তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে সবার/উমা দত্ত
তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে সবার
উমা দত্ত
কবিগুরুর চির ভাস্বর হয়ে থাকা জীবনের কিছু অসাধারণ মূল্যবান কথা এবং গল্পের অংশ আমার লেখার মধ্য দিয়ে তুলে ধরবার চেষ্টা করছি ।
কবির সারস্বত সাধনা তো এই ভারতবর্ষেরই সাধনা,
তিনি ভারতবর্ষের সভ্যতা -সংস্কৃতিকে তাঁর নিজের জীবন সাধনার দ্বারা এবং অসামান্য রচনা সম্ভার দ্বারা পরিপূর্ণ করে বিশ্ববাসীকে নন্দিত এবং গর্বিত করেছেন।
কিন্তু বারবার একটা কথাই আমাদের সকলকে ভাবাতে বাধ্য করেছে , কবির মঙ্গল বোধের চেতনা মানবিক ধ্যান ধারণা আজ এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে ক্রমশ যেন ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে। কবির সমন্বয় ভাবনা ভারতবর্ষের ঐক্য সংহতি আবহমানকালের ঐতিহ্য । তিনি যে খণ্ডিত চেতনাকে তার অসামান্য লেখনী দ্বারা বারবার আঘাত করে বিশ্বমানবতার কথা শুনিয়েছেন আর তখনই তো তাঁর লেখনী তে সৃষ্টি হয়েছে......
হে মোর চিত্ত পুণ্য তীর্থে জাগোরে ধীরে
এই ভারতের মহামানবের সাগর তীরে
হেথায় আর্য ,হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন
শক হুন দল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন
তাঁর রচিত বিখ্যাত ছোট গল্প কাবুলিওয়ালা পড়ে অবাক বিস্ময়ে শুধু ভেবেছি আর বিস্মিত হয়েছি কি ভাবে এক আফগান চরিত্র রহমত এক হিন্দু ধর্মের শিশুর প্রতি একজন স্নেহাতুর পিতার কোমল হৃদয়ের ব্যকুলতা নিবিড়ভাবে তাঁর সৃষ্টিতে জীবন্ত করে রেখেছেন।
এই গল্পের অসামান্য চরিত্র কাবুলিওয়ালা রহমত রুজি রোজগারের জন্য তার দেশ তার জন্ম ভূমি আফগানিস্তান ছেড়ে অত্যন্ত প্রিয় স্নেহের শিশু কন্যাকে ছেড়ে সুদূর কলকাতায় আসে , সেখানে এসে দেশে রেখে আসা তার কন্যার মত একটি শিশু কন্যার দেখা পায়, তার প্রতি তার হৃদয়ে স্নেহাতুর পিতার সন্তান বাৎসল্যের আকুলতা জেগে ওঠে । এই শিশু কন্যাটির মধ্যেই সে যেন তার দেশে রেখে আসা কন্যাকে প্রতি নিয়ত অনুভব করে তাই সে শিশু কন্যাটিকে দেখতে নানান অজুহাতে বারবার সেই গৃহকর্তার বাড়ি যাওয়া আসা শুরু করে।
তারপর নানান ঘাত প্রতিঘাতের পর দশ বছর পর সে সেই শিশুটিকে দেখবার আশায় গিয়ে অবাক হয়ে যায়, সে দেখে শিশু কন্যাটি আর ছোট্টটি নেই। রহমত তাকে চিনতে পারলেও মেয়েটি তাকে চিনতে পারে না। রহমতের পিতৃহৃদয় বেদনায় ভরে ওঠে সে ভাবে দেশে তার মেয়েটি ও এরকমই বড় হয়ে গেছে সে ও হয়তো তাকে আর চিনতে পারবে না।
কবি তাঁর এই রচনায় একজন ভিন্ন ধর্মীয় মানুষ রহমতের সন্তান স্নেহ কাতর পিতার কোমল হৃদয়ের আকুলতা অসাধারণ ভাবে চিত্রিত করেছেন।
স্নেহাতুর পিতার সন্তান বাৎসল্য যে, কোন জাত ধর্মের বাঁধনে আঁটকে রাখা যায়না কাবুলিওয়ালা রচনা তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
কবির রচিত কাবুলিওয়ালা গল্পের রহমত চরিত্রের স্নেহবৎসল পিতার কোমল হৃদয়ের অসাধারণ সুন্দর চরিত্রের বর্ণনা শুধুমাত্র তাঁর সৃষ্টিতেই অমর হয়ে আছে।
তিনি যেমন পল্লী ভাবনা কৃষি ভাবনা নিয়ে নিজেকে পল্লী কর্মী বলে পরিচয় দিয়ে গর্ব বোধ করতেন তেমনি আবার শিল্প কলকারখানা নিয়েও ভীষণ ভাবে উচ্ছসিত ছিলেন। তিনি নূতন নূতন বিষয়কে নিয়ে যেমন ভাবনা চিন্তা করতেন তেমনি আবার পুরাতন কে কখনও দূর সরে যেতে দেননি তাঁর অসামান্য রচনার মধ্য দিয়েই তার প্রমাণ আমরা বহু ভাবেই পেয়েছি ।
তিনি ছিলেন দেশমাতৃকার আদর্শ সন্তান ভারতবর্ষের ভূমি ভাগের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে নিজে নেতৃত্বের ভার কাঁধে নিয়ে দেশপ্রেমের মন্ত্রে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেকটি মানবসত্বাকে উজ্জিবিত করতে বিন্দু মাত্র দ্বিধা বোধ করেননি।
কবি তাঁর রচনাসম্ভারে লিখেছেন সাম্প্রদায়িক ধর্ম বুদ্ধি মানুষের যত অনিষ্ট করেছে এমন অনিষ্ট বিষয় বুদ্ধিও করেনি, বিষয়াসক্তির মোহে মানুষ যত অন্যায় যত নিষ্ঠুর হয়, ধর্ম মতের আসক্তি থেকে মানুষ তার চেয়ে বেশি ন্যায় ভ্রষ্ট হিংস্র ও অন্ধ হয়ে ওঠে ।
তাঁর অমূল্য সৃষ্টিতে পরিপূর্ণ হয়ে আছে ভারতবর্ষের কৃষ্টি জীবন। তাই এই মহামানবের চরণে জানাই শতকোটি প্রণাম ।
কবির কথাতে কবির উদ্দেশ্যে বলি ......
এসো যুগান্তের কবি আসন্ন সন্ধ্যার শেষ রশ্মি পাতে
দাঁড়াও ওই মান হারা মানবীর দ্বারে
বলো ক্ষমা কর হিংস্র প্রলাপের মধ্যে
সেই হোক তোমার সভ্যতার শেষ পুণ্য বাণী ।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴