তোমায় যেমন দেখেছি/রুমা দেব মজুমদার
তোমায় যেমন দেখেছি
রুমা দেব মজুমদার
সেদিনও তেমন করেই পুব আকাশের রক্তিম সূর্যের আলো ঠিকরে পড়েছিল বীরপাড়া, দেবীগড় কলোনির আনাচে-কানাচে, এক নতুন দিনের সূচনায়। তোমার বাড়ির সামনের অশ্বত্থ গাছের তলাটিতে ঝরে যাওয়া পাতাগুলো বয়ে যাওয়া হালকা হাওয়া আর ধুলোর সাথে লুটোপুটি খাচ্ছিল। শীতের রুক্ষতায় পাতাঝরা গাছটির শুকনো ডালগুলো যেন শীতকে বিদায় জানাতে আর বসন্তের কিশলয়ে নতুনভাবে সাজতে অপেক্ষারত ছিল। যার তলায় তোমার সেই অভিশপ্ত গাড়িটি দাঁড়িয়ে থাকত প্রতিদিন। রাস্তার পাশ ঘিরে তোমার হাতে সযত্নে লাগানো ফুলের গাছগুলো হয়তো তোমার শেষ দিনটিকে অনুধাবন করতে পেরেছিল। কিন্তু আমরা তো পারিনি ……।
একটু বেলা বাড়তেই দেখলাম, ঘরের পোশাক পরনে তুমি খুব আলতোভাবে গাড়ির উপরের ধুলো-বালি আর ঝরাপাতা পরিষ্কার করছিলে। ঘরের কাজের তাগিদেই একটু বাইরে এসে দূর থেকে এক ঝলক দেখেছিলাম এই দৃশ্য। পাশাপাশি বাড়ি হওয়ায় রোজ দিনই তো কত কিছু শুনি, দেখি। কিন্তু কে জানত?
বাবার অসুস্থতার কারণে অফিস ছুটি নিয়েছিলে ..... নইলে প্রতি সকালে তুমি অফিস যাওয়ার সময় গাড়িতে চেপে হর্ণ দিতে, আর কাকিমা ঘর থেকে বলতেন 'এসো' ... পরে তোমার গাড়ি চলতে শুরু করত। সারাদিন তোমার বাড়ি নিঝুমই থাকত, কিন্তু রবিবার সকাল থেকে জোরালো সুরে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজত তোমাদের বাড়িতে। অনেক সময় বারটা খেয়াল না থাকলেও গান শুনে বুঝতাম, "ও ...... আজ তো রবিবার, পার্থর বাড়িতে গান বাজছে।" তারপর বাজার-হাট সেরে বাড়ির সামনে রাস্তার ধারে লাগানো কত রকম ফুলগাছ, সেগুলোর পরিচর্যা করা - যেগুলো সবই তোমার পরিকল্পনা মাফিক সাজিয়ে তুলেছিলে। আমরা শুধু তার সৌন্দর্য উপভোগ করতাম। সে সব আজ শুধুই অতীত।
জীবনের শেষ দিনটিতেও বাড়িতে থাকার দরুন এই রুটিনেই চলছিল, দুপুরে পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে আমার স্বামীসহ অনেকের সাথে কথা বলেছিলে। কিন্তু সন্ধ্যায় এ কী হল?
সেই রবিবার সাহিত্যসভার গ্রুপে তুমি পাঠিয়েছিলে কবি শরৎ কুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখা কবিতা 'দূরত্ব', যার প্রথম দুই লাইন ছিল:
"চোখ থেকে চশমার দূরত্ব যতখানি, জীবন থেকে মৃত্যুর দূরত্ব ঠিক ততটাই।"
ঠিক তার দুদিন পরেই, আক্ষরিক অর্থেই দুদিন পরে, তুমি প্রমাণ করে দিলে জীবন আর মৃত্যুর মাঝে দূরত্বটুকু। আমরা হতবাক। এ কী! উপরওয়ালার নির্দেশে বুঝি এত কবিতার মাঝে ওটাই নির্বাচন করেছিলে পাঠানোর জন্য?
প্রতি মুহূর্তে মনে হয়, এমন একটি উদ্যমী, উদ্যোগী, প্রাণবন্ত প্রাণকে ঈশ্বর কেন এমন অকালে টেনে নিলেন?
সমাজ, পরিবার—তোমার মতো নিঃস্বার্থ, পরোপকারী মানুষের কাছ থেকে কত কিছু পাবার আশায় হাত পেতে বসে আছে। তুমি তাদের নিরাশ করে পালিয়ে গেলে?
আমি তো অনেক আশা নিয়ে তোমার গড়া রোববারের সাহিত্য আড্ডায় যোগ দিয়েছিলাম। একটু-আধটু লেখালিখির প্রতি ঝোঁক ছিল বলে। সেই স্কুলছাত্রী থাকাকালীন স্কুলের ম্যাগাজিনে লেখা দিতাম। তার অনেক পরে শিলিগুড়ি থেকে প্রকাশিত 'কাদামাটি' নামে একটি লিটল ম্যাগাজিনে বেশ কয়েকবার লেখা পাঠিয়েছিলাম, যেগুলো ছাপা হয়েছে। কিন্তু সংসারের যাঁতাকলে পড়ে সেগুলোও বেশ কিছুদিন যাবৎ বন্ধ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু আবার সেই পুরোনো টান ফিরে পেয়েছিলাম রোব্বারের সাহিত্য আড্ডাতে-তে। তাই বলে তোমায় নিয়ে এভাবে লিখতে হবে - এটা তো অভাবনীয়, অকল্পনীয়, এক বিষাদময় বিষয় হয়ে দাঁড়াল, পার্থ।
এই তো সেদিন সাহিত্য আড্ডার অন্বেষণ দলের জন্য তুমি উদ্যোগী হয়ে শিলিগুড়ি থেকে সোয়ানের দলটি এনে বাচ্চাদের জন্য কত সুন্দর একটি শিক্ষণীয় অনুষ্ঠান আয়োজন করলে। আমরা প্রাণভরে উপভোগ করলাম। চা খেলাম, কেক, বিস্কুট ইত্যাদি সহ। প্রত্যেক সভায় বিবিধ আয়োজনের পেছনে কে? এই প্রশ্নটা তো থাকতই। কিন্তু নিজের সমস্ত ভূমিকাকে অপ্রকাশিত রেখে "ভূতের রাজা দিল বর" - এই তত্ত্বটি যেন খাড়া করেছিলে সবার মাঝে।
এমন আরও প্রচারবিমুখ, নিঃশব্দ পরোপকার তুমি বিভিন্ন ক্ষেত্রে করেছিলে। সে সব এখন শুনতে পাচ্ছি।
যে অপরের দীর্ঘ জীবন, সুস্থতার কামনায় এমনভাবে পাশে দাঁড়িয়েছিল, তাঁরই পরমায়ু এমন কৃপণ হস্তে দিয়েছেন ঈশ্বর - সেটা ভাবতেই অবাক লাগে।
আমি তোমার শৈশব, কৈশোর কালের কথা বলতে পারব না। কিন্তু যখন থেকে দেখেছি, এক কথায় বলা যায়—একটি আদ্যপ্রান্ত গুণী ছেলে।
কত রকম বই পড়ার অভ্যাস ছিল তোমার। সেটা বুঝেছিলাম, মাঝে মাঝেই যখন আমার দুই ছেলেকে ডেকে বই দিতে পড়বার জন্য। কতদিন ওরা ফিজিক্স বুঝতে তোমার বাড়ি গিয়েছিল। তুমি ওদের সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতে। আজ ওরা উচ্চশিক্ষার জন্য—একজন বিদেশে, অন্যজন দেশের আরেক প্রান্তে থেকে এই অসহনীয় খবরটি শুনল। জানানোর পরে ওদের শরীর ও মনে যে কী ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া হবে, সেটা ভেবে তো দূর থেকে আমি খুব চিন্তিত ছিলাম। কিন্তু তবুও "পাশের বাড়ির পার্থ কাকু নেই"—এ কথা অনেক কষ্ট নিয়ে ছেলেদের জানাতেই হয়েছিল।
আমাদের দেবীগড় কলোনির 'উত্তরণ' গোষ্ঠীর মূল কান্ডারি ছিলে তুমি। ব্যক্তি জীবনে অকৃতদার, অর্থাৎ চিরকুমার সভার সদস্য হওয়াতে সমাজের দায়িত্ব-কর্তব্যগুলো দিনে দিনে তুমি এক বিস্তৃত রূপে কাঁধে নেওয়া শুরু করেছিলে।
আর এমন একটি ছেলের কাঁধে ভর করে সবাই নিশ্চিন্ত হতে পেরেছিল। পাড়াতে কোন উপলক্ষ্যে কোথায় কেমন অনুষ্ঠান হবে, তাতে কে কী করবে, টাকা-পয়সার যোগান কোথা থেকে আসবে—সব কিছুর দায়িত্বেই ছিলে তুমি। আজ সবাই দিশাহারা, দিকভ্রষ্ট। শক্ত হাতে হাল ধরাতে তুমি ছিলে এক এবং অদ্বিতীয়ম আমাদের কাছে।
জানি না, পরলোকে আবার কোনো নতুন দায়িত্বে তুমি বহাল হয়েছ কি না! কিন্তু বীরপাড়ার এক বৃহৎ অংশের লোককে তুমি অসহায় করে দিলে।
আর পরিবারের কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। বৃদ্ধ, অসুস্থ বাবা আর বয়স্ক মা - তাদের এই একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে যে কী অসহনীয় যন্ত্রণা বইতে হচ্ছে!
তবুও জীবন তো বহমান। প্রবহমান নদী যেমন কত তীরে কত ঘটনার সাক্ষী থেকে, প্রতি বাঁকে কত অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার নিয়ে শুধু সমুখ পানে নিরন্তর ধাবমান হয়—জলের স্রোতে আর ঢেউয়ের তালে পুঞ্জীভূত অতীতকে সে ভুলে থাকে। আমাদেরও সময়ের তরঙ্গে, তালে স্মৃতি ম্রিয়মাণ হবে।
কিন্তু তবুও এ-কথা বলতেই হবে - প্রতিটি সমাজ যেন তোমার মতো ছেলে প্রতি প্রজন্মে পায়।
যেখানেই থাকো, ভালো থেকো, পার্থ।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴