তাদের মার্জনা কর প্রভু/পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
তাদের মার্জনা কর প্রভু
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
সকাল থেকেই পিটার খুব উদাসীন, সব সময় গুনগুনিয়ে গান গায় পিটার। সে হিন্দি গানই হোক আর বাংলা সব সময় খুব খুশি থাকে পিটার। এই চার্চে পিটার ঠিক কবে থেকে আছে কেউ ঠিক জানে না। সবুজ জঙ্গল ঘেরা চা বাগানের মাঝে এত সুন্দর গীর্জা কে বা কারা গড়ে তুলেছিল বলতে পারব না। বছরের বিভিন্ন সময় নানা কাজেকর্মে এই পথে যাবার সময় একবার উঁকি দিয়ে প্রভু যীশুর মূর্তিটা দেখে যাই। কখনো দরজা খোলা পাই কখনো দরজা বন্ধ কিন্তু পুরনো, কাঁধে ময়লা জমা শার্ট প্যান্ট পরা পিটার কে দেখতে পাই। চার্চের পাশে মুলি বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা টালির চালের ঘরটায় পিটারের আশ্রয় স্থল। কথা বার্তা শুনলে পিটারকে বেশ শিক্ষিত বলে মনে হয়। ওর চিন্তা ভাবনা আর পাঁচ জন লোকের থেকে আলাদা নিজের অনটনের সংসার সে ছবি তার মধ্যে স্পষ্ট। এরই মাঝে তিস্তা নদীর পাড়ে একটা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পরিচালিত স্কুলে স্বাধীনতা দিবসে বাচ্চাদের মধ্যে চকলেট, বিস্কুট বিলি করে এসেছে। মাঝে মধ্যে ইংরেজিতে দু একটা বাক্য খুব স্পষ্ট ভাবে গড়গড়িয়ে বলে যায়। ওর গলাটা খুব চেনা চেনা মনে হয়।কিন্তু কার গলার সাথে ওর কথা বলার মিল তা ভেবে পাই না।
সকাল সন্ধেতে পিটার চার্চের সিঁড়ি মোছার কাজটা করে। এই কাজের জন্য তাকে কেউ নিয়োগ করে নি। সকাল সন্ধ্যায় এবং দিনের বিভিন্ন সময়ে চার্চে নিয়মিত দর্শনার্থীদের আনাগোনা চলতেই থাকে। রবিবার মানুষের জনসমাগম একটু বেশি হয়। ঝাঁ চকচকে চার্চের সিঁড়িতে পা দিতেই পিটারের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে।
সেদিন পিটারকে বেশ উদাস লাগছিল। অর্ধেকটা সিঁড়ি মুছে একটা কোনায় বসে চোখের জল মুছছিল। আমাকে দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়ে নিজেকে আড়াল করবার চেষ্টা করল। আমি ওর কাছে যেতেই ও অবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো। আমার বাইকের ডিকিতে দুটো কেক ছিল। একটা ওর হাতে দিয়ে ফিরে আসছি এমন সময় পিটার আমাকে দাঁড়াতে বলল। ঈশারায় আমাকে ওর টালির ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল। একটা আধ ময়লা চাদর বিছানায় পাতা। ঘরের দেওয়ালে একটা ছবি টাঙানো রয়েছে। সেটার দিকে তাকাতেই বুকটা ছ্যাঁক করে উঠল। এ আমি কি দেখছি। একটা পুরনো দিনের ছবি, সেখানে আমি ও আমাদের পুরনো ম্যানেজার গোপী। গোপী অর্থাৎ গোপীনাথ। গোপীকে আমাদের ফার্মের নতুন পার্টনার মিথ্যা আরোপ লাগিয়ে ছাটাই করে দিয়েছিল।
এ ছবি তুমি কোথায় পেলে পিটার ?
পিটার হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। দাদা আমি গোপী, কাজ চলে যাওয়ার পর একটা খাবারের দোকান দিয়েছিলাম। কোনো মতে সংসার চলে যাচ্ছিল। কিন্তু কোনো ভাবেই মেয়ের লেখাপড়া চালাতে পারছিলাম না। তাই একদিন মা,মেয়েকে দুর্গাপুরে রেখে চলে আসি। এই চার্চে আমার খাওয়াটা চলে যায়। বলে সে তার মুখের থেকে পাতলা একটা পর্দা খুলে আমাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল।
গলার স্বর নামিয়ে বলল, "দাদা যারা আমার পেটে লাথি মেরেছে, আমি তাদের কোনো দিন ক্ষমা করতে পারব না। প্রথম প্রথম ভাবতাম প্রতিশোধ নেব। তারপর যখন এখানে আসলাম প্রভু যীশুর আশীর্বাদ আমার ওপর বর্ষিত হতে শুরু করল। আমার স্ত্রী এখন একটা স্কুলে কাজ পেয়েছে। আমি ওদের ক্ষমা করে দিয়েছি। ক্ষমা মহান গুণ। প্রভু যীশু পাপী তাপি সকলের মঙ্গল করুন। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা তাদের বাবা মায়ের সাথে খেলা করছে। বাগানের চারিদিকে ছোটো বড়ো লাল হলুদ ফুল ফুটে রয়েছে। তিস্তা নদীর ওপার থেকে মাইকে গান ভেসে আসছে, " বিশ্ব পিতা তুমি হে প্রভু, আমাদের প্রার্থনা এই শুধু তোমারই করুণা থেকে বঞ্চিত না হই কভু,..... তাদের মার্জনা কর প্রভু। "
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴