তিন কুঁড়ের গল্প/মমতা পাল চন্দ
তিন কুঁড়ের গল্প
মমতা পাল চন্দ
পৃথিবীর সেরা তিন কুঁড়ে এক ডেরায় বাস নিয়েছিল। যাইহোক তিন সাথী জাতে কুঁড়ে হলে হবে কি কেউ কাউকে ছেড়ে যাবার কথা ভাবতেও পারত না। এদের সম্পর্কের সমীকরণ এতটাই মজবুত ছিল। গরম কালে এরা মেজাজে, মৌতাতে একদম রাজাউজীর। এক এক জনের এক এক ধরনের রোয়াবী। কিন্তু কুঁড়েমীতে এদের কোনো ভেদাভেদ নেই সবাই সমমানের - সমগগুণের।
এদের যত সমস্যা সব শুরু হল শীতকালে। শীত পড়তেই এদের মাস্তানি রোয়াবি সব ফুস মন্তর হয়ে গেল। তিনজনের দুজন বাঁকুড়া আর পুরুলিয়ার ছিল। একজন ছিল লোকাল খোদ দার্জিলিংয়ের। এই লোকাল দাজুভাই কম পয়সায় লাল কোঠির কাছাকাছি একটি মোটামুটি ভালো মেস বাড়িতে থাকতো। এবং মেস বাড়িটির পেছনেই ছিল চা বাগান। দারুণ ভিউ। তো একই অফিসে কাজ করার সুবাদে তারা তিনজন সহকর্মী এবং সহমর্মীও হয়ে ওঠে। দাজু ভাই প্রথমে অতি গরমের অঞ্চল থেকে আসা দুজনকে দার্জিলিং-এর আরামের কথা বোঝাতে শুরু করে। তাতে অন্য দুজন over charged হয়ে খুব আনন্দ আর গর্বের সাথে বলতে থাকে সাধেই কি আর এসএসসি-তে Division allocation-এ প্রথমেই দার্জিলিং মেরেছিলাম! নকরি হো তো এয়সা! দার্জিলিং মানেই একটা ব্রিটিশ ব্রিটিশ ভাব- বিদেশি গন্ধ। দার্জিলিং আসার জন্যে কলকাতার লোক হেদিয়ে মরে - আর আমরা দার্জিলিংয়েই থাকি। আ: হা- হা হা- । দাজুভাই খুব ধুরন্ধর এবং সেয়ানা হবার সুবাদে ঠান্ডার সাথে খাপ খাওয়াতে হলে কি কি করলে ঠান্ডা ধারে পাশে ঘেসবে না অন্য দুজনকে বোঝাতে অক্টোপাসের মত প্রথমে খইনী, ঘুটকা, কফ সিরাফ চোলাই এর মহার্ঘ্য স্বাদ আর গুণাগুণ সম্পর্কে উৎসাহিত করে। তারপর থেকে তিনজন সঙ্গের সাথী - অভিন্ন হৃদয় লাল কমলা গ্লাসের বন্ধু। যেহেতু সে স্থানীয় এবং নেপালি ভাষা জানে ফলে দুই আগন্তুক তার মাধ্যমেই ঠাঁই পায় ওই মেস বাড়ীতে। গরমকালে নিজেরা রান্না করলেও শীতকালে তারা পড়লো বিষম বিপদে। জলের বড় অভাব। বাধ্য হয়ে কাজের মাসী রাখতেই হলো। গরম কালে ঘরের পাশে খোলা বারান্দায় বৃষ্টির জল ভর্তি ড্রাম। তা দিয়ে সপ্তাহে দু একদিন স্নান করলেই সুগন্ধি সেন্ট আর ডিও মেখে বিন্দাস চলে যাচ্ছিলো তাদের। কিন্তু যেই না অক্টোবর এলো। ঠান্ডার সাথে সাথে জলের ভীষণ অভাব। কি হবে এবার ? দাজুভাই কাজের মাসি নিয়ে হাজির। রান্না করবে। আর ঝোরার জল আনবে। তবে চার জার জলের বেশি সে আনবে না। ওই জল দিয়েই সব কাজ সারতে হবে তিন জনের। তবে তার জন্য প্রতিদিন আশি টাকা করে মাসিকে দিতে হবে। আর খাওয়া রান্নার জল আলাদা কোম্পানি দিয়ে যাবে আগের মতই। প্রথম প্রথম ভালই চললো কদিন। ভোর বেলা আর সন্ধ্যায় immersion rod এ বালতিতে গরম জল করে না দিলে জলের ঠান্ডা যেন হাত কেটে নেয়। ফলে গরম জলে দাঁত ব্রাশ, মুখ ধোয়া, টয়লেট যেতে গরম জল লাগবেই। কিন্তু এই ঠান্ডায় গরম জল করবে কে ? ঠিক হোলো মাসি করবে। এবং মাসি ভোর বেলা আসবে প্রতিদিন।
কথামত মাসি চলেও এলো।দরজায় ঠক ঠক। কোনো সাড়াশব্দ নেই। কলিং বেল বাজলো কয়েক বার। কেউ দরজা খুলছে না। এবার মাসি শুনতে পাচ্ছে তিন জনের ঠেলাঠেলি। একজন আরেক জনকে বলছে তুই যা। ও বলছে তুই যা। শেষে তিন বিশ্ব কুঁড়ের দরজা খোলা নিয়ে মারামারি। একজন এসে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে। তার গায়ে পুরো লেপ কম্বল পেঁচানো। একজন ট্রাউজার পড়ে চৌকিতে বসা তার গায়ে লেপ কম্বল নেই দাঁড়িয়ে অন্যজনের কম্বল টানছে। আর তৃতীয় জন লেপ কম্বলে মাথা ঢেকে ঘাপটি মেরে পড়ে রয়েছে।
আসলে এরা তিনজন দুটো চৌকি জোড়া করে তিনজন এক সাথে ঘুমোয়। যাতে ঠান্ডা কম লাগে। আর সবগুলো লেপ কম্বল এক সাথে করে নিলে একটু গরমে মাঝ রাতের হাড় কাঁপানো ঠান্ডা থেকে বাঁচা যায়। যাই হোক মাসি ঘরে ঢুকে বালতির জল গরমে দিতে যাবে আচমকা বালতির ঠান্ডা জল নিয়ে রাগে কটমট করতে করতে যে এতক্ষণ লেপ ছাড়ছিল না তার গায়ে ঢেলে দিল দাজু। লেপ না ছাড়া বাঁকুড়ার ছেলে সহ সবাই কাণ্ড দেখে হতবাক! হুহু করে কাঁপতে কাঁপতে বলছে উল্লুক এর নামই তাহলে তোমাদের এর হিরকায় দিনছু ? দাজু হেসে বলছে No ইয়ে আসলি chill of the hill. বাঁকুড়া ভাই বলছে আগে জানলে আসতাম না রে এখানে। এজন্যই সবাই বলেছিল "পাহাড় এক সপ্তাহ ভালো লাগবে এক বছর নয়। পাহাড় পাহাড়িয়াদের জন্য সবার জন্য নয়। সবাই পাহাড়ের সৌন্দর্য্য দেখে- কিন্তু বাস করার কষ্ট জানে না।"
যাইহোক মাসি সব তুলে রোদে দিয়ে বারান্দার পাশে কাঠ জ্বালিয়ে দিল। তারপর রান্না হলে খেয়েদেয়ে সবাই অফিস গেলো। বাঁকুড়া পুরুলিয়ার দুজন বাড়ির মালিককে আলাদা ঘর দেবার অনুরোধ করলে। দা জু ভাই ক্ষমা চেয়ে মিট মাট করে নিল। বললো দোস্ত তিমি লাই মেরও সঙ্গ এস্ত না গর্নুস। ভুল যাও না ভাই। ফলে কিছুটা মিটমাট হলো। নতুন কম্বল এলো। কিন্তু যে জায়গায় দার্জিলিং মিউনিসিপ্যালিটির ওয়াটার সাপ্লাই নেই। সেখানে জলের যে বড়ই কষ্ট। এরা দুজন প্রতিদিন দেখত ওই এলাকার মেয়ে বউরা এক গামলা জল নেয় আর তাতে মাথায় শ্যাম্পু মেখে শুধু মাথা টুকু ধুয়ে নেয়। আর ওই জল দিয়ে হাত পা ধোয়। কিন্তু গায়ে কোনো জল ঢালে না। ওরা মনে মনে ভাবতো এ জন্যই বোধহয় এদের অনেকেরই শরীরে কিছু না কিছু চর্ম রোগ আছে। যে দাজুর সাথে এরা ঘুমায় তার গায়েও চর্ম রোগ রয়েছে হাতে পায়ে।কিন্তু এত ঠান্ডা বলে কথা। চর্ম রোগের কথা ভাবলে জল পাবে কোথায়? আর জল পেলেই বা প্রত্যহ স্নান কি করে সম্ভব ? ঠান্ডায় তো শুধু রুম হিটার নিয়ে ঘুমেই আরাম। জল ছানতে কলজে কেঁপে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে দাজু বললেন আমি ভালো বুদ্ধি দিতে পারি তোমরা যদি কিছু মনে না কর। দূরের দুজন বললো ভন্নুছ দাজু। দাজু মুখ নামিয়ে যা বললো তার অর্থ এই যে মাসি আসতে দেরি হয় তাতে গরম জল পাওয়া মুস্কিল। এদিকে এই নিম্ন চাপ কোনো বাধা মান সম্মান কিছুই মানে না যে। তাই সবচেয়ে better বুদ্ধি হল কাগজে বা পিস বোর্ড এর কাগজে প্রিয় কর্মটি করে প্লাস্টিকে ভরে একটু দূরে চা বাগানের ড্রেনে ঢিল ছুড়ে ফেলে দিলে শুয়োর এসে সাবার করে দেবে। তাতে দুর্গন্ধ যেমন ছড়াবে না। জলও বাঁচবে। তেমনি কাগজ বা টিসু পেপার দিয়ে শরীরের নির্দিষ্ট জায়গাটি মুছে নিলে ঠান্ডা লাগার কোনো ভয় নেই। এতে hundred percent guarantee. পাহাড়ি ভাইয়ের এহেন আয়ুর্বেদ বেশ মনঃপুত হলো অন্য দুই কুঁড়ের।
যাই হোক এদিকে প্রচন্ড ঠান্ডায় মেস বাড়ির মালিক কে বলে দাজু ভাই একটা ছোট fire place এর ব্যবস্থা করে দিলো। একদিন প্রচন্ড ঠান্ডায় fire place একাঠ জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে গেলো তিনজন। এদিকে কাঠ না জ্বলে পুরো ঘর কালো ধোঁয়ায় ঘর ভর্তি হয়ে গেলো। দাজু ভাই কাশতে কাশতে বিপদ বুঝে উঠে দুজনকে ধাক্কা দিয়েও জাগাতে না পেরে কোনো রকম দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে চিৎকার শুরু করলে। দুই কুড়েকে প্রায় আধ মরা অবস্থায় বের করে এনে চোখে মুখে জল ছেটাতে থাকে, জল খেতে দেয়। Fan চালিয়ে হাওয়ায় নিয়ে এলেও এদের ঘুম ভাংছে না দেখে দাজু ভাই ভয় পেয়ে অতীতের কথা মনে রেখে এদের গায়ে জল ঢেলে দিলো। আর তখনই দুজন লাফিয়ে বসে পড়ল। দাজু ভাই এই বিপদের মধ্যেও বলে উঠল - "ম জান্দইছু কি ম দুনিয়া ম সবচেয়ে জব্রা ছ আইলে হেরদইছু ইয়ে লোক তো মহা জব্রা।"
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴