তুমি কি আর ডাকবে আমায়
মনোলীনা রায় কুন্ডু
=======================
রোজই আস তুমি,-তবু তোমার সাথে নিভৃত যাপন আর হয়ে ওঠে না আমার। তোমার ডাক শুনতে পাই, আমি অনুভব করি, কখনো রোদ মেখে কখনো বৃষ্টি ভিজে ঐ তুমি দাঁড়িয়ে রয়েছ! কিন্তু আমার দেখবার সময় কই ? তবু তুমি আসো,আসতেই হয় যে তোমাকে। তোমার ডাক শুনি, সাড়া দিতে বড্ড ইচ্ছে করে, হয়ে ওঠে না । কোনও এক আঁধার রাতে মনে পড়ে "নিষেধের পাহারাতে ছিলেম রেখে-ঢেকে, সে কখন গেছে ফিরে আমায় ডেকে ডেকে "...অথচ এমন তো হবার কথা ছিল না।
তুমি ডাক দিয়েছ কোন্ সকালে, কেউ তা জানে না.. তারপরেই ছেড়ে যাওয়া, তারপরে শুধুই প্রতীক্ষা আর প্রতীক্ষা--সে শুধুই আমার, আমার একান্তই নিজস্ব। কখনো বিছানার লুটোপুটিতে, কখনো মেঘের ঘন নীল অন্ধকারে, কখনো ভাতঘুমের আলস্যে, কখনো খবর কাগজে উপুড় হয়ে তোমার সাথে কেটেছে আমার। কেমন করে বিলি কেটে দাও আমার খোলা চুলে, পৃথিবীর যতকিছু না পাওয়া আছে আমার, আমি আদায় করে নিতে চাই তখন।না, না, কারো কথা শুনি না সেই সময়, তখন শুধুই নিজের কথা শোনা, নিজের কথা বলা! তখন আমি ভালোবাসতে চাইলে ভালোবাসি, ঘুমোতে চাইলে ঘুমিয়ে পড়ি, অথবা জানালার গ্রীল পেরিয়ে রোদমাখা নিমগাছটার ঝিলিমিলি পাতা দেখতে দেখতে স্বপ্ন উড়ান দিই। ছেড়ে দিতে হয় তোমাকে, আর আমার একলা আমিটুকু অমনি হারিয়ে যায়! আবার শুরু হয় তোমার ডাকের প্রতীক্ষা।
আচ্ছা, ছেলেবেলায় আসতে তুমি এমনি করে? মনে পড়ছে, তুমি আসতে ভাইবোনদের খেলার সঙ্গী হয়ে, গরমের ছুটিতে পুজোর ছুটিতে বাবা-মা অফিসে চলে গেলে রাজ্যের দুষ্টুমি নিয়ে হানা দিতে তুমি। আর ক্যালেন্ডারের লাল রঙের দিনগুলোতে বাড়ির সবাই একসাথে খাবার টেবিলে আমিষ গন্ধের সাথে মিশে যেত একটু দূরে ঠাকুমার গোবিন্দভোগ চালের ভাতের ধোঁয়া, ঠিক তখনই তুমি আসতে। বাবার কবিতার পাশে এসে দাঁড়িয়েছ কখনো, কখনো দিদার গায়ের গন্ধে আমার না-দেখা কিন্তু খুব-চেনা ওপার বাংলার বুড়িগঙ্গার ঘ্রাণ হয়ে মিশে থেকেছ। তোমার ডাকেই আমি মেঘের গায়ে, জলের ঢেউয়ে চোখ রেখেছি.."তারা আমায় ডাকে, আমায় ডাকে".. তবু তো যাওয়া হয় না, মেঘের সাথে সোনার খেলা, রূপোর খেলা হয় না; ঢেউয়ের সাথে যাওয়া হয় না ঠিকানাহীন দেশে!! তবু, সে ডাক কান পাতলে আজও শুনতে পাই আমি।
ছেলেবেলা মিলিয়ে যায়, আবোল তাবোল, হ র ব র ল স্মৃতির আলমারিতে বন্ধ করে গোগোল, কাকাবাবু, ফেলুদার হাত ধরে কিশোরী কখন এসে দাঁড়ায় ব্যোমকেশ বক্সীর উঠোনে। তারা বলে, এই যে পৌঁছে দিয়ে গেলাম, আবার দরকারে ডেকো,--এসব তো তুমিই বলে দিয়েছিলে তাঁদের, তাই না? সেই সময়টিতেই দেবদাসকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে খুব। সেইসব বড় হওয়ার টক-ঝাল-মিষ্টি স্বাদ একাকী উপভোগ করার সাক্ষী তুমি!!প্রান্ত কৈশোরের পরতে পরতে রহস্য উন্মোচনের যে ডাক, যে হাতছানি, তাতে সাড়া দেওয়া যায় শুধুমাত্র তোমারই প্রশ্রয়ে। 'ভ্রূ পল্লবে ডাক দিলে দেখা হবে চন্দনের বনে'... তুমিই ডেকে জানিয়ে দিলে চুপিচুপি।
কিশোরী কখন তরুণী হয়ে ওঠে.. কবিতারা মায়া অঞ্জন পরিয়ে দেয় তার চোখে, আয়নাকে প্রশ্ন করলে উত্তর আসে - "তুমিই সুন্দরী সবার চেয়ে"! বুকের মধ্যে গুড় গুড় মেঘ ডাকে হামেশা। তোমার ডাকে গলা মেলায় দখিণ হাওয়া। কলেজবেলার বন্ধুটিকে নিয়ে পথ চলার ডাকটি তুমিই দিয়েছ! জন্মজন্মান্তরের ভবিষ্যৎ-জ্ঞানহীন দিশাহারা যে প্রেম দাঁড়িয়ে আছে নড়বড়ে এক সাঁকোর উপর, যে কোন সময় আলগা হয়ে যেতে পারে যে মুঠি, ফসকে যেতে পারে হাত শুধু সেই ছুঁয়ে থাকার সময়টুকু সত্যি হয়ে থাকে আজীবন; তুমি ছাড়া কেউ তার কিচ্ছুটি জানে না। যতবার বলেছি, "যেতে দাও আমায় ডেকো না" যেতে যেতে সেসব কথা পিছু ডেকে কেন মনে করাও বল তো!!
মেয়েবেলা ফুরিয়ে যায়, কারো স্ত্রী, কারো মা হয় মেয়ে!! আলগা মুঠি শক্ত করতে চেয়ে জোর করে সব চেপে ধরতে চায় সে, আর মুঠি থেকে ঝরে ঝরে পরে আটকে রাখতে চাওয়া সবকিছু। ঝরে পড়া সব সে আবার জড়ো করতে বসে, বারবার জড়ো করে, জড়ো করে আর জড়ো করে! এই ছড়ানো আর কুড়ানো করতে করতেই কখন যে বেলা পড়ে আসে, ঠিক তখন তোমার ডাক শোনা যায়..."বেলা যে পড়ে এল", কিন্তু কোথায় তুমি? আমার "হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে" এই ই তো আমি জানতাম , আমি আরো জানতাম সেই ডাকে সাড়া দিলেই তোমার সঙ্গে দেখা হবে আমার। কিন্তু কই! সাড়া দেওয়া হয় না কি? !না কি সে সাড়া তুমি শুনতে পাও না!
তোমার সেই বারংবারের ডাক আর আমার মুঠো ভরা জীবন কুড়োবার মাঝে তোমার অপেক্ষা,... তোমার কাছে আর যেতে দেয় না আমায়...
"তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে
তখন ছিলেম বহু দূরে কিসের অন্বেষণে।"
তবু, তোমার ডাক আসে, আমি ঘুরে মরি এক খোঁজ থেকে আরেক খোঁজে... না কি সে আমার ভ্রম?!! আর ডাকো না তুমি..সে ডাক শুধু অতীতের অনুরণন মাত্র? তবে কি..."ছুটি ফুরিয়ে গেছে কখন অন্যমনে।"??