দেখেছি দৃঢ়চেতা এক ব্যক্তিত্ব/বেলা দে
দেখেছি দৃঢ়চেতা এক ব্যক্তিত্ব
বেলা দে
ব্যতিক্রমী কোনো ঘটনা অথবা না বলা কিছু কথা যখন মনের ভিতর গুমরে থাকে তাকে বাইরে প্রকাশ করে কারো সাথে ভাগ করে নেওয়ার মধ্যে থাকে অপার আনন্দ।
মাত্র আটের শৈশবে আমার বাবা পিতৃহারা, বড় হয়েছেন দেশ ছেড়ে ভারতে এসে নি:সন্তান কাকাকাকিমার কাছে জলপাইগুড়ির শিয়ালপাড়ায় নিজস্ব বাসভবনে। আমার দাদু কিনে রেখছিল বাড়িটা। কাকা ছিলেন বৈকুন্ঠপুর জমিদারি সেরেস্তায় নায়েব। অত্যন্ত মেধাবী বাবা ছোট থেকেই বৃটিশ আমলে ফনীন্দ্রদেব ইন্সটিটিউশন থেকে ম্যাট্রিকুলেশন -এ প্রথম হয়েছেন।
প্রথাগত বিদ্যার শুরু এবং শেষ সেখানেই, জীবনে প্রথম বৈ দ্বিতীয় হননি কোনোদিন। আমাদের শুধু একটা কথা সবসময় বলতেন তোরা বাংলায় পড়াশোনা করে এই রেজাল্ট আমরা সব বিষয় ইংরেজিতে পড়েছি। আত্মপ্রচার পছন্দ ছিল না তার, বাবার ম্যাট্রিকুলেশনের রেজাল্ট আমরা জানতে পারলাম গত হওয়ার পর স্যুটকেশ ভেঙ্গে। বাবার ছোটবেলার সাথী অতি নিকটবন্ধু সত্যেন্দ্রপ্রসাদ রায়(শিল্পপতি) আমাকে বলেছেন "তোর বাবার মতো ছাত্র হলে আমি দেখিয়ে দিতাম, ও কিনা হাঁটুসমান ধুতি পড়ে গ্রামের স্কুলে মাষ্টারী করে গেল"। কেউ জানে না, কী কারণে অনন্যোপায় হয়ে বাবা ফালাকাটা জুনিয়র হাই স্কুলে শিক্ষকতা করে গেছেন। সেখানে আমার পিসি এবং পিসেমশাই একইদিনে তিনজন নাবালক সন্তান ছেড়ে কলেরায় মারা গেছে, ওদের দেখভালের জন্য কেউ নেই। অগাধ জমিদারি ছিল তার। সেকারণেই বাবাকে বাধ্যতামূলক ফালাকাটায় চলে আসতে হয়েছে। উচ্চ আশা থাকলেও পূর্ণ হয়নি। দৃঢ়চেতা স্বভাবের রাশভারী মানুষ বাবা না ডাকলে কেউ কাছে ঘেঁষতে সাহস করেনি, একমাত্র আমি ছাড়া। সর্বকনিষ্ঠ সন্তান বলে আমার সব আবদার সয়ে গেছেন। বাবার শাসনকে সবাই অপশাসন মনে করলেও আমি সেটা করিনি, বাবাকে কৃপণ ভাবলে, আমি ভাবিনি কারণ আমার ক্ষেত্রে সে উদার। স্বল্প উপার্জনে তাঁর পক্ষে হয়তো ব্যয় সংকুলান সম্ভব হয়নি, এছাড়া বাল্যকালে পিতৃবিয়োগের অর্থকষ্ট তাঁকে মিতব্যয়ী যাপন দিয়েছে। বাবার বজ্রকঠিন মেজাজী স্বভাবের ভিতর দেখেছি মাখনমসৃন একটা মন, ছোড়দি কলকাতায় তার শ্বশুরবাড়ি চলে গেলে আমাদের গাড়ির ঘরের পেছনে অন্ধকারে বসে লুকিয়ে কাঁদতে দেখেছি, আর দেখেছি সেজদা দার্জিলিঙয়ে কর্মস্থলে চলে যাবার পর আড়ালে বসে চোখ মুছতে। জলপাইগুড়ি শহরে নিজে বড় হয়েছেন, ফালাকাটায় গ্রাম্যজীবনে সবকিছু থেকে বঞ্চিত মানুষগুলোর কোনও বিনোদন ব্যবস্থা নেই বলে সেখানে ড্রামাটিক হলটিকে সিনেমা হলে রূপান্তরিত করে দেন। এখনো সেই হল আছে শুধু মালিকানা বদল হয়েছে। নিজের বন্ধু আলিপুরদুয়ারের সারদা কবিরাজের কাছে স্বল্পমূল্যে বিক্রয় করেন, ততদিনে গ্রাম ফালাকাটা অনেক শাহরিক হয়েছে। আমরা ভাইবোনেরা বাবার মতন মেধাবী কেউ হতে না পারলেও এই প্রজন্মের সন্তান
বড়দার নাতি নাতনি মান রেখেছে দাদামশায়ের। নাতি ইসরোতে চান্স পেয়েছে। এখন যখন পর্যাপ্ত পাওয়া তার মধ্যেও এতটুকু খাবার ফেলতে গেলে বাবার কথা মনে পড়ে "দৈনিক কত অভাবী মানুষ অভুক্ত থাকে জানিস, পেয়ে যাচ্ছিস বলে মর্ম বুঝতে পারিস না"
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴