ঝাড়খণ্ড অরণ্যের একটু ঝলক/শিখা সরকার
ঝাড়খণ্ড অরণ্যের একটু ঝলক
শিখা সরকার
--------------------------
২০১৭ সালের ২২-শে ডিসেম্বর আমাদের গন্তব্যস্থল ছিল ঝাড়খণ্ড।
অরণ্য ও আদিবাসীদের নিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ রাঁচি শহর। রাঁচি ছোটনাগপুর অঞ্চলের মালভূমিতে অবস্থিত, তাই এখানে পাহাড়ের আধিক্য দেখা যায়। রাঁচিকে ঝর্ণার শহরও বলা হয়। রাঁচি শহরের বর্ণনা আমার আজকের বিষয় নয়,কারণ সব শহরই কমবেশী একই রকম। তবে একটি বিষয়ে রাঁচি অন্যতম, শহরের মাঝখানে রয়েছে এক বিশাল পাহাড়। পাহাড়ের শীর্ষে পাহাড়ী বাবার মন্দির মানে শিব মন্দির। এই মন্দিরের ওপড়ে উঠলে সমস্ত রাঁচি শহরটাকে দেখা যায়।
ফিরে আসি প্রসঙ্গে,আজ শুধুই দশম জলপ্রপাতের সৌন্দর্য আর তার চারপাশের পাহাড়, অরণ্যের রূপ এবং আদিবাসীদের কথা বলব। রুক্ষ বনাঞ্চল বলেই বোধহয় প্রকৃতি এখানে দান করেছে অমৃতধারা জলপ্রপাত রূপে। দশম ছাড়াও রয়েছে হুড্রু, জোনা, সীতা, গৌতমধারা ইত্যাদি জলপ্রপাত।দশম প্রপাতটির থেকে অন্যগুলোর গভীরতা বেশি। কিন্তু শীতের সময় তাদের সৌন্দর্য ততটা আকর্ষণীয় নয় বলেই শুনেছি।
রাঁচি শহরের সব দর্শনীয় স্থান আমাদের দেখা হয়েছে। আজ ঝাড়খণ্ডের ঘন বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল আর দশম জলপ্রপাত দেখার উদ্দেশ্যে চলেছি। রাঁচি শহরের সবচেয়ে কাছের জলপ্রপাত দশম।শহর থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরত্বে এর অবস্থান। স্থানটি মূলত আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল, পাহাড় আর অরণ্যে ঘেরা একটি উপত্যকার মাঝে দশম জলপ্রপাত।
সকাল সকাল গাড়ি চলে এসেছে আমরাও তৈরি ছিলাম। হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে, কিছু পথ চলার পর গাড়ি নামল মেঠো পথে। পথের দুপাশে পাতায় ছাওয়া কুটিরগুলো দীনতার সাক্ষী বহন করছে। বোঝা গেল এটি একটি গ্রাম। ওরাঁও,মুন্ডা, সাঁওতাল আদিবাসী গ্রাম। কুটিরের সামনে শীতের মিঠে রোদের পরশ পেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে রয়েছে অপুষ্টিতে ভোগা শিশু, বৃদ্ধা জনা-কয়েক। এই গ্রামটি শেষ হলেই আমরা গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করব।
কিছু দূর যাওয়ার পর আমাদের গাড়ি থেমে গেল,মানে থামতে বাধ্য হল। একটা লম্বা বাঁশের কঞ্চি রাস্তার ওপর আড়াআড়ি ভাবে ধরে দুপাশে দাঁড়িয়ে বালক-বালিকার দল। শুনলাম চাঁদা দিতে হবে, কিসের চাঁদা? ড্রাইভার বলল, ওরা সরস্বতী পুজোর চাঁদা চাইছে। ভালো লাগল জেনে, এই দৈন্য দশা জীবনের মধ্যেও বাগদেবীর আরাধনা হয় তাহলে! চাঁদা দেওয়া হল। মনে পড়ে গেল সেই লক্ষ্মী আর সরস্বতীর পুরোনো ঝগড়া। যেখানে মা লক্ষ্মীর অধিষ্ঠান সেখানে মা সরস্বতীর অনুপস্থিতি। যদিও এসব গল্প কথা, এখন লক্ষ্মীর আশীর্বাদ ছাড়া সরস্বতীর আরাধনা প্রায় অসম্ভব।
গায়ে গায়ে লাগা কুটির ঘেরা বসতির শেষ প্রান্ত থেকেই শুরু হয়েছে জঙ্গল। জঙ্গলের ঘনত্ব বাড়ছে, মেঠোপথ শেষ হয়ে পিচঢালা মসৃণ আরামদায়ক পথে উঠে এলাম। দূরে দূরে পাহাড়ের সারি, জঙ্গলের মাঝে ঝরা পাতার গালিচা বিছানো,পাখির ডাক সব মিলিয়ে মন ভালো করা পরিবেশ। শুধু পিচের প্রলেপ দেওয়া রাস্তা বড়ই বেমানান মনে হল।
পূর্তবিভাগ সড়ক নির্মাণ করছে পর্যটকদের সুবিধার্থে। যদিও বিজলী বাতি এখনও আসেনি।
জঙ্গল বিরল হয়ে আসছে,দশম প্রপাতের
কাছাকাছি এসে গেছি। জঙ্গল কেটে তৈরি হয়েছে গাড়ি পার্কিং এর ব্যবস্থা, অস্থায়ী খাবারের দোকান আর সরু সরু লাঠি বিক্রি হচ্ছে।
নেমে এলাম গাড়ি থেকে, এবারে সেই সুন্দরের দেখা পাওয়ার জন্য উন্মুখ সবাই। চারিদিকে পাহাড় আর সবুজের সমারোহ, পথের দুপাশে বড় বড় গাছের নিচে বসে রয়েছে আদিবাসী বালক-বালিকারা। তাদের সামনে কাগজের ঠোঙ্গায় রাখা কিছু মুড়ি, বিক্রির আশায় পর্যটকদের তারা ডাকছে। হয়তো বা নিজেদের খাবারটাই বিক্রি করতে এসেছে কিছু বেশি পয়সার আশায়।
আমরা এগিয়ে চলেছি অনেকটা নিচে নামতে হবে। রেলিং ঘেরা সিঁড়ি রয়েছে, মাঝে মাঝে বসে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য রয়েছে প্রশস্ত চাতাল। নামতে নামতেই তার ডাক শুনতে পেলাম,সশব্দ গর্জনে সে আমাদের সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।
রেলিং ঘেরা ভিউ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে চোখ ফেরাতেই পারছি না।১৪৪ ফুট ওপর থেকে অসম্ভব সুন্দর ছন্দোময় গতিতে নেমে আসছে জলধারা।কাঞ্চি নদীর জল দশটি ভাগে বিভক্ত হয়ে আছড়ে পড়ছে সুবর্ণরেখা নদীর বুকে,তাই দশম জলপ্রপাত।কাঞ্চি নদী সুবর্ণরেখার শাখা নদী, সবচেয়ে বড় প্রপাতটির ফেনায়িত জলবিন্দু শিশির কণার মতো কুয়াশার চাদরে আচ্ছাদিত। আশেপাশে তার নয়টি ধারা থেকে অবিরাম পড়ছে জলধারা। তাদের কোনোটি নামছে সোজা ভাবে, কোনোটি আবার সর্পিল গতিতে।বিশাল বিশাল উপলখন্ডের দেয়াল অনায়াসে তার বেগ ধারণ করছে। নিচে কোথাও সৃষ্টি হয়েছে একটুকরো জলাশয় সেই জল নিস্তরঙ্গ নীলাভ সবুজ। অনেকেই স্নান করছে সেখানে। শীর্ণকায় নদী পারাপারের জন্য রয়েছে বাঁশের সাঁকো।
আমরা সবাই দুচোখ ভরে দেখছিলাম সেই অপরূপ দৃশ্য। পর্যটকদের ভিড়ে মনে হচ্ছিল যেন মেলা বসেছে, এখানে ওখানে ছড়িয়ে রয়েছে বড় বড় পাথরের চাঁই।ভরা বর্ষায় তারা জলমগ্ন থাকে। একটি বড়সড় পাথরের আসনে বসে আমরা সঙ্গে নিয়ে আসা খাবার খেলাম।
এবার ফেরার পালা ড্রাইভার তাগাদা দিচ্ছে, সন্ধ্যা হয়ে আসছে অনেকটা পথ অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে।
ইচ্ছে না করলেও দশম জলপ্রপাতকে বিদায় জানিয়ে ওপরে ওঠার জন্য পা বাড়ালাম।
গাড়িতে বসে বসে ভাবছিলাম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে আগামীতে এই স্থান আরও উন্নত হবে বসবে দোকান-পাট, হোটেল। কিছুটা হলেও আদিবাসীদের অবস্থা ফিরবে কিন্তু ধ্বংস হবে প্রকৃতি। এই জঙ্গল মহল হারাবে তার গরিমা।
আবার সেই ঘন জঙ্গল, দুপাশে জমাট বাঁধা অন্ধকার। পেছনে পড়ে রইলো পাহাড়, আদিবাসী বসতি আর প্রকৃতির অকৃপণ জলধারা।ঘন জঙ্গলের নিকষ কালো আঁধারের সাথে মিতালী পাতিয়ে ফিরে এলাম, চোখ ঝলসানো আলোয় আলোকিত রাঁচি শহরে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴