ডুয়ার্সে একটি রাত/নবনীতা
ডুয়ার্সে একটি রাত
নবনীতা
~~~~~~~~~~~~
ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল হঠাৎই ৷ কি এক অসময়ে, অকারণে! অবশ্য সবকিছুর কারণ থাকতে নেই৷ মাঝে মাঝে অনিয়ম ভালো৷ এই একটু আধটু অনিয়মগুলো, খুব নিয়ম করেই নিয়মের মাঝে সে দিয়ে যায় আপনা আপনি। বরাবর৷
এখন এ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বাড়ি যাবে কীভাবে ভেবে পেল না অরণ্য ৷ উইকেন্ডে এদিক ওদিক বেরিয়ে পড়া অরণ্যর একটা নতুন অভ্যেস হয়ে উঠেছে, নতুন চাকরিটা পাবার পর থেকেই৷ অরণ্যর বাবা-মা দুজনেই রিটায়ার্ড পেনশনার ৷ অরণ্য তাদের একমাত্র সন্তান৷ শিলিগুড়ি শহরের এক শহরতলীতে বেশ খানিকটা জায়গার উপর অরণ্যদের সুদৃশ্য তিনতলা বাড়ি৷ অরণ্যর মা সারাদিন পুজোআর্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, আর তার বাবা বাগান আর টিভির খবর নিয়ে ৷ অরণ্যকে নিয়ে তাদের বিশেষ আদিখ্যেতা নেই বা কোনোদিনই ছিল না৷ এই শহরতলিতেই অরণ্য বেড়ে উঠেছে মুঠো মুঠো অক্সিজেন আর এক লাগাম ছাড়া অদম্য শৈশব নিয়ে ৷
এখন অরণ্য প্রতিষ্ঠিত৷ একটি নামকরা বেসরকারি সংস্থার ম্যানেজার৷ দু বছরের ভেতর কাজের দক্ষতা দেখিয়ে এই জায়গায় যাওয়া চারটিখানি কথা নয়৷ তাই বাবা মায়ের বিশ্বাসের গভীরতা বেড়েছে আরো ৷
চারিদিকে ঝুপ ঝুপ করে সন্ধ্যা নামছে। অন্ধকার যত গভীর হচ্ছে অরণ্যর মনের ভেতরের আলোও যেন নিভে আসছে ৷ কেন যে ঘুমোতে গিয়েছিল? দুপুরের ভাতঘুমটাই কাল হল। খেয়ে উঠে বেরিয়ে পড়লেই এতক্ষণে বাড়ির বারান্দায় বসে মায়ের হাতের চাটুকু অন্তত পেত ৷ রাস্তা তো মোটে দেড় ঘন্টার ৷ এখন এই নির্জন হোমস্টেতে সে কি করবে রাতভর৷ আর একটি ফ্যামিলি যারা ছিল, আজ সকাল সকালই তাদের বেরিয়ে পড়তে দেখেছে অরণ্য ৷ ঐ পরিবারটির সাথে আলাপ হয়েছিল লাঞ্চের সময় ওরা মালদা থেকে এসেছিল। বোধহয় ট্রেন ধরবে তাই ...
হাতঘড়িতে সময় দেখে সে৷ বেলা সবে সাড়ে পাঁচটা তাতেই জঙ্গলে রাত নেমেছে৷ বৃষ্টি যেন আরো তোড়জোড় করে এল৷ হঠাৎ দরজায় আঘাত৷ তাড়াতাড়ি দরজা খুলতে যাবে এমন সময় লোডশেডিং৷ দরজা খুলে ওপারে যাকে দেখল সে একজন মহিলা৷ মৃদু আলোয় তার চোখ মুখ কিছুই আঁচ করতে পারল না অরণ্য। শুধু একটা কমদামি ট্যালকম পাউডারের বুনো গন্ধ নাকে এসে আটকে গেল। আর রিনঝিন চুরির শব্দ টিনের চালের বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে কান ভরে তুলল৷ মহিলাটি হঠাৎ বলে উঠল - "তুই কি আজ রাতে ইখানেই থাকবি বাবু?" বুকটা কেমন কেঁপে উঠল অরণ্যর ৷ এত মিষ্টি মেয়েলি আওয়াজ সে আগে কখনও শুনেছে কিনা মনে করতে পারছে না৷ অফিসে তো মেয়ে বলতে দু জন৷ একজন বেগম নাসিফা৷ আর একজন লিলি ছেত্রী৷ দুজনেরই কথায় কর্পোরেট জগতের বলেই কিনা কোনো মাধুর্য খুঁজে পায় না সে। মায়ের গলার আওয়াজ বড় সুন্দর৷ কিন্তু গম্ভীর। রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলে যেন পৃথিবীর সবকিছু স্থির হয়ে মায়ের গান শুনতে চায়। কিন্তু এ মেয়ের গলায় কি যেন এক যাদু আছে ৷
" কিরে বাবু বল ৷ সে বুঝে জোগাড় কুরতে হবে তো ৷
আমার মরদটাই এদের রান্নাঘর সামলায় কিন্তু আজ দুপুরে শহর মালবাজারে গিয়ে আটকে গ্যাছে ৷ মেলা বিস্টি সিখানেও ৷ উখানে আমার ভাই থাকে না, ওরা ওকে ছাড়ছে না৷ তাই আমি ....৷ তোর ঘরে আলো এনে দিচ্ছি দাঁড়া। ইখানে একবার আলো গেলে খুব দেরি করে। আর বিস্টি না থামলে তো আলো কখন্ আসবে ঠিক নাই ৷"
"হ্যাঁ ..থাকব ৷ তুমি রাঁধবে?"
খিলখিল করে একটা পাহাড়ি ঝরনা বয়ে গেল অরণ্যর চোখের সামনে দিয়ে যেন ৷
"কি খাবি বল্ ?"
নিজের আচরণে একটু লজ্জা পেল অরণ্য৷ সংযত হতেই ভাবল থাকব এমনটা তো সে মুহূর্ত আগেও ভাবেনি ৷ বরং দেড় ঘন্টার পথ ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি দেবার জন্যই তৈরি হচ্ছিল। শুধু বৃষ্টিটা যদি একটু ধরত৷ তবে তার মুখ দিয়ে কথাগুলো আচমকা কিভাবে বেরিয়ে গেল সে একটু অবাক হল ৷ যাকগে এখন তার প্রাথমিক কাজ বাড়িতে মা বাবাকে একটু জানিয়ে দেওয়া আজকের শেডিউলের আচমকা পরিবর্তনটি ৷
- তবে ইচ্ছে থাকলেও তুই যেতে পারতি না আজ বাবু৷ মঙলু দাদা এসে বলল ডুডুয়া নদীর উপর কাঠের ব্রিজটা কাত হয়ে রইছে জলের জন্য ৷
-অ্যা ....কী... অরণ্য একটু আনমনা ছিল। কানের পাশ কেটে কথাগুলো বেরিয়ে যেতেই সম্বিত ফেরে৷ তার মানে আজ তার থেকে যাওয়াটাই নিয়তির বিধান!
কথাকটা বলে আর দাঁড়ায় না মেয়েটি ৷ নদীর ঢেউয়ের মতো ছিমছাম চলে যায় নুড়ি বিছানো সরু পথ দিয়ে৷
ভীষণ একটি বাজ পড়ার বিকট আওয়াজে প্রায় লাফ দিয়ে উঠে বসল অরণ্য। ঘরে একটা মৃদু আলো ছড়িয়ে পড়েছে। কাঠের শেল্ফটার উপর কে যেন একটা মোমবাতি রেখে গেছে৷ বাইরে বৃষ্টি একটু ধরেছে কিনা দেখতে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় সে৷ সামনে ঘন জঙ্গল আর অবিরাম বৃষ্টিতে সব যেন মুছে গেছে কালো কালি দিয়ে৷ গাটা একটু ছমছম করে উঠল অরণ্যর৷ শুনেছে এই এলাকায় রাত বাড়লেই মাতাল হাতির বড্ড উৎপাত শুরু হয়৷ আর বাড়িটাকেও রাতে কেমন হানা বাড়ির মতো দেখাচ্ছে। জনহীন এই প্রান্তে অরণ্যর নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হতে থাকে।
দরজায় একটা মৃদু শব্দ হয় ৷ দরজা খুলতেই অরণ্য দেখে সেই মেয়েটি৷ একহাতে একটি থালা ও অন্য হাতে একটি গ্লাস৷ কথা বলার সুযোগ না দিয়েই মেয়েটি ঘরে ঢুকে উঁচু একটি টেবিলের উপর খাওয়ারটা রাখে৷ তারপর আচমকাই কাঠের মেঝেতে পা গুটিয়ে বসে বলে :
-বাবু তুই খা , আমি থালটা লিয়ে একবারে যাই ৷ তুই ভালো করে দরজা টেনে শুবি ৷
অরণ্যর যে বেদম খিদে পেয়েছিল তা এইমাত্র অনুভব করল৷ খাওয়ার থালার উপর প্রায় হামলে পড়ে নিমেষে ভাত, তরকারি, মাংস সাবাড় করে দিল৷ মেয়েটি মেঝেতে বসে অবাক চোখে দেখছিল অরণ্যর খাবার ধরণ। খাবার শেষে অরণ্য মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল তার নাম ৷
খিলখিল হাসিতে আবার গড়িয়ে পড়ে মেয়েটি
- অরচনা আছে বাবু ৷ তা তোর লাম ?
- অরণ্য
- অরঅন ...কি ..কি মতলব আছে উটার ?
- অরণ্য মানে বন, জঙ্গল, ফরেস্ট ..
আবার বিরাট শব্দ তুলে হাসিতে লুটিয়ে পড়ল মেয়েটি। হাসি তো নয় যেন ফোয়ারার জল ... যেন যেন. অরণ্য আর উপমা খুঁজে পেল না ৷ দুটো বড় মোমের অনতি উজ্জ্বল আলোতে যতখানি দেখা যায় তার চেয়েও বেশি যেন দেখল অরণ্য অর্চনাকে ৷ কালো পাথর খোদাই করে কোনও এক নিপুণ ভাস্কর তার সবটুকু দক্ষতা যেন ঢেলে দিয়েছে এই মেয়েটির মুখে চোখে, ঠোঁটে আর ...শরীরে৷ অরণ্য অবাক বিস্ময়ে দেখতে থাকল অর্চনাকে৷
অর্চনা বোধহয় লজ্জা পেল। কথা দিয়ে অরণ্যর মনটা ঘোরাতে চাইল৷ কিন্তু অরণ্যের মধ্যে কিভাবে যেন এক বন্য সত্তার আবির্ভাব হতে থাকে। অরণ্য উপলব্ধি করে তার ভেতরকার অস্বাভাবিক অস্থিরতা। অরণ্য যেন আর অরণ্য নেই। যেন আবার কোনো অনিয়ম চুপিচুপি ঢুকে পড়েছে অরণ্যের শরীরে৷ কিন্তু অরণ্য কিছু করতে পারে না।
বাইরে বৃষ্টির প্রকোপ একটু ধরেছে হয়ত আর ভেতরে তখন অরণ্যর মন মস্তিষ্কে এক আদিবাসী রমনীকে পাওয়ার লালসা বেশ জাঁকিয়ে বসছে ৷
রাত তখন প্রায় শেষ৷ বৃষ্টি ধরে এসেছে৷ পাশের কোনো ছোটো ঝোরার জল অবিরাম কুলকুল করে বয়ে চলায় ভোরের নৈঃশব্দ ভেঙে দিচ্ছে অনায়াসে৷ অরণ্য চুপচাপ ঘর লাগোয়া বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। পকেট থেকে একটা দামী সিগারেটের প্যাকেট বের করে তার পর ভোরের বিশুদ্ধ বাতাস উপেক্ষা করে গিলে নেয় কতগুলো মারণ ধোঁয়া। পিছন ফিরে ঘরটার দিকে একবার তাকায় আর তারপর ধীরে ধীরে মিশে যায় পাহাড় জঙ্গল নদীর ঐ দেশে ৷
বিস্তর খোঁজাখুঁজির পরও অরণ্যকে পায় না তার বাবা মা ৷ শুধু এটুকু জানা যায় ডুয়ার্সে, ডুডুয়া নদীর কাছের ঐ হোমস্টেটি চালায় এক বৃদ্ধ নেপালি দম্পতি৷ তাদের রান্নার সাহায্যের জন্য থাকে একটি আদিবাসী ছেলে ৷ ছেলেটির বয়স খুব বেশি হলে কুড়ি৷ তার কোনো পরিবার পরিজন, আত্মীয়-স্বজন কখনও ছিল না বলে জানায় সেই দম্পতি ৷ তারা এও জানায় অরণ্য মিত্র বলে শহর শিলিগুড়ি থেকে এক বছর সাতাশের যুবক এক রোববার সকালে আসে তাদের হোম স্টেতে এবং সে বিকেল পাঁচটার পরেই কোনো এক সময় না জানিয়ে বেরিয়ে যায় ৷ আর একটা শেষ কথা... জানা যায় সেই দিন অথবা সেই রাতে ঐ এলাকায় কোনোরকম বৃষ্টি বাদল হয়নি ৷
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴