দেশভাগ, কাঁটাতার আর এক আত্মজা/অনিন্দ্য সেনগুপ্ত
দেশভাগ, কাঁটাতার আর এক আত্মজা
অনিন্দ্য সেনগুপ্ত
***************************
'...বুঝলা মুণি,আমাগো দ্যাশের বাড়িতে ...' দাদুর মুখ থেকে কথাগুলো বেরোতে না বেরোতেই ঠাকুমার ঝাঁঝ, 'ঐ যে শুরু হোল ওনার দ্যাশের বাড়ির কথা!এখনই বলবেন গোলা ভরা ধান,মাছ ভর্তি পুকুর আর ফসল ভরা মাঠের কথা...আর কত শুনবে তোমার নাতনি ওসব গল্প?থামো তো এবার!'
'থামুম ক্যান?আমি কি মিইথ্যা কই?' -নাতনি জানে ঠাকুমার উত্তর এবার কী হবে। কিন্তু সে চাইল না দাদুর গল্প বলার ইচ্ছেটাকে চুপ করিয়ে দিতে।
'থামবে কেন?বল?আমি শুনছি তো।' নাতনির আগ্রহ দেখে আশির ঘরে পা দেওয়া বৃদ্ধ ফোকলা দাঁতে শিশুর মতো হেসে ওঠেন।এবার দ্বিগুণ উৎসাহে তিনি বলতে থাকবেন জন্মভিটের কথা, কুড়িগ্রামের কথা।নিজের কবিরাজি পেশার গল্প,রংপুরের মাঠে সামাদ সাহেবের বিপক্ষে ফুটবল খেলার ইতিহাস।প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গ পাল্টালেও মূলসুরে বাজবে ঐ একটাই বিষয়-'দ্যাশের বাড়ি'...গল্প ছুটবে নিজের গতিতে,প্রত্যহ সেই এক গল্প বলাতে বক্তারও আলসেমি নেই শ্রোতারও নেই ধৈর্য্চ্যুতি...শুধু একেকদিন যখন গল্প বলতে বলতে দাদুর চোখটা একটু লেগে আসবে ঠিক সেই মোক্ষম সময়ে নাতনির একটা জোর চিমটি অবধারিত হানা দেবে দাদুর স্ফীতোদরে।স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় বৃদ্ধ বলে উঠবেন 'আঃ হা...করো কী!'
নাতনিও কম যায় না-'ঘুমোচ্ছ কেন? কীর্তনের আসরে খোল বাজানোর গল্প তো এখনো বলো নি, যাত্রাপালার গল্পটাও শুনব তারপর।শেষে কিন্তু 'পঞ্চনদীর তীরে বেণী পাকাইয়া শিরে' আবৃত্তি করতেই হবে আজ...।' ফলে যথারীতি আবার শুরু হবে অশীতিপর এক মানুষের স্মৃতির আল ধরে বসতভিটের নাড়ি ছুঁয়ে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা।আর সে যাত্রায় অবুঝ সঙ্গতে রইবে সদ্য শৈশব পেরোনো তাঁর ছোট্ট 'মুণি'।অসমবয়সী দুই মানুষের মাঝে দগদগে হয়ে পড়ে থাকবে দুঃসহ দেশভাগের জ্বালা আর কাঁটাতারের চোখরাঙানি।
এর বেশ কিছুদিন পর কলেজ বেলার প্রান্তে এসে সেই নাতনি ঋত্বিক দেখছে বায়োস্কোপের পর্দায়।দেশভাগের বাস্তবতায় উদ্বাস্তু মানুষের কষ্ট দেখতে দেখতে তার মনে ভিড় করে আসবে দাদুর মুখে শোনা একের পর এক এমনসব ঘটনা। দুর্বিষহ সেসব কষ্টের কথা মনে করতে করতে সে ভাববে দাদুও কি কোনদিন বলতে চেয়েছিল 'I accuse...' ? স্মৃতি যদিও সেসময় তার সাথ দেয় না। সে শুধু বুঝবে গলার কাছে কী যেন একটা ঢেলা বারবার পাক দিয়ে উঠতে চাইছে আর চোখের জল হয়ে গাল বেয়ে তা নেমে আসছে অঝোরে ...
আরো বহুবছর পর,সময়ের হাত ধরে সেই ছোট্ট মেয়েটি আজ কর্পোরেট চাকরিধারী। আপিসে,ঘরে অনর্গল হিংলিশে সে মুখরিত।কদাচিৎ কখনো বাংলাটা মুখে চলে এলেও,সে শব্দের অশুদ্ধ উচ্চারণে নিজেরই খটকা লাগে আজ তার।এক সময়ে এই ব্যাপারটা গলা উঁচু করে বন্ধুমহলে অভ্যেস করে নিলেও আজ কেমন আত্মগ্লানিতে ভোগে সে।দাদুর মুখের বাঙ্গাল ভাষা,বাবা-কাকার মুখের এপার বাংলার ভাষা তার নিজের সন্তানের কাছে যে সম্পূর্ণ অবহেলিত রয়ে গেল, তার দায় কি তারও নয়?সে বেশি ভাবতে চায় না এ বিষয় নিয়ে।পালিয়ে বাঁচতে গিয়েও সে ভাবে 'I accuse...' বলে আমিও যদি আজ চিৎকার করে উঠতে পারতাম!...গলার কাছে অস্বস্তির ঢেলাটা আজও বেমক্কা ওঠে,চোখের জলটাই শুধু মাঝখান থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে সময়, বরাবরের মতো।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴