তোমার শব্দসিন্দুকে/অণুশ্রী তরফদার
তোমার শব্দসিন্দুকে
অণুশ্রী তরফদার
-------------------------
প্রিয় সখা
সেই ছোট থেকে তোমার ঠিকানা খুঁজে চলেছি একটিবার যদি তোমার সান্নিধ্য পাই সেই প্রত্যাশায়। মহাশূণ্যে পৌঁছনোর বিদ্যা অর্জিত না থাকা স্বত্তেও অর্বাচীনের মতো মনের মধ্যে ইচ্ছেকে পুষে রেখেছি। যদিও জানি আকাশের ঠিকানা নেই, বাতাসের সীমানা নেই, সাগরের শেষ কিনারা দৃশ্য নয় তবুও অনুভবে, স্পর্শে, বোধে সেসবে ডুব দিই। ডুব দিলেই কি আর আনন্দধারা বা রোদনাশ্রুতে ভিজে তৃপ্ত হতে পারি! নিজের কাছে নিজের প্রশ্ন, উত্তরের কোনো দায়বদ্ধতা নেই, তবুও প্রশ্ন করেই চলি। আচ্ছা পরিযায়ী পাখিদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে তাদের একজনের ডানায় যদি বেঁধে দিই তোমার জন্য একটা চিঠি, তারা তো তাদের মরশুম কাটিয়ে ফিরে আসবে। আমি অপেক্ষায় থাকব আর দিন গুনে গুনে ক্যালেন্ডারে চিহ্ন দেব, আমার জন্য উপহার আসবে কিছু শব্দসাজানো কথা তোমার কাছ থেকে, যা আমার অপূর্ণতা, অপারগতায় আশীর্বাদের মলম লাগাবে।
তোমার কথাতেই ক্ষণিকের ভাষা রাখি-
অন্তরগ্লানি সংসারভার
পলক ফেলিতে কোথা একাকার,
জীবনের মাঝে স্বরূপ তোমার
রাখিবারে যদি পাই।
তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে
যত দূরে আমি ধাই,
কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু,
কোথা বিচ্ছেদ নাই।
তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে
যত দূরে আমি ধাই।
( রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
খুব মনে হতো জানো! নিজেকে যখন ডাকঘরের অমল ভাবতাম। অমলের মতো বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে জানালা দিয়ে আলো হতে অন্ধকার পুনরায় আলোর ঔজ্জ্বল্য প্রত্যক্ষ করতাম। না তখন কবিরাজ মশাই ছিলনা বিধিনিষেধের জন্য, তখন তো সব বড়ো বড়ো ডাক্তারের পরামর্শ ও দামি দামি ওষুধ ও পথ্যের চক্রব্যুহ। যেই চক্রব্যুহ থেকে বের হবার মতো শক্তি বা জ্ঞান কোনটাই আমার ছিলনা। সাময়িক দূরের পাহাড়ের পাশের গ্রামের গল্প শুনিয়ে মন ভালো করার জন্য কেউ ছিলনা। পাহাড়ের গ্রামের গল্প অবশ্য সংবাদপত্র ও পত্রিকার সৌজন্যে অল্পবিস্তর জানা যেত।
তবে কোনো দইওয়ালা দই দই ভালো দই বলে হাঁক পারতনা। তখন যতরকমের নিত্যদিনের প্রয়োজন ও শৌখিনতার ফেরিওয়ালার অবাধ হাঁকডাক অস্থির করে তুলত। জীবনজীবিকা ও চাহিদার অতিরিক্ত মেলবন্ধনে সব কেমন যেন মনে হতো ঝড়ের অন্তরীপে সেই ভয়ংকর রহস্য। যেখানে সব হারিয়ে যায়। আসলেই কি হারিয়ে যায়? আমরা চাই চাই খিদে মেটাতে মেটাতে অসংযমী হয়ে উঠি ও উদ্বৃত্ত বস্তু অবহেলায় নষ্ট করি। সেইসব কথা ছিল, আছে ও থাকবে। কিন্তু যেটা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে আঘাত করত সেটা তো যন্ত্রণা। শারীরিক যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করা গেলেও মানসিক যন্ত্রণা মাথার প্রতিটি কোষে প্রতিমুহুর্তে হাজার হাজার সুঁচ ফুটিয়ে রক্তাক্ত করে দিতে চাইত। গল্প করার জন্য সুধাকে পাইনি, দইওয়ালাও আসেনি। তবে মাথায় শান্তির বাতাস দিতে তুমি। তোমার আবির্ভাব তোমার তিরোধান দিন মেনে উৎসবের শঙ্খ বাজালেও কঠিন সময়গুলোতে থাকত তোমার সৃষ্টির ভান্ডার। ওটাই মনে হতো তোমার ঠিকানা- যত গান, গল্প, গদ্য, পদ্য, প্রবন্ধ, উপন্যাস, চিঠি সব যেন তোমার কাছে পৌঁছনোর পথ। না! আমি এতসব নিয়ে নাড়াচাড়া করতে পারিনি, ছুঁয়ে ছুঁয়ে চেয়েছি পেতে তোমার স্পর্শ তোমার স্নেহ।
এখনো ভেসে চলেছি মেঘের মতো, নানা অবয়বে বদলে বদলে কখনো সূর্যের পেছনে কখনো সামনে ঝলসে ঝলসে অজানা স্বপ্নরাজ্যের সন্ধানে। তোমাকে সম্পূর্ণ গ্রহণ করবার ক্ষমতা বা সাহস আমার নেই। নিজের নাম পরিচয় বিখ্যাত করার আকাঙ্খা ভীষণ লোভী বানিয়ে তুলেছে আমাকে, আমাদের। গ্রহণের তুলনায় পরিবেশনের পাল্লার ভার সম্ভবত অহংকারী করে তুলছে বর্তমান সময়কে। অহংকারের জোয়ারে শিল্প-সাহিত্যের পানসি ভাসিয়ে নিতে চাই না। আশ্রয় চাই তোমার সৃষ্টিতে, বন্দি হতে চাই তোমার শব্দসিন্দুকে। অনেক কথা আছে তোমার সাথে। এক চিঠিতে শব্দের সীমানা বাঁধতেই হবে, শেষ করেও শুরুটা এঁকে রাখলাম।
পুনশ্চঃ
অণুশ্রী তরফদার
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴