সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
28-July,2024 - Sunday ✍️ By- গৌতম চক্রবর্তী 223

ডুয়ার্সের জনপদের ভালুক আখ্যান/গৌতম চক্রবর্তী

ডুয়ার্সের জনপদের ভালুক আখ্যান 
গৌতম চক্রবর্তী

মানুষ হাতির দ্বন্দ্ব এখানে নিত্যদিনের। চিতাবাঘ মানুষ সংঘাতের ঘটনা হামেশাই ঘটে থাকে। কিন্তু মেটেলি চা বাগানে পাহাড়ি ভালুকের আক্রমণে কিশোরের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা এবং ভাল্লুক নিধন যজ্ঞের পর একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল যে কেন পাহাড়ি ভাল্লুক ডুয়ার্সের চা বাগানে নেমে এল। তখন আমি মেটেলি সার্কিটের চা বাগানগুলিতে ফিল্ড ওয়ার্ক করছি। সেই সপ্তাহে চালৌনি আর সামসিং চা বাগান ক্ষেত্রসমীক্ষা করে বাড়ি ফেরার পর পরদিনের খবরের কাগজে যখন ফলাও করে বের হল চা বাগিচায় ভালুকের হাতে নৃশংসভাবে নিহত কিশোরটির খবর কার্যত আমি আতঙ্কে শিউরে উঠেছিলাম। ঠিক তার দুইদিন পর মেটেলি ব্লকের চালসা চা বাগানের ৭৮ নম্বর সেকশনে চা গাছ ছাঁটাই এর কাজ করছিলেন শ্রমিকরা। রিফা খেড়িয়া নামে এক শ্রমিক প্রথমে ভালুক দেখতে পান। খবর ছড়িয়ে পড়তেই ওই সেকশনে কাজ বন্ধ করে দেন শ্রমিকেরা। খবর দেওয়া হয় মেটেলি থানা এবং বনদপ্তরকে। মেটেলি থানার আইসি নিলম সঞ্জীব কুজুর সহ পুলিশ ফোর্স ও বনদপ্তরের চালসা, গরুমারা নর্থ, মাল, খুনিয়া এবং বিন্নাগুড়ি রেঞ্জের বনকর্মীরা পটকা ফাটিয়ে, গাড়ীর সাইরেন বাজিয়ে বাগানের ভিতর ভালুকের খোঁজে তল্লাশি করলেও ভালুকের হদিস পাওয়া যায় নি। করোনার নতুন প্রজাতি অমিক্রণকে ছাপিয়ে উত্তরের চর্চার মূল বিষয় হয়ে উঠেছিল ভালুক। চা বাগান এবং গঞ্জ তো বটেই, ভালুক পৌঁছে গিয়েছিল কংক্রিটের জঙ্গলে। ১৬ দিনে ৮ বার ভালুকের দেখা মিলেছে নয়তো উপস্থিতি টের পাওয়া গিয়েছিল। ভালুক আখ্যান রচিত হয়েছিল উত্তরের বিভাগীয় শহর জলপাইগুড়ি এবং মহকুমা শহর মালবাজার সহ মেটেলি, নাগরাকাটা, দুরামারি, আলিপুরদুয়ারের মাঝেরডাবরি ইত্যাদি অঞ্চলে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল হঠাৎ করে কি এমন ঘটে গেল যে পাহাড়ের উঁচু ঢালের দুর্গম জঙ্গলের ঐ বুনোদেরকে পাড়ি দিতে হবে সমতলে? 

সাময়িক শক কেটে গেলে মাথাতে এসেছিল তদন্তমূলক সাংবাদিকতা করে ভালুক হানার সম্ভাব্য কারণ উপস্থাপিত করব। ডুয়ার্সে মেটেলিতে ভালুক পর্বের শুরু। মেটেলির ভাল্লুকটি নেওড়া ভ্যালি জাতীয় উদ্যান থেকে এসেছিল বলে প্রাথমিক অনুমান। মেটেলি বাগান থেকে সরলরেখা বরাবর নেওড়া ভ্যালির দূরত্ব মেরেকেটে ১৫ কিলোমিটার। বন্যপ্রাণ বিভাগের অধিকাংশ বিশেষজ্ঞদের মতামত ছিল সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলেই ভালুকেরা এভাবে লোকালয়ে চলে এসেছে খাদ্যের সন্ধানে এবং এই ধরনের ঘটনা অস্বাভাবিক কিছু নয়। যে ভালুকগুলির অস্তিত্ব টের পাওয়া গিয়েছিল অথচ উদ্ধার হয়নি, সেগুলোর গতিমুখ যে উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে তা নিয়ে কোনো সংশয় ছিল না বনদপ্তরের। এই রকম পরিস্থিতিতে ভালুকের থেঁতলানো মৃতদেহ উদ্ধার হয় বীরপাড়া থানার ভুটান সীমান্তঘেঁষা মাকড়াপাড়া চা বাগান এলাকার ৫২ নম্বর সেকশন থেকে ২০০ মিটার দূরে দলমোড় বনাঞ্চলের ৭৯ নম্বর প্ল্যান্টেশন এলাকায়। প্রাথমিক তদন্তে প্রকাশ পায় মাঝবয়সী ভাল্লুকের দেহের একাংশ অন্য কোনো প্রাণী খুবলে খেয়েছে। পাশাপাশি ভালুকটির পেট চেড়া থাকায় চোরাশিকারের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়নি বনকর্মীরা। ভুটানের জঙ্গলে প্রচুর ভালুক আছে বলে বনদপ্তর সূত্রের খবর। তাই ক্রমাগত ডুয়ার্স এলাকাতে ভালুক চলে আসার ঘটনাকে কেন্দ্র করে উদ্বেগ বেড়েই চলে। প্রকৃতপক্ষে উত্তরবঙ্গে আলাদা করে ভালুক নিয়ে গবেষণা করা বিশেষজ্ঞের অভাব রয়েছে। বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞদের মতে সব জন্তু জানোয়ারের ডেরা ছেড়ে বের হয়ে আসার প্রবণতা রয়েছে। বুনো জন্তু জানোয়ারের জীবন চক্রে অন্য স্থানে চলে যাওয়া এবং ফের নিজের আদি বাসস্থানে ফিরে আসার ঘটনা বিরল নয়। একটি জায়গায় বসবাসকারী একই ধরনের জন্তুর সংখ্যা বেড়ে গেলে তারা খাদ্যের অন্বেষণে অন্য কোথাও চলে যেতেই পারে। পরবর্তীকালে তারা আবার তাদের আদি বাসস্থানে ফিরে যায়। 

ভাল্লুক হাতির মতো যাযাবর কোন প্রাণী নয়। নির্দিষ্ট জঙ্গলেই তাদের বসবাস। কখনো কখনো স্থান পরিবর্তনের রেওয়াজ আছে। সেটা নানা কারণে হতে পারে। শাবক থাকলে সেগুলির নিরাপত্তার জন্য মা ভাল্লুক জায়গা পরিবর্তন করে থাকে অনেকক্ষেত্রে। ২৪ শে নভেম্বর মেটেলি চা বাগানে ভালুক কাণ্ডের পর ভগতপুরে বিপন্ন বন্যপ্রাণীর তালিকাভুক্ত বিরল প্রজাতির ওই বুনোর দেখা মিলল। ভগতপুরের যেখানে ভালুক ঢুকেছিল সেটি মূল বাগান থেকে অনেকটাই দূরে। গাঠিয়া নদীর পাশে বছর পাঁচেক আগে এই টুকরো বাগানটি গড়ে ওঠে। আর পাঁচটা দিনের মতো সকালবেলাতে সানি ওঁরাও, গৌতম ওঁরাও, গগন ওঁরাও, দীপক ওঁরাও সহ সাত শ্রমিক সকালে চা বাগানে কীটনাশক স্প্রে করার কাজে গিয়েছিল। হঠাৎ করে ঝোপের আড়াল থেকে যেন মাটি ফুঁড়ে শ্রমিকদের সামনে হাজির হয় সাক্ষাৎ যমদূত। প্রথমে কেউ তাকে খেয়াল করেনি। কুচকুচে কালো রঙের বিশাল ভালুক দুই পা উঁচিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে পড়তেই হাতের সবকিছু ফেলে সবাই হুড়মুড়িয়ে দৌড়। খবর ছড়াতে দেরি হয়নি। এরপর নাগরাকাটার ভগৎপুর চা-বাগানে দিনভর হুলুস্থুল। বনদপ্তর এর খুনিয়া, ডায়না, মাল, বীরপাড়া সহ একাধিক রেঞ্জ এবং স্কোয়াডের কর্মীরা এসে প্রথমে ভালুকটিকে খুঁজে বের করার কাজ শুরু করে। মাল মহকুমা পুলিশ আধিকারিকের নেতৃত্বে বিশাল পুলিশ বাহিনীও ছিল। একাধিকবার জায়গা পরিবর্তন করে বনকর্মীদের রীতিমতো নাস্তানাবুদ করে এশিয়াটিক ব্ল্যাকবিয়ার প্রজাতির ভালুক যখন ঘুমপাড়ানি গুলিতে কাবু, সূর্য তখন পশ্চিমে হেলে পড়েছে এবং পুলিশ আধিকারিকদের রীতিমত ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার জোগাড়। প্রচুর মানুষ ভিড় করলেও কোনো অঘটন ঘটেনি। ঘন্টাখানেক পর ভালুকটি নিস্তেজ হয়ে পড়লে বনকর্মীরা তাকে জাল বন্দী করে নেওরা ভ্যালির উদ্দেশ্যে রওনা হন। নেওরাভ্যালি নাকি পাশের ভুটানের জঙ্গল কোথা থেকে এভাবে একের পর এক ভালুক আসছে তা নিয়ে দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়ে।

তবে শীত পড়ার কারণে ভাল্লুক পাহাড়ের জঙ্গল থেকে নেমে আসবে এমন তত্ত্বে খুব একটা সায় ছিল না অনেকের। কারণ বিশেষজ্ঞদের মতে ঠান্ডা এলাকাতেই ভাল্লুকের বসবাস। বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞদের মতে, ভালুক একেবারেই আক্রমণাত্মক নয়। একমাত্র তাকে উত্ত্যক্ত করার চেষ্টা করলে তবেই সে প্রতিপক্ষের ওপর আক্রমণ করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে ভালুক নিজে শিকার করে কিছু খায় না। যা তার নাগালের মধ্যে থাকে সেটাই খায়। ফলমূল থেকে শুরু করে মাংস সব কিছুই খেতে পারে। ভালুক শুধু রাতের বেলা চলাচল করে এরকম চিন্তা ভাবনাও কষ্টকল্পনা বলে মনে করেন বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞরা। প্রশ্ন ওঠে ঠান্ডার মরসুমে শীতঘুমে না গিয়ে ভালুক কেন লোকালয়ে চলে আসছে। বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞদের মতে, সব ভালুক শীত ঘুমে যায় না। বরং অত্যধিক ঠান্ডা পড়লে অপেক্ষাকৃত উষ্ণ স্থানে তারা সাময়িকভাবে আসতেই পারে। ভালুক নিয়ে বনদপ্তর যাতে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে ভবিষ্যতের রণকৌশল ঠিক করে সেরকম দাবি উঠে আসে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে। ইতিমধ্যে বিন্নাগুড়ি বন্যপ্রাণ বিভাগের রেঞ্জ অফিসার শুভাশিস রায়ের কাছ থেকে জানতে পারি বানারহাট ব্লকের দুরামারির উত্তর শালবাড়ি এলাকাতে একটি ঝোপের মধ্যে একটি ভালুক দেখতে পেলে মুহূর্তের মধ্যে লাঠিসোটা নিয়ে এলাকার কিছু মানুষ সেটিকে আক্রমণ করার চেষ্টা করলে রুখে দাঁড়ায় স্থানীয় মানুষ মহেশ ওড়াও, পরেশনাথ রায় এবং জাকির হোসেনের মতো কয়েকজন। ভালুক পেটাতে কয়েকজন উদ্যোগী হলেও জাকির এবং মহেশরা তাদেরকে আটকে দেয়। বনকর্মীরা এলাকায় না এসে পৌঁছানো পর্যন্ত ভালুকটিকে বাঁচিয়ে রাখতে তারা একরকম জান লড়িয়ে দেয়। পরে বিন্নাগুড়ি বন্যপ্রাণ বিভাগ সহ মরাঘাট এবং নাথুয়া রেঞ্জের বনকর্মীরা এসে ঘুমপাড়ানি গুলি ছুড়ে তাকে কাবু করে। শারীরিক পরীক্ষার জন্য হিমালয়ান ব্ল্যাকবিয়ার প্রজাতির সাব অ্যাডাল্ট ভালুকটিকে লাটাগুড়ি বন্যপ্রাণী পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রাথমিক চিকিৎসার পর ভালুকটিকে নিরাপদ স্থানে ছেড়ে দেওয়া হয়। 

বনদপ্তর এর অনারারি ওয়াইল্ড লাইফ ওয়ার্ডেন সীমা চৌধুরীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম জলপাইগুড়ি এবং আলিপুরদুয়ারে যে ভালুকগুলি দেখা গিয়েছিল সেগুলি কোন প্রজাতির ভালুক। সীমাদি জানিয়েছিলেন, জলপাইগুড়ি এবং আলিপুরদুয়ারের ভালুকগুলি যেগুলি দেখা গিয়েছিল সেগুলি হিমালয়ান ব্ল্যাকবিয়ার অথবা এশিয়াটিক ব্ল্যাকবিয়ার প্রজাতির। জানতে পেরেছিলাম এর বাইরে ভারতে মালয়ালামসান বিয়ার এবং স্লথ বিয়ার নামে আরও দুই প্রজাতির ভালুক রয়েছে। সানবিয়ার দেখা যায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। এই প্রজাতির ভালুক আকারে ছোট। পরিবেশকর্মী শ্যামাপ্রসাদ পান্ডের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছিলাম, এশিয়াটিক ব্ল্যাক বিয়ার প্রজাতির ভাল্লুককে এর আগে কখনো কোন চা বাগানে দেখা গেছে কিনা তার কোন তথ্য নেই পরিবেশ কর্মীদের কাছে। জেনেছিলাম মেটেলিতে যে ভাল্লুকটি মারা গিয়েছিল সেটি পুরুষ ভাল্লুক। আসলে ঠিক কি কারণে ভাল্লুক ডুয়ার্সের মেটেলির বাগানে চলে এসেছিল তা তখনও পরিষ্কার ছিল না। এটি অত্যন্ত বিরলতম ঘটনা। বর্তমানে উত্তরবঙ্গের নেওড়া ভ্যালি ছাড়াও বক্সা টাইগার রিজার্ভ ফরেস্ট, সিঞ্চল অভয়ারণ্য, এবং সিঙ্গালিলা জাতীয় উদ্যানে ওই প্রজাতির ভাল্লুকের দেখা মেলে। সমতলের জঙ্গলে একটা সময় ভাল্লুক থাকলেও এখন আর নেই। ডুয়ার্স লাগোয়া পাহাড়ি এলাকার ঝালং, বিন্দু, তোদে, তাংতা, সামসিং এর মতো জায়গায় কখনো কখনো ভাল্লুক দেখা গেছে। সেগুলোও নেওড়া ভ্যালি থেকে নেমে আসা ভাল্লুক। যত বার লোকালয়ে ভালুকের উপস্থিতি মালুম হয়েছে তা চিতাবাঘ এবং হাতির থেকেও বেশি। চিতাবাঘ, হাতি, বাইসনের মতো উত্তরবঙ্গের সমতলের জঙ্গলে দেখা মেলা পশু এত ঘনঘন লোকালয়ে ঢুকে পড়ে না বলেই দাবি। তা হলে ভালুকের দেখা বারবার কেন মিলছে লোকালয়ে?


বন দফতরের দাবি ছিল ভালুকের বাস নেওড়াভ্যালি ও ভুটানের পাহাড়ি জঙ্গলে। নেওড়া ভ্যালির ভালুকগুলি আদতে ভুটানেরই বাসিন্দা। কনকনে শীতে ভুটান জঙ্গল থেকে ভালুকের দল নেওড়া ভ্যালিতে নেমে আসে। ডুয়ার্সে নেমে আসা ভালুকগুলি ভুটান থেকে এসেছে বলেও দাবি ছিল। ভুটান থেকে নেওড়া ভ্যালির জঙ্গল হয়ে ভালুক আসতে পারে, সরাসরিও আসতে পারে। ভুটানের পাহাড়ি ভালুকও তেমন কোনও ‘ভয়েই' নীচে নেমে এসেছে বলে দাবি ছিল বনদপ্তরের। ডব্লিউডব্লিউএফের ভারতের প্রধান ভালুক বিশেষজ্ঞ দীপঙ্কর ঘোষের মত ছিল কোন এলাকার ভালুক নেমেছে সেই এলাকার মানচিত্র খতিয়ে দেখে ভালুক নেমে আসার কারণ বোঝা যাবে। জলপাইগুড়ি শহরে ভরা লোকালয়ে তিস্তা উদ্যানে ঢুকে পড়েছিল আরেকটি ভালুক। জলপাইগুড়ির তিস্তা উদ্যানের প্রতিটি কোণে পটকা ফাটিয়েও ভালুকের হদিস মেলেনি। তিস্তা উদ্যানের পাশে থাকা সার্কিট হাউসের পেছন থেকে শুরু করে করলা নদীর বাঁধ ধরে জুবিলি পার্ক পর্যন্ত পটকা ফাটিয়ে তল্লাশি চালান বনকর্মীরা। তিস্তা উদ্যান এর উল্টো দিকে রয়েছে জেলাশাসকের বাংলো। বনকর্মীরা কোনরকম ঝুঁকি না নিয়ে সেখানেও পটকা ফাটিয়ে তল্লাশি চালান। কিন্তু ভালুক বা অন্য কোন বন্যপ্রাণী খুঁজে পাননি বনকর্মীরা। সিসিটিভি ফুটেজ ভালোভাবে খতিয়ে দেখতে বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নেয় বনদপ্তর। বিশেষজ্ঞ টিমের কিন্তু নজরে আসে সিসিটিভি ফুটেজে ভালুকের উপস্থিতি। কিন্তু জলপাইগুড়ি শহর অথবা শহরতলি এলাকায় ভালুকের সামনাসামনি দেখা মেলেনি। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভালুক সংক্রান্ত কিছু ভুয়ো পোস্ট মানুষকে বিভ্রান্ত এবং আতঙ্কগ্রস্ত করে। দেখা গেছে সোশ্যাল মিডিয়ার ভুয়ো ভিডিওতে ভালুক নিয়ে সচেতন হবার থেকে মানুষ আতঙ্কিত হয়েছেন বেশি। তাই কোন ভিডিও বা খবরের সত্যতা যাচাই না করে সোশ্যাল মিডিয়াতে কোন কিছুই পোস্ট করা উচিত নয় বলে ওয়াকিবহাল মহলের দাবি।

বিশেষজ্ঞরা দাবি করেছেন, এই সমতল এলাকা ভালুকের কাছে একেবারেই অজানা, অচেনা। চিতাবাঘ বা হাতির মতো প্রাণীরা লোকালয়ে ঢুকে পড়লেও গা ঢাকা দেওয়ার জন্য জনবসতিহীন নিরিবিলি জায়গা বেছে নেয়। ভালুকের ক্ষেত্রে তা খাটে না। চা বাগানে ভিড়ের মাঝে চলে যেতে দেখা গিয়েছে ভালুককে, শহরের ঘিঞ্জি এলাকায় বাড়িতেও ঢুকে পড়েছে তারা। লোকালয়ের জীবনযাত্রা সম্পর্কে ধারণা না থাকাতেই পাহাড়ি ভালুক গা ঢাকা দিতে পারে নি। সেই সঙ্গে বারবার উঠেছে একটাই প্রশ্ন, কেন নিজেদের স্বাচ্ছ্যন্দের আবাসস্থল ছেড়ে সমতলে নেমে আসছে ভালুকের দল? সমতলে ভালুকের নেমে আসা একেবারেই সাধারণ ঘটনা নয় বলে মেনে নিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বণ্যপ্রাণী বিষয়ে একাধিক সমীক্ষা করা শ্যামাপ্রসাদ পান্ডের মতে, এটি খুবই আশ্চর্যের যে ভালুক এত নীচে নেমে আসছে। ভালুকের আবাসস্থলে বড় ধরনের কোনও বাধা না এলে এমনটা হওয়ার কথা নয়। লক্ষ্যণীয় বিষয় যে স্থানগুলি থেকে ভালুকের দেখা মিলেছে বলে দাবি সেগুলির পাশে কোন না কোন নদী রয়েছে। যেমন ভগৎপুরের ঘটনাস্থলের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে গাঠিয়া। মেটেলি চা বাগানের পাশে মূর্তি নদী। বামনডাঙ্গা চা বাগানের যে স্থানে জোড়া ভালুক দেখতে পাওয়া গিয়েছিল তার একদম গা ঘেঁষে জলঢাকা নদী। বনদপ্তর খবর পেয়েছিলো লাটাগুড়ি জঙ্গলের দিকেও একটা ভালুকের  দেখা মিলেছে। নেওড়া নদী বরাবর গিয়ে সেটিই পরে জলপাইগুড়িতে গিয়েছিল কিনা সে নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কোন একটি নির্দিষ্ট স্থানে পরপর দু’দিন ভালুক দেখতে পাননি স্থানীয়রা। তাই অনুমান, ভালুক ক্রমশ স্থান পরিবর্তন করেছে। যেমন মোগলকাটা চা বাগান লাগোয়া দুরামারি থেকে যে ভালুকটিকে উদ্ধার করা হয়েছিল সেটিকেই তার দুদিন আগে গ্যান্দ্রাপাড়া চা বাগানে দেখা গিয়েছিল বলে অনেকের ধারণা। আবার গুডহোপ চা বাগানের ভালুকটির তো পরে আর সন্ধানই মেলেনি। 

তবে পরিবেশপ্রেমী সংগঠন হিমালয়ান নেচার এন্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশন অর্থাৎ ন্যাফের মুখপাত্র অনিমেষ বসুর মত ছিল যদি ধরেই নেওয়া হয় ভালুক ভুটানের জঙ্গল থেকেই আসছে, সেক্ষেত্রে নদী বরাবর নেমে আসাটা সহজ। কারণ চলার পথে কোনো বাধা-বিপত্তি নেই। তাই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ডুয়ার্সের জঙ্গলে একটা সময় ভালুক থাকলেও এখন আর নেই এই ধারণা সঠিক নয় বলে বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞদের মত। তাঁদের মতে, বক্সার আদমা, চুনাভাটি, মাদারিহাট, বীরপাড়া ব্লকের লঙ্কাপাড়া চা বাগান এবং জঙ্গল অধ্যুষিত অঞ্চল, হান্টাপাড়ার ভুটান লাগোয়া পাহাড়ি জঙ্গলে ভালুক রয়েছে। এছাড়া উত্তরের সিঞ্চুলা, নেওড়া ভ্যালির পাহাড়ি জঙ্গলে তো ভালুক অবশ্যই আছে। লক্ষণীয় বিষয় সাম্প্রতিককালে ডুয়ার্সের যেসব জায়গায় ভালুকের দেখা মিলেছে তার বেশিরভাগই নদীর ধারে। এখানকার বেশিরভাগ নদীর উৎস স্থল ভুটান। তাই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে নদী বরাবর প্রতিবেশী দেশ ভুটান থেকে ভালুক নেমে আসতে শুরু করেছে কিনা। যদি তাই হয় তাহলে এর প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানের দাবি উঠেছে। ভালুক নেমে আসার পেছনে অনেকেই নেওড়া ভ্যালি জঙ্গলে খাদ্য সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছেন। কিন্তু এককথায় সরলীকরণ করে দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ বনদপ্তর এর গরুমারার বন্যপ্রাণ শাখার ডিএফও অংশু যাদবের সঙ্গে যখন কথা বলেছিলাম তিনি পরিস্কার জানিয়েছিলেন ঠিক কি কারণে ভালুক আসছে তার বিজ্ঞানসম্মত সুনির্দিষ্ট কারণ এককথায় বলা খুব শক্ত। ভালুক আক্রমণের সূচনা হয়েছিল ২০২১ সালের ২৪ শে নভেম্বর মেটেলি চা বাগানে। ক্রমে ভগতপুর চা বাগান, নাগরাকাটার বামনডাঙ্গা তন্ডু চা বাগান, মালবাজার, দুরামারি, আলিপুরদুয়ারের মাঝেরডাবরি চা বাগানে ভালুকের আগমন ঘটে। 

ভালুকের সম্ভাব্য আগমন নিয়ে হৈচৈ শুরু হয়ে যায় জেলা শহর জলপাইগুড়ি, গ্রামীণ এলাকা গড়ালবাড়ি এবং ধূপঝোরাতেও। বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞেরাও কোন সম্ভাব্য কারণ নির্দিষ্ট করে তুলে ধরতে পারেনি। এদিকে ভালুক কেন ডুয়ার্সে চলে আসছে তা নিয়ে নিত্যনতুন নানা তত্ত্বের আবির্ভাব হচ্ছিল। খাদ্যসংকট, অরণ্যসংহার, নগরায়ণের মত কারণের পাশাপাশি ডেরা ছেড়ে ভালুকদের এমন চলে আসা ভূমিকম্প জাতীয় কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ইঙ্গিত কিনা এমন প্রশ্ন ঘোরাফেরা করতে শুরু করেছিল পরিবেশ প্রেমীদের মধ্যে। তাদেরকে আবার ভাবাচ্ছিল নিজেদের শীত ঘুমের সময়ে নিজেদের আবাসস্থল নয় এমন এলাকায় ভালুক কেন চলে আসছিল। এভাবে ভালুক চলে আসায় বাগানগুলি যে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল তা বলাই বাহুল্য। মেটেলি চা-বাগানের সিনিয়র ম্যানেজার ডি বি ধীলনের সঙ্গে কথা বলে জেনেছিলাম চিতাবাঘ এবং হাতির আতঙ্ক ছিল প্রায় প্রতিদিনের ঘটনা। এবার নতুন সংযোজন হলো ভালুক। পরিবেশপ্রেমীদের মতে, ভালুক সাধারণত পাহাড়ের গুহায় থাকে। আর্থমুভার যন্ত্রের সাহায্যে ডুয়ার্স লাগোয়া পাহাড় কেটে পাথর তোলা হচ্ছিল বলে তাতে ওরা বাসস্থান হারাচ্ছিল। নিরাপদ বাসস্থানের খোঁজে ভালুকদের বেরিয়ে পড়ার এটা একটা কারণ বলে অনেকে মনে করেন। প্রশ্ন উঠছে ভুটান পাহাড় থেকে ওরা নেমে আসছে কেন? কতটা পথ পেরোলে তবে জলপাইগুড়ি পৌঁছনো যায়? নেওড়াভ্যালি জাতীয় উদ্যান বা ভুটানের পাহাড়ি জঙ্গল দুইয়ের যেখানেই ভালুকের আবাস সেটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অন্তত দশ হাজার ফুট উচুতে। এমনটাই দাবি বন দফতরের। এত পথ নেমেই কুয়াশার ভোরে ভালুকটি ঢুকেছিল জলপাইগুড়ি শহরে। সকাল ৭টার কিছু পরে তাকে তিস্তা উদ্যানে ঢুকতে দেখা গিয়েছে সিসি ক্যামেরার ফুটেজে। বন দফতরের ধারণা তিস্তার পাড় ধরে ভালুকটি আসতে পারে। 


এর আগে জলপাইগুড়ি শহরের কাছাকাছি ভালুক-দর্শন হয়েছিল মেটেলি চা বাগানে। তার পর নাগরাকাটার ভগৎপুর চা বাগানেও ভালুকের দেখা মেলে। অনুমান, সেখান থেকেই ভালুকটি জঙ্গল নদীপথ পেরিয়ে জলপাইগুড়ি পৌঁছেছে। ধূপগুড়ির ডাউকিমারিতে ভালুক দেখা গিয়েছে বলে খবর চাউর হয়। সেটিকেও অবশ্য দেখা যায়নি। তবে ডাউকিমারি থেকে লোকালয় ও নদীপথেও পৌঁছনো যায়। সে পথ ঘন বসতিপূর্ণ। এই দুই পথেই ভালুক এসেছে বলে অনুমান। পাহাড় থেকে কেন এত ভালুক নেমে আসছে বন দফতর স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারেনি। ভুটান পাহাড়ে কি ভালুক কোনও কারণে ভয় পেয়েছে? জবার খুঁজে পাচ্ছে না বন দফতরের আধিকারিকেরা। বন দফতরের একটি সূত্রের দাবি, নেওড়ার জঙ্গলের আশেপাশে থাকা কোনও ক্যামেরায় ভালুকের ছবি দেখা যায়নি। আশেপাশের নরম এলাকায় পায়ের চিহ্নও মেলেনি বলে দাবি। সে ক্ষেত্রে অনুমান করা যেতে পারে, সব ভালুক ভুটান থেকেই নেমে আসছে। বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে অন্তত পনেরোটি ভালুক দেখতে পাওয়া গিয়েছে। সাধারণত বুনোরা লোকালয়ে ঢুকে শিকার ধরেই চম্পট দেয়। মালবাজার শহরের একটি ভবনে ঢুকে পড়া ভালুকটি ভাঁড়ার ঘরে বসেই খাওয়া সারে। পেট ভরার পরেও ঘরেই বসেছিল ভালুকটি। পরিবেশপ্রেমী কিছু কিছু সংগঠনের মতে ভাল্লুক আক্রমণাত্মক নয়। নিজেরা আক্রান্ত এরকম মনে করলে তারা পাল্টা আক্রমণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে তাদের টার্গেট থাকে প্রতিপক্ষের মাথার অংশ। এর আগে পাহাড় এবং সিকিমের ভাল্লুকের আক্রমণে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে সেক্ষেত্রেও মাথার অংশে হামলা চালায় জন্তুটি। বনে খাদ্যের নিদারুণ অভাব ছিল। ফলে বন্য প্রাণীরা ঢুকে পড়ছে খাবারের খোঁজে। 


ডুয়ার্সের জঙ্গল ছিল গভীর। বহু ধরনের ছোট-বড়-মাঝারি গাছের ঘন জঙ্গল। আজ সে জঙ্গলে চরম দারিদ্র বিরাজ করছে। বাইরে থেকে সবুজ চেহারা চোখে পড়ে ঠিকই, কিন্তু ভিতরটা ফাঁকা। জঙ্গলে বন্য প্রাণী বিপন্ন। চরম খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। পশুদের জায়গা দখল হয়ে যাচ্ছে। চোরাপাচার ডুয়ার্সের জঙ্গলে এখন হামেশাই ঘটছে। কেবল হাতি গন্ডারই নয় হত্যা করা হচ্ছে অন্যান্য ছোট ছোট বন্যপ্রাণ। প্রতিনিয়ত মানুষের সঙ্গে বন্য প্রাণীর সংঘাত চলছে। বন্য প্রাণীদের উপর নানাভাবে আক্রমণ শানাচ্ছে মানুষ। যথেচ্ছভাবে জঙ্গলের গাছ কাটা পড়ছে। বেআইনি পথে সেই কাঠ পাচার হচ্ছে। চোরাশিকারিদেরও বাড়বাড়ন্ত। এসব কিছুর কারণ প্রশাসনের উদাসীনতা। সমস্তরকম অব্যবস্থায় ডুয়ার্স তথা ডুয়ার্সের বন্যপ্রাণ আজ ভীষণ বিপদগ্রস্ত। মাল ব্লকের গুরজংঝোরা, পাথরঝোরা সহ বিভিন্ন চা বাগান এলাকায়, ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক, মেটেলি ব্লক এর বড়দীঘি চা-বাগান সহ ধূপঝোরা এলাকা, গরুমারা নর্থ রেঞ্জ, নাগরাকাটা সহ বিভিন্ন এলাকায় বনদপ্তর এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষ থেকে ভালুক মানুষ সংঘাত রুখতে দিনে তো বটেই, রাতেও বনবস্তি এবং সাধারণ বাসিন্দাদের সতর্ক এবং সচেতন করার জন্য সতর্কতামূলক প্রচার জারি রাখা প্রয়োজন। বিভিন্ন চা বাগানে গিয়েও সচেতনতামূলক আলোচনা করা একান্তই জরুরী। পর্যটনের উপর ডুয়ার্সের অর্থনীতি নির্ভরশীল, তার উন্নয়ন আটকানো যাবে না। জঙ্গল থেকে বনবস্তি উচ্ছেদ করে ফেলাও সম্ভব নয়। কিন্তু আর যাতে না বাড়ে সেদিকে নজর রাখতে হবে। বনবস্তির মানুষদের বন্য প্রাণীদের জীবনযাপন সম্পর্কে সচেতন করার প্রচারমূলক কাজ নিরন্তর চালাতে হবে। পশুদের জায়গায় মানুষ দখল নিলে সংঘাত অনিবার্য। 

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri