দেবদত্তা বিশ্বাস-এর আলোচনায় শৌভিক রায়-এর 'চেনা উত্তর অচেনা উত্তর'
দেবদত্তা বিশ্বাস-এর আলোচনায় শৌভিক রায়-এর 'চেনা উত্তর অচেনা উত্তর'
মংপুর কুয়াশা জড়ানো রাজ্যে মৈত্রেয়ী দেবী তার প্রাণের কবি বিশ্বকবির পদার্পণ সম্পর্কে বলেছিলেন 'ঘন ছায়াচ্ছন্ন পথ দিয়ে মেঘ কুয়াশার রাজ্য ছাড়িয়ে মংপুতে যখন নামলাম তখন রোদ চারিদিকের ধোয়া সবুজের উপর ঝিলমিল করছে, শেষ রোদের সুন্দর শান্ত হাসি । ওঁর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, অনেকদিন পরে বন্ধুর সাথে দেখা হল, আলো নৈলে চলে না ,আমার আলো চাই ।light more light.' উপরের পংক্তি গুলোকে পুঙ্খানুপুঙ্খ লিপিবদ্ধ করার মতোই ডুয়ার্সের জঙ্গল, নদী, পাহাড় ঘেরা পথকেও অভিসারী আলোক রশ্মি অভিমুখে নতুনভাবে তুলে ধরতে যিনি বদ্ধপরিকর তিনি ডুয়ার্সের ভূমিপুত্র তো বটেই। লেখক শৌভিক রায়ের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধের সংকলন 'চেনা উত্তর অচেনা উত্তর' গ্রন্থটি চেনার মাঝে নানা অচেনা অজানার এক বিস্তৃত পরিসংখ্যান।
উত্তর কথা, মাতৃভূমি কথা, দার্জিলিং কথা, ডুয়ার্স কথা, সমস্যা কথা, কোচবিহার কথার বিভিন্ন ধাপে ক্ষুদ্র নিবন্ধগুলি যখন সমষ্টি রূপে আত্মপ্রকাশ করে বইটিতে তখন উত্তরবঙ্গের নানা পর্যায়ের বিস্তৃত রূপ শৃঙ্খলিতভাবে সামনে আসে। চেনা জানা উত্তরবঙ্গের এ এক অন্য দর্শন। বইটির বিভিন্ন পর্যায়ে জানা যায় বক্সার উৎপত্তি যেমন বকশিস শব্দ থেকে তেমনি অতীতে জয়ন্তী একসময় হাতি কেনাবেচার আন্তর্জাতিক ক্ষেত্র ছিল। আবার জানতে পারি বর্তমান সময়ে ডুয়ার্সে প্রজাপতি চাষে পাডলিং প্রক্রিয়ার জনপ্রিয়তা। কতজনই বা জানেন কালচিনির চৌমাথা থেকে রেললাইন পেরিয়ে উত্তর মুখে 'কাজিমান গোলের' যে সংগ্রহশালা তা একক প্রচেষ্টায় তামাং জনজাতির ঐতিহ্য সংরক্ষণের এক অনন্য পন্থা? জলঢাকা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি উত্তরবঙ্গের অন্যতম দ্রষ্টব্য স্থান হলেও জলঢাকার উপর তৈরি 'হেড রেস টানেলটি' যে হিমালয়ের প্রাচীনতম টানেল গুলির একটি সে নিয়ে আলোচনা কোথায়? 'কোচবিহার রয়াল মেল সার্ভিস' হায়দ্রাবাদে নিজাম জামানার অন্তর্গত পরিবহন ব্যবস্থার অনুকরণে তৈরি করেছিলেন কোচবিহার মহারাজ জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ। যার প্রথম বাস সার্ভিস ছিল কোচবিহার থেকে সেবক হয়ে শিলিগুড়ি। বর্তমানে তার বর্ধিত রূপ উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থা।
এমনই নানা চমকপ্রদ তথ্যের পাশাপাশি ইতিহাস বিজড়িত নানা ঘটনার উল্লেখ রয়েছে বইটিতে। দ্বিতীয় ইঙ্গ- ভুটান যুদ্ধ এবং বক্সার ইংরেজ অন্তর্ভুক্তি, দার্জিলিংয়ে সেন্ট অ্যান্ড্রুজ চার্চ এর অতীত স্মৃতি, প্রাচীন মহকুমা হিসেবে ফালাকাটার আত্মপ্রকাশ, শৌলমারির বিতর্কিত আশ্রম, বাতাসিয়া লুপ ও রেলপথে পাহাড়ে সংযোগ স্থাপনের দীর্ঘ অধ্যায় নানাভাবে ঘুরেফিরে এসেছে লেখকের বক্তব্যে।
লেখক শৌভিক রায়ের লেখনীর মুন্সিয়ানা ঠিক সেখানেই যেখানে উত্তরবঙ্গের চিরাচরিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পিছনে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে তিনি নিপুণভাবে বর্ণনা করেছেন মাটির মানুষ হয়ে। আবার লেখক প্রশ্ন তুলেছেন প্রাকৃতিক সম্পদের অপরিকল্পিত ব্যবহারের ফলেও যে চরম সংকটের মুখে উত্তরের জনপদ তার বিহিত প্রয়োজন। নতুবা অচিরেই লুপ্ত হতে পারে নানা পশু, পাখি, গাছপালা এমনকি এক একটি জাতি গোষ্ঠীও। সদানীর তিস্তাকে নিয়ে লেখকের অনুমান সত্য হয়ে সাম্প্রতিক অতীতে সিকিমে ভয়াবহ বন্যায় প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ ও মানুষের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এক্ষেত্রে গ্রন্থকারের লেখক সত্ত্বার উপরেও প্রকৃতিপ্রেমী সত্ত্বা আমাদের ভাবিয়ে তুলতে বাধ্য তার মতো করেই। অতএব একবার দার্শনিকের চোখে উত্তরবঙ্গকে দেখতে হলে পড়ে দেখতেই হবে 'চেনা উত্তর অচেনা উত্তর'।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
