ডাক : এক আলাদা অনুভূতি
ডাক : এক আলাদা অনুভূতি
দেবর্ষি সরকার
------------------------------------
কোনো এক জনৈক ভদ্রলোক তার গানে বলেছেন "তোরে ডাকার মতো ডাকতে যদি পারি।"
সেই ডাকের মধ্যেও বা কতটুকু শক্তি আছে! সেই শক্তি কি ছাপিয়ে যায় কঠোর বাস্তবকে! আসলে বলতে গেলে ডাকা ও চাওয়ার মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। আমাদের কামনা ও বাসনা থেকেই চাওয়া, পাওয়ার ইচ্ছে জাগে মনে। সেই চাওয়া পাওয়ার অভাব মেটাতে আমরা হাক দেই এমন কিছুকে যা অভাব পূরণ করে চলে আমাদের। ডাকার মাধ্যমে আমরা একপ্রকার সকাম কর্মই করে থাকি বলতে গেলে। হৃদয়ের প্রবল আকাঙ্ক্ষাই হয়তো ডাকার একমাত্র কারন।
ডাকের ক্ষেত্রে আবার দুটি ভাগ পরিগণিত হয়। প্রথমটি হল যখন আমরা কাউকে আমাদের প্রয়োজন ডাকি তখন আমরা থাকি বক্তা। কিন্তু সেই যখন আমাদের ডাকে তার প্রয়োজনে তখন আমরা বক্তা থেকে হয়ে যাই শ্রোতা বন্ধু। এই দুটির মধ্যে বিস্তর ফারাক, যেমন ফারাক দিন ও রাত্রির মধ্যে। কিন্তু নদীর মোহনার মত এই দুটিরোই উদ্দেশ্য মিলে যায় কোথাও গিয়ে।
মনের যে ভাব আছে তা পরিবর্তিত হয় ক্ষণে, ক্ষণে। আমরা যখন শ্রোতা বন্ধু হয়ে ডাক শুনি তখন আমাদের মনে এক অন্য অনুভূতির সৃষ্টি হয়।
কোনো নারী যদি প্রথম তার সন্তানের থেকে মা ডাক শুনে তাহলে তার মনের অনুভূতি পরিবর্তিত হবে তৎক্ষণাৎ। তা এক আলাদা মাত্রা পাবে।
কিম্বা, পড়ন্ত বিকেলে ঘরে বসে থাকা বন্ধুটি যখন শুনতে পায় তার বন্ধুর দেওয়া খেলার ডাক তখন এক আনন্দঘন অনুভূতি জেগে ওঠে সেই বন্ধুর মনে। যা ছাপিয়ে যায় সোনা হীরা সন্ধান পাওয়ার আনন্দকে।
কিম্বা, যে পথিক দীর্ঘদিন যাবৎ বসে আছে পথের দিকে চেয়ে, কিন্তু তার সামনে সমস্ত পথোই বন্ধ, সেই মুহূর্তে পথিকটি যদি শুনতে পায় চিরকাঙ্ক্ষিত সেই পথের ডাক তা অন্য এক পরিবেশ এনে দেয় পথিকের কাছে। সে কি থাকতে পারে পথের ডাকে না সাড়া দিয়ে?
কিম্বা, যে মানুষ দরদী, যে মানুষ সমাজসেবী, সমাজের কঠিন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে তাকে যদি সাধারন মানুষ ডাকে প্রচন্ড আর্তনাদের সহিত তবে সেই ডাকে মানুষটি সাড়া না দিয়ে থাকতে পারে?
তেমনি, বসন্তের কোকিলো ডেকে চলে উদাস সুরে। সেই সুরে সারা না দিয়ে থাকতে পারে এমন মানুষ খুবই কম। সেই উত্তর ফিরে আসে মনের বেদনার সাথে বসন্তের রঙে।
কিম্বা, জীবনের সবকটা বসন্ত পেরিয়ে এসে শেষ প্রান্তে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে সে ব্যক্তিটি সাড়া দেয় তার জীবনের পিছুটানের ডাকে। জীবনের উত্থান, পতন, অভাব, অনটন, সুখ, দুঃখ তখন ফিরে ফিরে আসে তার মানে। ঠিক যেমন রাতের পর দিন ও দিনের পর রাত আসে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে।
কিম্বা, চোখে একরাশ স্বপ্ন নেওয়া সেই তরুণ অথবা তরুণীকে ডাক দেয় তাদের জীবনের লক্ষ্য ভবিষ্যতে ঠিকানা। হয়তো কিছুটা নিজের মত বাঁচবে বলে।
আগেই বলেছি চাওয়া মেটানোর জন্যই মনুষ্য জগৎ ও প্রাণী জগৎ অর্থাৎ যাদের ডাকার ক্ষমতা আছে তারা ডেকে চলে অনবরত।
তেমনি, দুঃখী, একাকী মানুষও ডাকে জীবনের আনন্দকে ,প্রকৃতির আনন্দকে ,সমাজের আনন্দকে। সে এই আশায় ডাকে যেন আনন্দ তার জীবনে চিরস্থায়ী হয়ে থেকে যায়।
তেমনি, বন, বনের গাছপালা, লতা ,গুল্ম ,সবুজ নদী, খাল বিল এবং কি মানুষোও বৃষ্টিকে ডাকে তাই হয়তো বৃষ্টি আমাদের দান করে তার শীতল কোমল বারিধারার স্পর্শ।
তেমনি, ভূ কেন্দ্রের অভ্যন্তরে ক্রিয়াশীল যে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আছে তাও এক প্রকার অদৃশ্য টানে ডেকে চলেছে আমাদের অনবরত। আমরা অজান্তেই তার ডাকে সাড়া দিচ্ছি বলে আমরা আমাদের জায়গায় ধীর,স্থির ভাবে অচল আছি।
তেমনি, সাম্প্রতিককালে নেটমাধ্যমে বহু চর্চিত ফেসবুক, ইউটিউবে বিষয়বস্তু সমন্বিত কনটেন্ট ক্রিয়েটার রাও আমাদের ডাকছে তাদের আর্থিক অগ্রগতির লক্ষ্যে। সেই ডাকার মধ্যে কতই না জৌলুস,কতই না রঙিন উপস্থাপন। তাদের মনের আকাঙ্ক্ষা থেকেই এই ডাকার সূত্রপাত।
তেমনি, বর্তমানে আধুনিক যুগে দাঁড়িয়েও সমাজের যে সমস্ত স্থানগুলি কুসংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ, সে সমস্ত স্থানগুলি অপদেবতাদের আবাসস্থল বলে খ্যাত সেখানকার মানুষজন আজও শুনতে পান এক বিশেষ প্রজাতির ডাক। স্থানীয় মানুষের ভাষায় তা নিশির ডাক। সেই ডাকে সারা দিয়ে ঘরছাড়া হলে নাকি মৃত্যু অবধারিত।
তেমনি, ঘুমের ঘোরে আপনার নাক ডাকার আওয়াজোও আপনার জীবনসঙ্গীর জীবনে সেই মুহূর্তের এক অসহ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি করে, যার স্বাদ হয়তো আপনার জীবনসঙ্গীই জানে একমাত্র।
এরকম আরো কত ডাক আছে । কেউ শুনতে পান প্রেমিকার ডাক, কেউ শুনতে পান ঋণ শোধ করবার ডাক, কেউ শুনে বাজারে সবজি আনবার ডাক, আবার প্রাত্যহিক জীবনে বাসস্ট্যান্ডে বাসওয়ালাদের ডাকোও কারো কানে পৌঁছোয়।
এইসব ডাকার মধ্যে আছে এক আলাদা সম্মোধন, এক আলাদা ভালোবাসা, এক অন্য জগতের প্রত্যাশা। আসলে ডাক আছে বলেই আমরা বেঁচে আছি। আমাদের জীবন শুরুর পর্যায় থেকেই আমরা ভবিষ্যতের ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে চলেছি। এখন যে আমরা কাজ করছি তার ডাক হয়তো আমরা পেয়েছিলাম এর আগে, এখন যে কাজ করবার ডাক পাবো সেটা করব পরক্ষণে। এভাবেই হয়তো নদীর চরাই, উৎরাইকে পার করে জল যেমন উচ্চ, মধ্য ও নিম্ন এই তিন গতিতে নিজের সহজিয়া জীবন বজায় রাখে আমরাও তেমনি আমাদের ভবিষ্যতের ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে চলি অনন্তের দিকে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴