ডাক এবং বহুমুখিতা
ডাক এবং বহুমুখিতা
উত্তম চৌধুরী
-------------------------------
"ডাক" শব্দটি ব্যাপক এবং বহুমুখী। "ওয়ান্ডার থার্স্ট"-এর কবি জেরাল্ড লুইস গোল্ড বলেন যে তাঁকে সমুদ্র ডাকে, তারারা ডাকে এবং আকাশ ডাকে। আবার নদীর ডাক, পথের ডাক এবং পাখিদের ডাকও কম নয়। এদের জন্যই তিনি বাইরে বেরিয়ে পড়েন। তাঁর কোনও দোষ নেই। এদের ডাকে সাড়া না দিয়ে তিনি থাকতে পারেন না। আমিও প্রকৃতির ডাকে ডুয়ার্সের অনবদ্য সৌন্দর্যের ভেতর ঢুকে পড়ি। এখানকার মানুষ, জীবন, পাহাড়নদীবনঝোরাখোলা দুর্নিবার টানে। তবে শৈশব থেকে এ পর্যন্ত কিছু ডাক আশ্চর্য মোহময় ও অমোঘ। মা-বাবার ডাক এখনও কানে বাজে। তাঁদের স্নেহ মিশ্রিত বা শাসনের ডাক কখনও ভোলা যায়! কিশোর বেলায় বন্ধু-বান্ধবীদের ডাক ছিল নিশিডাকের মতোই। বিকেল হলেই খেলার ডাক পড়ত। আমরা দল বেঁধে খোলা মাঠে চলে যেতাম। ছোঁয়াছুঁয়ি, গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা, রুমালখেলা, কানামাছি, এক্কাদোক্কা,রেলগাড়ি, গুটিখেলা, ডাংগুলি, ফুটবল, হাডুডু কী না ছিল! সেইসব দিনগুলো হাতছানি দিয়ে ডাকে।
বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন পার্বণের ডাক আনন্দের ভেলায় ভাসিয়ে নিত। সেই সময়ে কোনও কোনও কিশোরীর চোখের ডাক, রঙিন চুড়ির ডাকও ছিল অপ্রতিরোধ্য। মার্বেল খেলার ডাক, ডিগ্গেল খেলার ডাক ভীষণ টানত। উলটো করে ডাকা হত লর্বেমা-আ-আ বিলখে-এ-এ। অনেকটা মদেশীয় মনে হচ্ছে না! আমার বাল্যবন্ধু জয়ন্ত অক্ষর উলটিয়ে ডাকত মত্তউ। আমিও ডাকতাম ন্তয়জ। রাস্তা থেকে তাঁর আহ্বান আসত, বেরিয়ে পড়তাম সাইকেলের রিং বা টায়ার নিয়ে। দুজনেই সরু গলিতে দৌড়োতাম,আলপথে ছুটতাম বা মাঠে মাঠে সময় কাটাতাম। আমাদের কুকুর কাল্টু এবং জয়ন্তদের কুকুর ভোলাও এক ডাকে সাড়া দিত এবং আমাদের সঙ্গে দৌড়োত। পারিবারিক ডাক বিশেষত পড়ার সময়, স্নানের সময়, খাবার সময়, শোবার সময় কী করে ভুলি! মাঝে মাঝে নদীতে দল বেঁধে স্নান করতে যাওয়ার ডাক পড়ত। ডুবডুব খেলা চলত যতক্ষণ না কেউ কঞ্চি হাতে জল থেকে ওঠার জন্য ডাকছে। নদীতে বাহ দেখা বা মাছ ধরার ডাক পড়ত। নদীর পাড়ে কুলের বনে যাওয়ার ডাকও কম টানত না। ডাক পড়ত ঝড়-বৃষ্টি হয়ে গেলে গাছের নীচে পড়ে থাকা আম,জাম কুড়োনোর।
আরও একটু বয়সে দেহের এবং মনের ডাক অনুভব করেছি। সে ডাক রহস্যময়। কিছুটা বোঝার, কিছুটা না বোঝার। ভাললাগা কিংবা ভালবাসার ডাক। হৃদয়ে স্বতঃস্ফূর্ত এক অন্য ডাক অনুভূত হয় দীর্ঘ দিন ধরে। সৃজনের ডাক। আমার আমি নিরন্তর ডেকে চলে। তা লেখালেখির ক্ষেত্রে বা ছবি আঁকার ক্ষেত্রে যাই হোক না কেন, সে তাড়িয়ে বেড়ায় মাইল মাইল। ভেতরের সেই আমির ডাক সমগ্র সত্তায় ছড়িয়ে আছে বলেই সৃষ্টিকর্ম অব্যাহত আজও।
এখনও নস্টালজিক হয়ে উঠি ফেরিওয়ালার ডাকে, বরফ বিক্রেতার ডাকে, পিওন বা ধুনুরির ডাকে। দুধওয়ালা, সবজিওয়ালা, ভাঙারিওয়ালা, শিলনোড়া ধার করানোর ডাক দুর্বার টানে। জীবনের ভালমন্দে মিলিয়ে নিই পেঁচার ডাক, বেড়ালের ডাক, টিকটিকির ডাক। আনন্দ-বেদনা ডাকে, আত্মীয়-অনাত্মীয় ডাকে, শত্রু ডাকে,মিত্র ডাকে। আমি কিন্ত ডাকলেই যাই না। নিজস্ব বোধ ও বুদ্ধির ডাকে সাড়া দিই। বিবেকের ডাক, বিদ্রোহের ডাক, আপসের ডাক মাঝে মাঝে মিলেমিশে হেঁটে চলে। জন্মের ডাক, আর্তের ডাক, মুমূর্ষুর ডাক, মোহমায়া থেকে বেরিয়ে আসার ডাক যথেষ্ট বিচলিত রাখে। কখনও অনন্তের ডাক শুনি। " সানসেট এন্ড ইভনিং স্টার,/এন্ড ওয়ান ক্লিয়ার কল ফর মি!" ( ক্রসিং দ্য বার :এলফ্রেড টেনিসন ) কিন্ত কেন যাব! সে সময় কি এসেছে! শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা আমাকে ডেকে বারণ করে। এবং শেষে বলতেই হয় রবার্ট ফ্রস্টের কথায় " এন্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ,/ এন্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ।" আন্তরিক ডাকে ছোটাই জীবন। কিন্ত হৃদয়ের ডাক যে শোনেনি সে কতদূর যেতে পারে!!
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴