দুঃখ ভূমির রোজনামচা/সুদীপা দেব
দুঃখ ভূমির রোজনামচা
সুদীপা দেব
দেশভাগের কয়েক দশক পেরিয়ে গেলেও তার দগ্ধ স্মৃতি আজও আমাদের ভারাক্রান্ত করে। আজও উদ্বাস্তু শব্দের গোপন ট্যাগ মাথায় নিয়ে প্রচুর বাঙালির দিন কাটছে। তাঁদের দুঃখ দুর্দশা তাঁদের অপরিণত প্রেম, জীবন সংগ্রামের নানান অনুভূতির যাপন চিত্র জানতে হলে পড়তে হবে রাজর্ষি বিশ্বাসের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল 'ছিটমহলের নতুন গল্প' সংকলন।
বিশিষ্ট সাহিত্যিক এবং ইতিহাস গবেষক রাজর্ষি বিশ্বাসের সম্পাদনায় এই গ্রন্থে গল্পের ছকে লেখা হয়েছে ভারত-বাংলাদেশ , মূলত দুই বঙ্গের সীমান্তে ছিটমহল বাসিন্দাদের জীবন কথা। নতুন ভোরের স্বপ্ন– ".....ছিট বিনিময়ের লিখিত কাগজের মধ্য দিয়ে মূল ভূখণ্ডের নাগরিকের সম্মান নিয়ে বাঁচার স্বপ্ন ।" রয়েছে নারী জীবনের দরদি আখ্যান। সংকলনের নারী-অঙ্গন বিভাগের প্রথম গল্পে অমর চক্রবর্তীর 'নীলকুমারের জল' গল্পে আমরা দেখতে পাই ডাকাতের ভয়ঙ্কর অত্যাচার। ছিটের গরিব ঘরের মেয়েমানুষ ছিল প্রধান আকর্ষণ। " ...বুনকে পাওয়া গেইল নীলকুমার নদীর চরায়। উলঙ্গ শরীলখান। শরীলে কত কাটা দাগ জানোয়ারগুলা ছিঁড়ি খাইছে। ....আয় বুন বাড়ি আয়। ... বাবা এরপর আর বেশিদিন বাঁচেনি"।
কাঁটা তারের রাজনীতি মানুষের বুকে রঙিন আশার ফানুস জ্বেলে দেয়। তারা বিশ্বাস করে "উনিশশো বিরানব্বই।...তিনবিঘা চুক্তির পর সব ছিটের সমস্যা মিটবে....মুখ্যমন্ত্রীকে সব বলা হয়েছে"।
'ছিটমহলের নতুন গল্প' পড়তে পড়তে মন্থন হয় নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট। সুনীল সাহার 'এনআরসি ছিটমহল' গল্পে – "...হ্যাঁ ওই যে খালি জার গুলো দেখছেন ওতে করে বাদাম বা তিল তেল ওপারের বাংলাদেশ থেকে ওরা বর্ডার পার করে নিয়ে এসে এপারে দিনহাটার ছোট ছোট দোকানে দেয়। ওই পয়সা দিয়ে চিনি কিনে বাংলাদেশ থেকে বদল করে আবার তেল নিয়ে আসে। ...ওই দিয়ে সংসার চলে। .....কেউ ভাড়াও দেয় না। কেউ আদায় করতেও পারে না। .....এদের কোন দেশের ভোটার কার্ড নেই। এরা ছিটমহলবাসী।" অবহেলা আর প্রবঞ্চনার এই ভূখণ্ডে পাচার আয়ের একটি সহজ পথ। নারী পুরুষ এমনকি ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও এ কাজে যুক্ত। বোঝা যায় গরিব মানুষের পেট বাঁচাতে সম্মানের ধার ধারেনা। চেকিং এর নামে মেয়েদের পেটে লাঠির দুটো খোঁচা বা নিম্নাঙ্গে পুরুষালী লাথিকে খুব স্বাভাবিক মেনে নেয়।
আমাদের আশপাশের কতইনা মানুষ তাদের বিচিত্র জীবনে বিচিত্র সত্য কাহিনীর ঝুলি নিয়ে সারাজীবন বয়ে বেড়ায়, ছিটমহলও তার ব্যতিক্রম নয়। গ্রন্থের প্রথম গল্প শৌভিক রায়ের 'গাজনের সাধু' পড়তে পড়তে হারিয়ে যেতে হয় সেই জীবনের স্রোতে।
রাজীব দে রায় এর লেখা 'মনসা' গল্পে এক অসমাপ্ত প্রেমের করুন কাহিনীর বর্ণনা রয়েছে। " ....এটা আসলে একটা ছিটমহল। এর একটা পোশাকী নাম আছে ....নাম এই মুহূর্তে ততটা জরুরি নয় .....অনেক বছর ধরে সে মনসা বৃত্তান্ত লুকিয়ে রেখেছে। তা আড়ালেই থাক ।"
উত্তরবঙ্গ বলে কাগজে কলমে কোন বঙ্গ না থাকলেও ধীরে ধীরে কবে থেকে যেন মালদা থেকে আসামের দিকে যেতে যতটুকু বঙ্গভূমি মানচিত্রে দেখতে পাই সেই হলো কথিত উত্তরবঙ্গ। এই উত্তরবঙ্গের বিশিষ্ট লেখকদের বর্ণিত একত্রিশটি গল্পের এই সংকলনে রয়েছে ছিটমহলের জনজীবন, নারী- অঙ্গন, অসমাপ্ত ভালোবাসা, উদ্বাসন এবং ক্যাম্প সংসারের সূক্ষ্ম ভাগ।
সম্পাদক 'প্রান্তিক জীবন' এ বলেছেন " ছিট মহল।...মার্জিত সভ্যতার বিপরীতে যেন অন্য ভুবন ....জীবন যুদ্ধে হেরে যেতে যেতে কল্পরাজ্যের সন্ধান করে যাওয়া দেশের মানুষ আজ হয়তো স্বাধীন, তবু বুঝি ট্রমায় আচ্ছন্ন। ....বুঝি এক বদ্ধভূমি। "
লেখকরা ছিটমহলকে খুব কাছ থেকে দিনের পর দিন দেখেছেন। দেখেছেন এখানকার মানুষের, এই দুঃখভুমির নিত্য বাঁচা, নিত্য মরা। গল্পের বাস্তবতা বজায় রাখতে অনেক ক্ষেত্রে রয়েছে স্থানীয় ভাষার প্রতিফলন। কখনো কখনো চরিত্রের নাম পর্যন্ত অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। গ্রন্থের শেষের দিকে পাঠকদের জন্য রয়েছে শব্দার্থ তালিকা। যা সার্বিক গ্ৰহণযোগ্য করতে খুব উপকারী।
সুন্দর বাঁধাই করা মলাটে উচ্চমানের ঐতিহাসিক ভুমিকথা সমাদৃত হোক আরো বিপুল উৎসাহে, উত্তরণের পথে।
"সীমান্তের কাঁটা তারের বেড়ায় বসে
এপার আর ওপারের দুটি পাখি
গান গায়
মেতে ওঠে নিবিড় সঙ্গমে
তখনই কাঁটাতারগুলি গলে গলে
সীমান্তে বৃষ্টি নামে...."
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴