সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
21-July,2024 - Sunday ✍️ By- বিমল দেবনাথ 395

ঠাকুর শক্তি দাও (৩)/বিমল দেবনাথ

ঠাকুর শক্তি দাও (৩)
বিমল দেবনাথ  

বিরুৎ উঠে দাঁড়ায়। ওর মনে হয় ও যেন একদম একা। নির্জনতা  এক আয়না। সে আয়নায় মন দেখা যায়। মনের আকার বিকার, শিকড়-বাকড় বোঝা যায়।  কী এক মোহ জালে ভুলে যায় সঙ্গে থাকা সহকর্মীদেরও।  সকালের নরম রোদ   উঁকি মেরে দেখছে।  পাখিরা চঞ্চল হতে শুরু করেছে ।  বিরুৎ দেখতে থাকে বনের রাস্তা, গাছ, লতা-পাতা। ঘাসে ঢাকা মেটে রাস্তা কিছুটা সোজা গিয়ে বেঁকে হারিয়ে গেছে বনের ভেতরে। বনের রাস্তার সঙ্গে মনও হারিয়ে যায়। বনের রাস্তা অদ্ভুত সুন্দর। সবুজের বুক চিরে  আঁকাবাঁকা পথ ঘুরে ঘুরে চলে যায় বনের নানা প্রান্তে। যে রাস্তায় গাড়ি চলে সে রাস্তায়   গাড়ির চাকা খেয়ে নেয় রাস্তার সবুজ। দু’হাত চওড়া পাথুরে খরখরে দু’টো মেটে ট্র্যাক সমান্তরাল চলতে থাকে রাস্তার সঙ্গে।  রাস্তার  দু’পাশে সবুজ, মাঝেও সবুজ। দৃষ্টির শেষ সীমানা  থেকে বনের বুক চিরে আকাশ নীল ফিতের  মতো  নেমে  ক্রমশ বড় হতে হতে বন উপচে পড়ে বিরুৎ-এর  মাথার ওপরে। বিরুৎ হঠাৎ একটা ছোট্ট হরিণকে  রাস্তার পাশে ঘাসে চরতে দেখে।  হরিণটার গায়ে গাছের ফাঁক দিয়ে এসে পড়েছে রোদ। হরিণের সোনালি রং ঝকঝক করে ওঠে। হরিণটা রাস্তার খরখরে ট্র্যাকটা বেশ সতর্ক ভাবে পার হয়ে  মাঝের সবুজ ঘাসে দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে বিরুৎকে। চোখের চাহনি  যেন  বলছে- তুমি কে? প্রশ্নটা  খুব মায়া জড়ানো। বিরুৎ এই প্রথম বনে হরিণ দেখল। ওর  বাগবাজারের  ‘ভবঘুরে’ ভ্রমণ সংস্থার কথা মনে পড়ে। ওরা কত মানুষকে গরুমারা, বাক্সা, জলদাপাড়া ঘুরাতে  নিয়ে  যায়। শহরের গলির মানুষগুলো পাঁচ সাতদিন বন ঘুরে ফিরে এসে আবার যে যার কাজে হারিয়ে যায়। কখনও বিরুৎএর  সঙ্গে দেখা হলে, ওদের মেজাজ মরজি ঠিক থাকলে বলত, যা একবার ডুয়ার্স ঘুরে আয় ।  হেব্বি জঙ্গল। হাতি, গণ্ডার ও বাইসন (গাউড়) দেখা যায়। আবার  কেউ বলে, দুর… ফালতু। কিচ্ছু দেখা যায়না। খালি গাছ আর গাছ।  কেউ বলে জঙ্গলে আর গাছ  নেই। সব ঝোপঝাড়ে ভরে আছে। এই বনের কথা কেউ কোন দিন বলেনি। এরকম কত বন পড়ে আছে নজরের বাইরে, কে জানে!  বনের রাস্তার কথাও কেউ বলেনা। কোলকাতার ট্রাম লাইনের মতো বনের রাস্তারও হয়তো অনেক ইতিহাস আছে। কত সবুজ এই রাস্তা ধরে কাঠ হয়ে চলে গেছে দেশ বিদেশের নানা প্রান্তে। বিরুৎ আবার ঝুঁকে ঘাসের ওপরে হাত বোলায়। এখন এই বনের সে হর্তাকর্তা। বনটাকে কোন ভবঘুরে নয়, নিজের মতো করে দেখবে। এতদিন কত বই পড়েছে। ওর কাজই ছিল পড়া ও বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রদের পড়ান। তাছাড়া বেকারদের আর তেমন কাজ কোথায়? অবশেষে সে বনের এই কাজ পায়। বিরুৎ ঘাস দেখে, বনের রাস্তা দেখে, গাছ দেখে, পাখির গান শোনে।                
রতনরা নতুন বিটবাবুর অবস্থা দেখে মুখ চেপে হাসে আবার আঁতকেও ওঠে। হাতির ট্র্যাকে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা বিপদজনক। বলে, স্যার চলুন, বন টহল করবেন না। বিরুৎ ভেতরে ভেতরে চমকে ওঠে। একটা জাম গাছের পাকা পাতা ঝরে পড়ে বিরুৎএর মাথার ওপরে। পাতা হাতে নিয়ে গন্ধ শোঁকে। পাতাতেও জামের হালকা গন্ধ। রতন বলে, বারোমাসি ফলের মতো জামের পাতা সারা বছর ধরে পাকে আর ঝরে। শাল গাছের মতো শীতে এক সঙ্গে সব পাতা ঝরে পড়েনা। বিরুৎ অবাক হয়ে রতনকে দেখে। জামগাছের পাশে শাল গাছ দেখে। ছেলেগুলো কত কী জানে!
বিরুৎ হাঁটতে হাঁটতে যত ভেতরে যায় বনের গন্ধ পালটে পালটে যায়। বুনো মাটির গন্ধ ছাপিয়ে একটা মিষ্টি গন্ধ মনকে মোহিত করে। এমন ফুলের গন্ধ সে আগে কখনও পায়নি। বাগবাজারের গলির নানা ফুলের দোকানের গন্ধ তিনশ পঁয়ষট্টি দিন এক রকম। দিনের পর দিন সে গন্ধ নাকে সয়ে গেলে আর সুখানুভূতি হতনা। গন্ধ আছে বলে মনেই হতনা। এই গন্ধটা কি রতনরা পাচ্ছে? ওরা প্রতিদিন এই বনে হাঁটে। এই গন্ধ কি ওদের নাকে সয়ে গেছে?  বড় বড় গগনচুম্বী গাছ, সূর্যের নরম আলো, নানা পাখির নানা ডাকে রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে বিরুৎ। স্কুলের দিনগুলোর  কথা মনে পড়ে। কত কিছুই  সে  জনতনা। প্রায় মাঝ বয়সে বনে এসে সেই এক অবস্থা। বন একটা বই তার পাতা অনেক। কোন পাতায় কী আছে কিছুই সে জানেনা। প্রশ্ন করে রতনকে, এটা কিসের গন্ধ?  রতন বলে- বন চম্পা। বিরুৎ  ফুলটাকে দেখতে চায়।  রতন বলে-  বনের গভীরে  একটা দু’টো করে গাছ থাকে। পাঁচ ছয় ফুটের বেশি লম্বা হয়না। সাদা ফুল ফোটে। ঘন বনে এত ছোট গাছ  খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন। বিরুৎ লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে গন্ধের উৎস খোঁজার চেষ্টা করে। কিন্তু বুঝতে পারেনা। রাস্তা ছেড়ে বনের ভেতরে যেতে চায়। রতন  বলে, স্যার এত সকালে রাস্তা ছেড়ে বনে ঢোকা যাবেনা।  এখন আমরা রাস্তায় হেঁটে গভীর বনের ভেতরের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করি। কথাটা বিরুৎএর কঠিন অংকের মতো লাগে।   বুঝতে পারেনা। বিরুৎএর স্বভাব সহজ জিনিস আগে শেষ করে চাপ কমিয়ে নেওয়া। তারপর কঠিন জিনিসের ওপর কামড় বসায়। এখন এই মিষ্টি ফুল দেখা ওর মনের একান্ত ইচ্ছা। যে শিশু কোন দিন আগুনে হাত দেয়নি সে কী বুঝবে আগুনে পোড়ার ব্যথা।  সে রাস্তা থেকে একটা সরু ফাঁক ধরে বনে ঢুকতে চায়। রতনরা চিৎকার করে ওঠে, স্যার কী করছেন।  হাতিগুলো সবে মাত্র বনে ঢুকেছে। এখনও ওরা ঘুমায়নি। রাস্তা ছেড়ে বনে ঢুকলে যে কোন সময় বিপদ ঘটে যেতে পারে। বিরুৎ বলে- আমি ‘সহজ উঠোন’এ পড়েছি, হাতির গায়ে গন্ধ থাকে। সে গন্ধ নিয়ে অনেক দূর থেকে অনুমান করা যায়। সে আপনি ঠিক পড়েছেন। তবে একটা বই বনের এক সীমিত অংশের বর্ণনা শেষ করতে পারেনা। বিরুৎ ভাবে রতন ঠিক কথা বলেছে। বন নিয়ে কত বিখ্যাত বই পড়েছে। বনের গন্ধের বর্ণনায় সে এক কথা, ‘মাটির সোঁদা গন্ধ’। সে তো   গরম কালে শহরের মাটিতে বৃষ্টি পড়লেও পাওয়া যায়। বনে মনে হয় ভিন্ন ঋতুতে ভিন্ন গন্ধ থাকে। সে বুনো গন্ধের সঙ্গে বর্ষায় সোঁদা গন্ধও মিশে থাকে। বন চম্পার গন্ধ, গন্ধকুলের রাজা। বাঘের মতো। এই গন্ধ থাকলে অন্য গন্ধ পাওয়া যাবেনা।  চলুন স্যার আজ আপনাকে দক্ষিণ আর পশ্চিমের সীমানা দেখাব। অনেকটা পথ হাঁটতে হবে।    
বিরুৎ বনের ভেতরে হাঁটতে থাকে। প্রথম দিনে শাল গাছ চিনে নিয়েছে। শাল গাছের সঙ্গে কত ধরনের গাছ আছে গুনে শেষ করতে পারেনা। কী করে পারবে? উত্তর কোলকাতার পচা গলি থেকে এক লাফে গভীর বনের ভেতরে এসে পড়েছে। প্রশিক্ষণ হবে বনে কিছুদিন অভিজ্ঞতা হলে পরে। ইন্টার্ভিউতে একটা প্রশ্ন খুব খোঁচা দিয়েছিল বিরুৎকে। মিছিলের শহর থেকে গিয়ে বনের ভেতরে থাকতে পারবেন? অনেক ছেলে কিন্তু চাকরি ছেড়ে পালিয়ে গেছে। পালিয়ে গেলে আবার একটা পোস্ট দীর্ঘ দিন খালি পড়ে থাকবে। বনে এমনিতে স্টাফ কম। লজ্জার কিছু নেই, ভয় পেলে ছেড়ে দিতে পারেন। সাহসী কেউ সুযোগ পাবে। প্রশ্ন ও পরিস্থিতি শুনে বিরৎএর মনে যেন মিছিল শুরু হয়। কেন সে বনে থাকতে পারবেনা? বইতে পড়েছে বনেও মানুষ বাস করে। যেখানে মনুষ বাস করতে পারে সেখানে সে কেন বাস করতে পারবে না? তাছাড়া ওর তেমন চাওয়ার কিছু নেই। প্রতি বছর জানুয়ারী মাসের এক তারিখে সে কাশীপুর উদ্যানবাটী যেত, কল্পতরু উৎসবে। সে দিন নাকি মানুষ যা চায় ঠাকুর তাই দেন। বিরুৎ চাইত যাতে তার কোন কিছু চাইতে না হয়। কোন কিছু না চেয়ে নিজের যা কিছু আছে তা নিয়ে বেঁচে থাকতে চায় সে। যেখানে মানুষের মিছিল নেই, শরীর বেচার বাজার নেই, সেই বনে ওর থাকার কী অসুবিধা?   বিরুৎ দৃঢ় প্রত্যয়ে বলে, পারব।          
বিরুৎ হাঁটে আর ভাবে, ও না চাইতে একটা বন পেয়ে গেল। বনের সৌন্দর্য বর্ণনা করা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। অনেকে বনের সৌন্দর্য কল্পনায় এনে নানা প্রমিত শব্দ-রঙে নৈসর্গিক ছবি আঁকে। বনের স্পর্শে বিরুৎএর সব শব্দ জব্দ হয়ে যায়। বিহ্বল হয়ে শুধু হাঁটতে থাকে।  নরম আলো গরম হতেই বনটাকে পরিষ্কার দেখতে পায়। মনে হয় লম্বা গাছগুলো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আকাশটাকে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে। সেই ছেঁড়া আকাশ জোড়া লাগায় বর্ষার কাল মেঘ। বন তখন আবছা অন্ধকারে ঢেকে যায়। অনেকক্ষণ হাঁটার গরমের সঙ্গে বনের গুমট গরম যোগ হতেই শরীর চড়চড় করে। গতকাল গাড়িতে করে রেঞ্জ থেকে বিটে  আসার সময় গতির জন্য হাওয়ার ফুরফুরে আরাম ছিল, সেটা হাঁটার সময় পাওয়া যায়না। তবে হাঁটাতে একাটা আলাদা রোমাঞ্চ আছে। এই রোমাঞ্চ যারা পাহাড়ে উঠতে ভয় পায়, সমুদ্রে সাঁতার কাটতে ভয় পায় তাদের জন্য নয়। বর্ষায় বনে মজাও আছে। গুমোট গরমের মধ্যে ঝড়ো বাতাসও বয়। বনের ওপরে পাতার বিছানায় শুয়ে থাকা পোয়াতী মেঘ গুলোকে টেনে নিয়ে চলে যায় পাহাড়ে। অঝোরে বৃষ্টি নামে পাহাড়ের ঢালে। কখনও ঝরনার মতো, কখনও  মেঘ ফেটে জল নামে ধসের মতো। এসব এখনও দেখেনি বিরুৎ। রতনের কথার ভাবান্তর। দমকা হাওয়ায় গাছ যখন দুলে ওঠে, এক গাছের ডাল অন্য গাছের ডালের সঙ্গে ঘষা খায়। মনে হয় যেন গাছ ডালে ডালে কথা বলে। নানা শব্দ   করে। বিরুৎ গাছের আলিঙ্গন দেখে ও প্রেমালাপ শুনে চমকিত হয়। অভিজ্ঞতা না থাকলে নাকি রাতে এই প্রেমালাপ অপদেবতা হয়ে ওঠে। রতন বলছিল, ও যখন বনে প্রথম এসেছিল, গ্রামের লোক বলেছিল; জঙ্গলে রাতে ভূত হাঁটে, কথা বলে। পরে নানা অভিজ্ঞতা দিয়ে রহস্য উন্মোচন করে। রতনরা আরও কত রহস্যের কিনারা করেছে, কে জানে! বিরুৎ সব জানতে চায়। বিরুৎএর মনে হয়, ওর বোধহয় এই চাওয়াটা ছিলই। দিনের পর দিন উদ্যানবাটীতে গেলেও নিজের মনের হদিস সে পায়নি। ঠাকুরের তো অজানা কিছু থাকেনা। তাই সে এমন একটা বন পেয়েছে। বিরুৎ হলেও সে বনে ছায়া ফেলতে চায়। মানুষের মনে শান্ত, স্নিগ্ধ ছায়া ফেলতে হলে জানতে হবে সব ভালো করে। বিরুৎ অবিরাম হাঁটে আর আবাক বিস্ময়ে বন দেখে। রতনরা ভাবে, একটা শহুরে মানুষ কী ভাবে প্রথম দিনে এতটা পথ বনের ভেতরে হাঁটতে পারে! রতনরা পিছিয়ে পড়লে বিরুৎ ঘুরে দেখে রতনদের। বিরুৎ ভাবে, ছেলেগুলো কি পাগল? এত সুন্দর বন না দেখে শুধু রাস্তার দু’পাশ দেখে। চোখে কোন আনন্দের চিহ্ন নেই। শুধু সন্দেহের জাল। বিরুৎ বলে, কী হল, হাঁট। হ্যাঁ, স্যার। আর বেশি দূর নেই। সামনেই নদী। নদীর নাম শুনতেই বিরুৎএর জল পিপাসা চাড় দেয়।              
নদী দেখে বিরুৎএর মান্না দে’র গানের কথা মনে পড়ে। গানের কথা বাস্তবে দেখে জলের তেষ্টা চলে যায়। ঘোর বর্ষায় নদীতে জল নেই। সাদা বালি আর কাঁকর। মাঝে মধ্যে মরা হাতির মাথার মতো পড়ে আছে বড় বড় পাথর। বিরুৎ প্রশ্ন করে, এই নদী কেমন নদী? জল নেই একটুও। রতন বলে, স্যার। বর্ষায় এই নদীর ভরসা নেই। কখন যে হঠাৎ দু’কূল ভাসিয়ে জল এসে যাবে বুঝতে পারবেন না। এইতো কিছু দিন আগে একটা শিশুকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। আর পাওয়া যায়নি। এখানে নদীটা কিন্তু বনভূমি। নদী বরাবর উত্তর দিকে উজানে হাঁটছে বিরুৎরা। রতন বলে বনের দু’পাশে চা বাগান। পশ্চিমে বিন্নাগুড়ি আর কারবালা । পূর্বে বান্দাপানি তারও পূর্বে দলমোর ও মাকরাপাড়া। উত্তর মাথা  থেকে পূর্ব দিকে গিয়ে বনটা দক্ষিণে বেঁকে গেছে। এই বনের আকৃতি উলটো ইংরাজি অক্ষর ‘ইউ’র মতো। ‘ইউ’র পূর্ব দিকের বাহুর উত্তর অংশকে বান্দাপানি ও দক্ষিণ অংশকে দলমোর বন নামে ডাকা হয়।  বাগানে আছে শ্রমিকদের জীর্ণ গ্রাম। চা-বাগানে গ্রামকে লাইন বলে। বনে আছে পাঁচটা বন বস্তি। রতন বলে, কাজের লোভে অনেক মেয়ে শহরে গিয়ে বিপদে পড়ে। বিরুৎ জানে সে সব বিপদের কথা। সেখানে শরীরের ঘাম ঝরেনা, মন মরে। বিরুৎএর অবাক লাগে, বনের চার পাশে এত মানুষ কিন্তু বনে ও নদীতেও কোন মানুষ নেই। মাঝে মধ্যে বড় গাড়ির চাকার দাগ। নদীর জল কোনও কোনও জায়গায় উঠে এসে আবার ভাটিতে বালির নিচে হারিয়ে যায়। এ যেন জল বালির লুকোচুরি খেলা। গঙ্গার মতো জলের পূর্ব নির্ধারিত সময় নেই। জোয়ার ভাটা নেই। নদী, বন ও জীবন সবকিছুই অনিশ্চিত।     
নদীর বাঁক নিতেই বিরুৎ বনে প্রথম অন্য মানুষ দেখে। একটা সাদা প্লাস্টিক চারটা পাতলা খুঁটির সঙ্গে টাঙ্গান। শামিয়ানার  মতো।  তার নিচে একটা কালো মেয়ে হাতুড়ি দিয়ে পাথর ভাঙ্গছে। তার পেছনে আরও অনেকে। অজানা কেউ বনের পশে নদীর সবুজ চরে নানা জায়গায় পাথর স্তূপ করে রেখেছে।  সেই পাথর ভাঙ্গছে এক মনে। নদীর এই বাঁক কাছে না এলে  দেখা যায়না। সাদা প্লাস্টিকের প্রতিফলিত আলোতে কালো মেয়েটাকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। মেয়েটার হাত দু’টো না  নড়লে মনে হত কষ্টিপাথরে খোদাই করা কোন নারী মূর্তি।  ভাঙ্গা পাথরের ক্ষুদ্র কণা ছিটকে এসে লেগে রয়েছে শরীরের নানা উন্মুক্ত অংশে। সেগুলোতে আলো পড়তেই হিরার মতো চিকমিক করে উঠছে। উবু হয়ে বসার জন্য উন্মুক্ত হয়ে আছে    ঊরু’র অনেকটা। চোখ দেখা যায়না। আনত চোখের একাগ্র দৃষ্টি পাথরের দিকে। ক্রমাগত হাত চালানোর জন্য মনে হয়  ব্লাউজের ছেঁড়া বোতামের জায়গাটা ঝুলে পড়েছে। খোদাই করা নিটোল  বুক দু’টো প্রায় উন্মুক্ত। হাতুড়ি আর পাথরের ঘাত  প্রতিঘাতে কেঁপে কেঁপে উঠছে তার বুক। বিরুৎএর বুকও কেঁপে ওঠে। গগনভেদী চিৎকার   করে ওঠে রতনরা। মানুষগুলো যেদিক সেদিক ছুটে ঢুকে যায় বনে। মেয়েটিও। বিরুৎ এতক্ষণ  যে ছবিটা দেখছিল সেটাকে রতনদের চিৎকার নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। এই প্রথম বিরক্তি আসে বিরুৎএর মুখে। রতন বলে, ওরা বেআইনী কাজ করছিল। বনে  পাথরও বনজ সম্পদ। এরা খুব চালাক। জানে এই জায়গাটা দূর থেকে দেখা যায়না।  তাই অপকর্মগুলো এইখানে করে।  পরে ট্রাকে করে ভাঙ্গা পাথরের টুকরোগুলো নিয়ে চলে যায়। বিরুৎ জিজ্ঞাসা করে,  বনে যে হাতি আছে বললে। ওদের ভয় নেই? না। হাতিগুলো রাতে চা বাগানে, বনের বস্তিতে চরে। বনের পাশের মানুষগুলোও নানা কারণে বনে ঢোকে। এরা একে-অপরকে চেনে। এরা মুখামুখি হলেও ভয় পায়না। তাছাড়া হাতিগুলো দুপুর বেলায় চলাফেরা কম করে, ঘুমায়। বিরুৎ জিজ্ঞাসা করে, এখান থেকে রাস্তায় না গিয়ে অফিসে যাওয়া যায়না? যায়। তাহলে চল, বনের ভেতর দিয়ে যাব। রতনরা একে অন্যের মুখ দেখে, কিছু বলে না। রতন ঘাড়ে ঝোলান দোনলা বন্দুকটা হাতে নেয়।  বনের দিকে পা বাড়ায়। বনের ভেতরে পা রাখতেই ঠকঠক করে কাঠ কাটার শব্দ শোনা যায়। হঠাৎ কাঠ কাটার শব্দ বন্ধ হয়ে যায়। বনের ভেতর থেকে উড়ে আসে গুলির শব্দ।  রতন বলে, পাথর ভাঙ্গার দল মনে হয় কাঠ কাটার দলের সঙ্গে এক হয়ে গেছে। চোরগুলো আমাদের মতো নানা দলে বিভক্ত নয়। এখানে ওদের খুব একতা। আমাদের খবর পেয়ে সতর্ক বার্তা পাঠাল।  বিরুৎএর কোনকিছু বোঝার বাকি থাকেনা। বন যতটা সুন্দর ততটা ভয়ঙ্কর। এই বন ও বনের সৌন্দর্য রক্ষা করার শক্তি কি বিরুতের আছে? বনে ঢুকে বিরুৎ জীবনে প্রথম বার ঠাকুরের কাছে কিছু চায়…ঠাকুর শক্তি দাও।   
এখন শীত নয়, ঘোর বর্ষা। বর্ষিত হবে কি ঠাকুরের আশীর্বাদ?            

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri