তাঁদের মতন রঙিন বাত-পতাকা/পারমিতা ভট্টাচাৰ্য
তাঁদের মতন রঙিন বাত-পতাকা
পারমিতা ভট্টাচাৰ্য
না- সেদিন মেঘ করেনি। না - সেদিন বৃষ্টি পড়েনি। দু-চারটে পাতা ঝরে পড়ে ছিল কিনা জানি না। তবে আর পাঁচটা দিনের মতোই রোদ ঝলমলে একটা দিন। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে আমার মনখারাপ। কেন খারাপ তার কারণ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খুঁজে দেখেছি, পাইনি। রাতে কোনও দুঃস্বপ্ন দেখেছি বলেও মনে পড়ছে না। মাঝে মাঝে এমন হয়। কোথাও কোনও বিচ্ছিন্নতা নেই, তবুও এক অদ্ভুত শূন্যতা জমাট বাঁধে মনের মধ্যে। অতৃপ্তিতে বিস্বাদ হয়ে ওঠে অন্তঃস্থল। যেন নিভৃতে ঘুমিয়ে থাকা ছোট্ট একটি পোকা মাঝে মাঝে জেগে ওঠে ও কিছু সময়ের জন্য মনের মধ্যে তিড়িংবিড়িং করে লাফিয়ে চারদিক ছারখার করে দেয়। এ এক অসুখ! নাম না-জানা অসুখ। এর কথা না-বলা যায় কাউকে, না-পাওয়া যায় শোনার লোক!
কোনো প্রত্যাশা নেই। কোনও আক্ষেপ নেই। কোনও অপেক্ষাও নেই। ফলে প্রাপ্তির সম্ভবনাও জিরো ধরে নিতে পারি। পিছন ফিরে দেখার কিছু নেই। অতীত থেকে যা কিছু নেওয়ার সবই আমার বর্তমান। এক ব্যাগ ভর্তি অভিজ্ঞতা। আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি, মানুষ বৃদ্ধ হয় তাঁর বয়েসে নয়, তাঁর সঞ্চিত অভিজ্ঞতায়। এত কিছু জানা-বোঝা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে সকালে ঘুম ভাঙে একরাশ মনখারাপ নিয়ে। মনে হয় অনেক উঁচুতে গিয়ে চিৎকার করে বলি, ‘তোমারা সবাই শোনো আমার মনখারাপ’। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বুঝেছি, এই মনখারাপ নিতান্তই ব্যক্তিগত। এই মনখারাপের উপশম নিজেকেই করতে হয়। তার জন্য বেশি কিছুর যে প্রয়োজন আছে তা নয়। খুব সামান্য সামান্য মুহূর্ত হয়ে ওঠে জাদুমন্ত্র।
দীর্ঘদিন উত্তরবঙ্গে কাটিয়ে ফিরে এসেছি নিজের শহরে। এই শহরে আমার শিকড় পোতা। অলিগলি, রাস্তা-ঘাট, মানুষজন সবকিছুই আমার হাতের রেখা। ফিরে এসে বুঝলাম, আমার হাতের রেখা সব অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। সবুজ পাতাগুলো হয়েছে হলুদ । পুরনো শাড়ির মতন মলিন। শান বাঁধানো ঘাটে চাপ চাপ শ্যাওলা, পা রাখলেই হড়কে পড়ে যেতে পারি। বুঝলাম, সবই সময়ের কারসাজি।
আগেই বলেছি সেদিন আর পাঁচটা দিনের মতোই রোদ উঠেছিল । প্রকৃতির হিসেবে সবই স্বাভাবিক। তবুও আমার মনখারাপ। কী যেন বলতে চাইছি! কাকে যেন বলতে চাইছি! কী যেন করতে চাইছি! কিন্তু পুরো বিষয়টাই ধোঁয়াশা। পাতলা আস্তরণ। ওপারে আমি বাদে সবাই আছে। আমি বড় একা। চার দেওয়াল যেন পরিত্যাক্ত দুর্গের প্রাচীর। কী অসহ্য এই যাপন। আমি কী চিৎকার করে কাঁদব? চোখ ছলছল করছে, গলার কাছে দমবন্ধ হয়ে আসছে। কিন্তু এক ফোঁটা জল গাল বেয়ে নেমে আসছে না।
একটু পরেই মনে হয়েছে, না না আমি কাঁদব কেন! যা কাঁদার পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়েই কেঁদে ফেলেছি। আমি জয় করতে এসেছি। দুঃখকে জয় করতে হবে। মনখারাপকে জয় করতে হবে।
মুহূর্তের মধ্যে বেরিয়ে গেলাম চার দেওয়ালের গণ্ডি ছিঁড়ে। জানি না কোথায় যাচ্ছি। উঠে বসেছি একটা অটোতে। হঠাৎ দেখি চারজন দৃষ্টিহীন নিজেদের হাত ধরাধরি করে হেঁটে চলেছেন । নিজেদের মধ্যে গল্প করছেন। হাসাহাসি করছেন। কেউ কারোর হাত ছাড়ছেন না। যাঁদের কাছে পুরো পৃথিবীটাই অন্ধকার, অথচ তাঁদের চোখে কত রঙিন স্বপ্ন! তাঁদের মধ্যে থেকে অদ্ভুত এক জ্যোতি ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। সেই জ্যোতি আমার অকারণ মনখারাপকে ‘ছুঁ মন্তর ছুঁ’ করে ভ্যানিশ করে দিল। আমিও যেন তাঁদের মতন রঙিন বাত-পতাকা (windmill)।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴