জীবনানন্দ দাশ : ১২৫ তম জন্মবর্ষে ফিরে দেখা/অমিতাভ গোস্বামী
জীবনানন্দ দাশ : ১২৫ তম জন্মবর্ষে ফিরে দেখা
অমিতাভ গোস্বামী
ফেব্রুয়ারি মাস বাংলা তথা বাঙালির জীবনে এক অতি বিশিষ্ট মাস। এই মাস যেমন বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষার আন্দোলনে আত্ম বলিদানের মধ্য দিয়ে চিরস্মরণীয় তেমনি এই মাসেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন বাংলা ভাষার শুদ্ধতম কবি জীবনানন্দ দাশ। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ অধুনা বাংলাদেশের বরিশাল শহরে তাঁর জন্ম হয়। সে হিসেবে এ বছর তাঁর ১২৫তম জন্মবর্ষ। রবীন্দ্রোত্তর যুগে বলা যেতে পারে ত্রিশের দশক থেকে এ পর্যন্ত বাংলা ভাষায় যত জন কবি লিখে গেছেন তাঁদের মধ্যে নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠতম জীবনানন্দ। তিমির বিনাশী পবিত্র আলোকময় পথে জীবনের যে অভিসার সেই মহাজীবনের কবি তিনি। যত দিন যাচ্ছে তার কবিতার নব নব মূল্যায়ন হচ্ছে এবং তিনি ক্রমশ আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন। এক প্রবহমান কাল চেতনার প্রকাশ তার কবিতায় ঘটেছে বলেই এটা সম্ভব হচ্ছে। যে স্বল্প সংখ্যক কবির লেখা নিয়ে আমরা এবং বাংলা কাব্যজগৎ গর্ব অনুভব করতে পারি জীবনানন্দ তার অন্যতম এবং সম্ভবত মহত্তম।
কবির জীবদ্দশায় মাত্র সাতটি কবিতা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। যথা ঝরা পালক, ধূসর পান্ডুলিপি, বনলতা সেন (কবিতা ভবন সংস্করণ), মহাপৃথিবী, সাতটি তারার তিমির, বনলতা সেন (সিগনেট প্রেস) এবং জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা। তার বহুল প্রচারিত এবং জনপ্রিয় সনেট গুচ্ছ 'রূপসী বাংলা' প্রকাশিত হয় কবির মৃত্যুর পর। ধূসর পান্ডুলিপি পাঠ করে ১৯৩৭ সালে কবিকে লেখা এক পত্রে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন -'তোমার কবিতা গুলি পড়ে খুশি হয়েছি। তোমার লেখায় রস আছে, স্বকীয়তা আছে এবং তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে।' কবি বুদ্ধদেব বসুর মতে,'জীবনানন্দ বাবুর কাব্য রসের যথার্থ উপলব্ধি একটু সময় সাপেক্ষ; তিনি ঝড়ের মতো উড়ে এসে পাঠকের মন এক দমকায় নিয়ে যান না। তার কবিতা একটু ধীরে সুস্থে পড়তে হয় এবং আস্তে আস্তে বুঝতে হয়।'
উত্তর কালের পাঠক সমাজের কাছে জীবনানন্দ দাশ যেন এক ধূসর স্বপ্ন বা বিপন্ন বিষ্ময়। সফেন সমুদ্র, নক্ষত্রের রাত, দারুচিনি দ্বীপ, ইতিহাসের ধূসর জগত, ধানসিঁড়ি নদী, চাঁদ সদাগর, মধুকর ডিঙ্গা, কুয়াশা ঢাকা পথ প্রান্তর এ সবই তার কাব্যে অপরূপ স্বপ্নজাল রচনা করেছে। তাকে কেউ বলেছেন নির্জনতম কবি, কেউ বলেছেন স্যুর রিয়্যালিস্ট, কেউ বলেছেন মিস্টিক। স্বয়ং কবির মতে এ সবই অংশত সত্য। কিন্তু এই খন্ডিত দৃষ্টিতে তার সমগ্র কাব্য বিচার চলে না। তিনি প্রকৃতপক্ষে জীবনবাদী কবি। তবে তার সেই জীবনকে স্থান কালের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যায় না। কালোত্তীর্ণ নিত্য প্রবহমান সেই মহাজীবন প্রকৃতির অন্তর চেতনার গাঢ় অনুভবে মগ্ন। তার লেখনির জাদুস্পর্শে সেই মহাপৃথিবীর চিত্রকল্প পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় যা 'চিত্ররূপময়'।
ছেলেবেলার বরিশালের অনুপম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য জীবনানন্দের রক্তে মিশে গিয়েছিল যার এক পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কীর্তন খোলা নদী। স্টীমার ঘাটের রাস্তা, ঝাউ গাছের সারি, শ্মশানের পথ, লাশ কাটা ঘর, খাল বিল, ফুল পাখি কোন কিছুই তিনি ভুলতে পারেননি। এসবই তার কবিতার মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠেছে। তার সমস্ত কবিতাই কোন না কোন অর্থে প্রকৃতির কবিতা।
'একদিন জলসিঁড়ি নদীটির পারে এই বাংলার মাঠে/ বিশীর্ণ বটের নিচে শুয়ে রব-পশমের মত লাল ফল/ঝরিবে বিজন ঘাসে-বাঁকা চাঁদ জেগে রবে'। অথবা
'আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে -এই বাংলায়/হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে/হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে/কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়'
রোমান্টিকতা জীবনানন্দের আত্মানুভূতির অপর নাম। প্রকৃতি ছাড়া রোমান্টিকতার পূর্ণবিকাশ সম্ভব নয়। আধুনিক যুগের প্রেমের সংকটময় রূপ দেখে ব্যথিত কবি ছুটে গেছেন অতীতে-
'হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে/সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে/অনেক ঘুরেছি আমি, বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে/সেখানে ছিলাম আমি, আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে/আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন/আমারে দু দন্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।'
সুদূরের আকাঙ্ক্ষা এবং রহস্যময় অস্পষ্টতার আস্বাদ পাওয়া যায় জীবনানন্দের লেখা গীতিকবিতাগুলির মধ্যে। তার লেখা 'হায় চিল ' কবিতাটি
বাংলা সাহিত্যের একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ গীতিকবিতা----
'হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে/তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে উড়ে ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে/তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে/পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে-'
জীবনানন্দের কবিতায় যে চিত্রকল্প ফুটে ওঠে তারই ব্যাখ্যা সূত্রে তাঁকে বাংলা কবিতায় পরাবাস্তবতার প্রবর্তক বলে উল্লেখ করা হয়। মানুষের মনের তিনটি স্তর চেতন ,অবচেতন এবং অচেতন। পরাবাস্তবতার তত্ত্ব অবচেতনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে ফ্রয়েডের তত্ত্বের ভিত্তিতে। জীবনানন্দের কবিতায় বহু চিত্রকল্পে পরাবাস্তব চেতনার প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়-
'স্বপ্নের ভিতরে বুঝি-ফাল্গুনের জ্যোৎস্নার ভিতরে/দেখিলাম পলাশের বনে খেলা করে/হরিণেরা ,রূপালী চাঁদের হাত শিশিরে পাতায়/বাতাস ঝারিছে ডানা-মুক্তা ঝরে যায়/পল্লবের ফাঁকে ফাঁকে- বনে বনে -হরিণের চোখে/হরিণেরা খেলা করে হাওয়া আর মুক্তার আলোকে।'
বনলতা সেন পর্যায়ে জীবনানন্দের কবিতা গভীরভাবে প্রতিকাশ্রিত। সুচেতনা কবিতাটি ইতিহাস চেতনায় নিষিক্ত হয়ে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় সুচৈতন্যের উদ্বোধন ঘোষণা করে-
'এই পথে আলো জ্বেলে- এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে/ সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর- কাজ /এ বাতাস কি পরম সূর্য করোজ্জ্বল/ প্রায় ততদূর ভালো মানব সমাজ /আমাদের মতো ক্লান্ত ক্লান্তিহীন নাবিকের হাতে /গড়ে দেব আজ নয় ঢের দূর অন্তিম প্রভাতে।'
প্রকৃতি নারী ও বোধ এই তিনটি বিষয় জীবনানন্দের কবি জীবনের সৃষ্টিকর্মের মূলে অধিষ্ঠিত। তার মৃত্যু ভাবনা প্রায় ছায়ার মত এই তিন মৌল বিষয়কে অনুসরণ করে এসেছে। তার অধিকাংশ কবিতায় মৃত্যুচেতনা কোন না কোন ভাবে উপস্থিত । কখনো স্পষ্ট উচ্চারণে কখনো বা প্রতীকে-
'তোমার বুকের থেকে একদিন চলে যাবে তোমার সন্তান/ বাংলার বুক ছেড়ে চলে যাবে; যে ইঙ্গিতে নক্ষত্র ঝরে/ আকাশের নীলাভ নরম বুক ছেড়ে দিয়ে হিমের ভিতরে ডুবে যায়...'
মহাপৃথিবী কাব্যগ্রন্থের আট বছর আগের একদিন কবিতাটি জীবনানন্দের মৃত্যুচেতনার এক শিহরণ জাগানো উদাহরণ-
'শোন
তবু এ মৃতের গল্প ,-কোনো
নারীর প্রনয়ে ব্যর্থ হয় নাই;
বিবাহিত জীবনের সাধ কোথাও রাখেনি কোন খাদ, সময়ের উদবর্তনে উঠে এসে বধূ
মধু -আর মননের মধু
দিয়েছে জানিতে ;
হাড়হাভাতের গ্লানি বেদনার শীতে
এ জীবন কোনদিন কেঁপে ওঠে নাই;
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের পরে।'
জীবনানন্দ একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। সেকালের বিখ্যাত ব্রজমোহন স্কুলে তার শিক্ষারম্ভ। পরে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্স এবং ১৯২১ সালে ইংরেজিতে এমএ পাস করে পরের বছরই সিটি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় তাঁর অধ্যাপক জীবন কখনোই সুস্থির হয়নি। বিভিন্ন সময়ে তাঁর কর্মচ্যুতি হয়েছে এবং চাকরির জন্য হন্যে হয়ে তাকে কলকাতা , দিল্লি, বরিশাল বিভিন্ন জায়গায় ছুটে বেড়াতে হয়েছে। অভাব, অসচ্ছলতা এবং কর্মহীনতার জন্য এক গভীর অনিশ্চয়তায় মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাঁর জীবনের পঞ্চান্নটি বছর অতিবাহিত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ,দেশভাগ এবং হৃদয়হীন সমাজ তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। রক্তাক্ত হৃদয়েও তিনি রচনা করে গেছেন চিত্ররূপময় স্বপ্ন জগত তাঁর কাব্য সম্ভার।
গভীর মর্ম বেদনায় ক্লান্ত অবসন্ন এবং চিন্তামগ্ন কবি ১২ই অক্টোবর ১৯৫৪ সালে বালিগঞ্জের কাছে ট্রাম দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন এবং ২২শে অক্টোবর রাত এগারোটা পঁয়ত্রিশ মিনিটে কলকাতার শম্ভুনাথ পন্ডিত হাসপাতালে তাঁর জীবন দীপ নির্বাপিত হয়।
বাংলার বুক থেকে কালের নির্মম নিয়তি কবিকে ছিনিয়ে নিয়ে গেলেও বাংলাকে ভালোবেসে তার সৌন্দর্যকে কবি অন্তরে এমনভাবে গ্রহণ করেছিলেন যে মৃত্যুর মধ্যেও সেই ভালোবাসা সুন্দরতর ও মাধুর্য্যময় হয়ে উঠবে এই ছিল তাঁর একান্ত আকাঙ্ক্ষা-
'তবু যেন মরি আমি এই মাঠ- ঘাটের ভিতর
কৃষ্ণা যমুনার নয় -যেন এই গাঙুরের ঢেউয়ের আঘ্রাণ
লেগে থাকে চোখে মুখে- রূপসী বাংলা যেন বুকের উপর
জেগে থাকে; তারি নিচে শুয়ে থাকি যেন আমি অর্ধনারীশ্বর।'
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴