময়ে, শরীরেই গেল শুধু, আত্মায় তো জুড়ে থাকে জীবনভরই, আর এইসব শুভ দিনগুলোতে তাদের কথা মনে পড়লে একটাই কথা শুধু মনে হয় বার বার, জীবনের সবচেয়ে অমূল্য বস্তুটা আসলে বোধহয় জীবন নিজেই। এই যে জন্ম মৃত্যুর মাঝের ভীষণ ছোট্ট সময়টুকু ঈশ্বরের অসীম কৃপায় জীবন হিসেবে পেয়েছি আমরা, কোন মূল্যেই যেন তা তুচ্ছ অবহেলায় নষ্ট না করে ফেলি, রাগ ক্ষোভ ঘৃণায় প্রিয়জনকে অভিমানভরে দূরে সরিয়ে রেখে একদিন শেষে নিজেই না আক্ষেপের অনুশোচনায় দগ্ধ হই প্রতিনিয়ত, কারণ, সময় তো কারও অপেক্ষায় বসে থাকে না কখনও, চাই বা না চাই, তির তির করে বয়ে যেতে যেতে একদিন ঠিক মোহনায় পৌঁছে যায়। তখন আর না উপায় থাকে ফেরার, না বদলাবার, না নতুন করে শুরু করার। তাই প্রতিবার বছর ঘুরে এই দিনটা এলে আজকাল থেকে থেকে একটাই কথা শুধু মনে হয়, এযাবৎ যা গেছে তা যাক, কিন্তু এরপর থেকে প্রতি নববর্ষেই যেন এক বিন্দুসম হলেও নির্দয় আত্ম সমালোচনা, আত্ম অন্বেষণ থাকে আমার, আর তা যেন করতে পারি শুধুমাত্র নিজের জন্যেই, যাতে অতীতে করে ফেলা ভুলগুলোর আর কখনও পুনরাবৃত্তি না হয়, নিজের ঠুনকো দম্ভ অহঙ্কার গর্বের গণ্ডি ভেঙে নত হতে পারি জীবনে, সময়ের মূল্যকে স্বীকার করে বাকি পড়ে থাকা জীবনটুকু বাঁচতে পারি যথার্থ পূর্ণতার সাথে। প্রতিটি নববর্ষই একেকটি অমূল্য সুযোগ, এক ধাপ এক ধাপ করে অভিষ্টের দিকে, অমৃতের দিকে, পূর্ণতার দিকে এগিয়ে চলার। চরৈবেতি এ জীবনের অর্ধেক বসন্ত পেরিয়ে এসে নববর্ষ নিয়ে এইই আমার একান্ত পরম উপলব্ধি। শোক তাপ অন্ধকার পেরিয়ে নতুন আলোর পথের সন্ধান দিক এই দিন, তবেই না নতুন শুরুর ক্ষণ হিসেবে এর আসল সার্থকতা।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴