দোষী কে? : কিছুটা ব্যক্তিগত ধোঁয়াশার অসম্পূর্ণ গল্প/মনীষিতা নন্দী
দোষী কে? : কিছুটা ব্যক্তিগত ধোঁয়াশার অসম্পূর্ণ গল্প
মনীষিতা নন্দী
সালটা ১৯৯৯। দময়ন্তীকে ওরা নিয়ে এসেছিল আসামের এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে। কোন্ গ্রাম, কোন্ নদীর তীর, কিছু জানা নেই। আসামটুকুই আপাত প্রকাশ্য। শোনা যায়, ওখানে ক্লাস ফাইভে পড়ছিল দময়ন্তী।
মিঠাইয়ের ক্লাস টু। মিঠাইয়ের ভাই বুবুলের কিন্ডারগার্ডেন। একটু একটু লিখতে শিখেছে। গুণতে পড়তে শেখেনি। মুখে আধো আধো বুলি। ইস্কুল থেকে ফিরে দিদিমণিদের মুখে শোনা কুটুর কুটুর নেংটি ইঁদুর, লম্ফরাজ ব্যাঙের গল্প, নেচে নেচে শোনায় ছোট্ট দিদিভাই মিঠাইকে। মেয়েটা হেসে ওঠে ফুলের মত। তার এখন দায়িত্ব অনেক। সে বড় দিদি কিনা! মা বলেছেন, ভাইকে সবসময় দেখে রাখতে, আগলে রাখতে। মিঠাই মায়ের খুব বাধ্য। দময়ন্তী ওদের বাড়ীতে প্রথম আসে এক তীক্ষ্ণ, কনকনে শীতের সকালে, মায়ের স্কুলের কলিগ, শর্মি মাসীর সাথে। শর্মি মাসীর বাড়ীতে অনেক দিন ধরেই ওঁর ছেলেকে দেখাশোনা আর রান্নার কাজ করেন দময়ন্তীর পিসী। সেই সূত্রেই ..... । বাবা অনেক আগেই অফিসে বেরিয়ে গেছেন। মায়েরও তখন স্কুলে যাবার তাড়া। মিঠাইয়ের স্কুল থাকে সকাল সাতটা থেকে দশটা কুড়ি। তবে আজ ছুটি ছিল কী কারণে যেন! স্কুল ছুটি থাকলে মিঠাইয়ের মনকেমন করে। ঘরে একা ভালো লাগেনা। বুবুলের কিন্ডারগার্ডেনে ক্লাস সপ্তাহে তিন দিন। এ'টুকু শিশুর এতো রোজ রোজ বাঁধা নিয়মে স্কুলে গিয়ে কাজ নেই ভেবেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মৌনীতা - কৌশিক। তবে সারা দুপুর মিঠাই - বুবুলকে একা রেখে ওঁরা চাকরিতে গিয়ে নিশ্চিন্ত হ'তে পারছিলেন না। ভরসা শুধু একটামাত্র ল্যান্ডফোন। এ'দিকে বুবুলকে দেখভালের দায়িত্বে থাকা মণিমাসীও রোগশয্যার ছুটিতে দীর্ঘদিন। অতঃপর, দময়ন্তীর আগমন।
মায়ের স্কুলের দেরী হচ্ছিল। দময়ন্তীকে বসিয়ে রেখে শর্মি মাসী আর মা স্কুলে বের হ'লেন। একটু অন্যমনস্ক ছিল মিঠাই। ওর কেন যেন ভয় করছিল। মা তো কিছু বলল না! কী করবে ও! "Ignorance is bliss".. এ'সব শেখার বয়স হয়নি তখনও। দুপুর একটার পর স্কুলের ল্যান্ডলাইনে অনেকবার ফোন করেও মাকে না পেয়ে, মায়ের বাধ্য, বছর সাড়ে ছয়ের মেয়ে ভাত মাখতে বসল ভাইয়ের জন্য। মায়ের ফিরতে সেই বিকেল ৪ টে। ভাইয়ের জন্য এমনিতে মা প্রেশার কুকারে সেদ্ধ নরম আলু মাখা ভাত তৈরি করেন। কিন্তু আজ তো মা তেমন কিছু ক'রে রেখে যাননি! আজ সব যেন কেমন অন্যরকম! ভাইয়ের খাবার সময়ও হয়ে এল! যাকগে, মিঠাইয়ের এত ভাবার সময় নেই। সকালে যে ভাত ছিল, রান্নাঘরে গিয়ে সে ভাতই থালায় ঢেলে চটকে চটকে ডাল দিয়ে মেখে নিল। সেই প্রেশার কুকারের ভাতের মতো খানিকটা অবয়ব তৈরি ক'রে, ক্লাস টু - এর মিঠাই, নতুন দিদিকে খুব যত্ন ক'রে বোঝাতে লাগল, কীভাবে তাকে চামচে ক'রে খাইয়ে দিতে হ'বে ভাইকে।
মায়ের ছুটি ছিল। রাজনৈতিক কোনো ধর্মঘট। মিঠাই জানত না। স্কুলে একঘন্টার হাজিরা, সইসাবুদ আর কলিগদের সাথে হালকা বাক্যবিনিময় ছাড়া তেমন কাজ ছিল না। তাই মোটামুটি দেড়টার মধ্যে মা ফিরে এলেন। ঘরে ঢুকেই জরাজীর্ণ ময়লা জামাকাপড়ে, ময়লা হাতে, বুবুলের ভাতের থালায় দময়ন্তীর অপারগ চামচের চলাচল দেখে প্রায় আর্তনাদ ক'রে ওঠেন মৌনীতা। এক ঝটকায় বুবুলের মুখ থেকে খাবারটা ফেলে চিৎকার ক'রে ঝাঁপিয়ে পড়েন ছয় বছরের মেয়ের ওপর। টেনে বিছানায় ফেলে, মারতে মারতে প্রায় আধমরার অবস্থা করে ফেলেন ছোট্ট মিঠাইকে, যেন খুন ক'রে ফেলবেন এই গর্হিত 'পাকামি' সাথে একবুক আত্মবিশ্বাসী ভবিষ্যতকে। বিছানার কোণে গুটিয়ে বসে, ফুলে, ফুঁপিয়ে কাঁদে মিঠাই। বাধ্য মেয়ে হ'বার মাসুল গুণতে থাকে। দিনভর। বছরভর।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴