জীবনসখা বন্ধু হে আমার/মমতা পাল চন্দ
জীবনসখা বন্ধু হে আমার
মমতা পাল চন্দ
প্রিয় জীবন সখা,
বন্ধু হে আমার, তোমাকে যাপন করতে করতে বহু প্রশ্ন আমার ভেতর বুকের চিলে কোঠায় থরে থরে জমে রয়েছে। যখন আমি হাজার মুখের ভিড়ে তখন মনে হয় জীবন, তোমার সব রং আমি দেখে ফেলেছি - চিনে নিয়েছি তোমায়। আবার যখন আমি নিতান্ত একা তখন মনে প্রশ্ন জাগে জীবন তুমি আসলে কে ? তুমি আসলে কি ?
লোকে বলে 'জীবন বিতায়া নেহি যাতে - জীবন জিয়া যাতা হে - জীবন জিনা পরতা হে।" অর্থাৎ জীবন কাটানো নয় জীবন যাপন করতে হয় - জীবন বাঁচতে হয়। আর জীবন তোমাকে যাপন করতে - বাঁচতে গিয়েই তো যত সমস্যা। কারণ এই জীবন বাঁচার মানে এক একজনের কাছে যে এক এক রকম। কারও কাছে জীবন যাপন যদি পুজো হয় তো কারও কাছে তার মানে সম্পদশালী হওয়া।বহু মানুষের মুখে একই কথা। একটাই তো জীবন। পড়াশুনো, ব্যবসা,তোলাবাজি, চুরি ডাকাতি, ঘুষ যা খুশি করে হলেও সবাইকে টাকা রোজগার করে বড় হতে হবে - প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। সমাজে স্ট্যাটাস বাড়াতে হবে। বৈধ অবৈধ যেভাবেই হোক। কোনো মতেই গরীব থাকা যাবে না। কারণ গরীব হওয়া পাপ। গরীবি হটাও স্লোগান। কেউ যদি বলে "দাদা আমি বড় গরীব" সঙ্গে সঙ্গে সে করুণার পাত্র। অবজ্ঞার পাত্র। ও জীবন, তুমি আমায় বল না মানুষ যখন জন্ম নেয় উলঙ্গ হয়েই তো আসে এ পৃথিবীতে আর যখন চিতায় ওঠে তখন তুমি তো মানুষকে সব অলংকার অহংকার খুলে সাদা কাপড়ে ঢেকে এক মুঠো ছাই বা মাটির সমষ্টি বানিয়ে দাও। তাহলে এই যে একটাই জীবন একে যাপন করতে এত আকাঙ্ক্ষা,লোভ, সব হারিয়ে যাবার হাহাকার কেন ? অনেকেই বলে সময় সব কেড়ে নিয়ে নিলো ! জীবন থেকে সব হারিয়ে গেল! ছোটবেলা আঁকড়ে বাঁচার কি আকুতি - কি অপরিসীম দুঃখ। অথচ জীবন তুমি তো জানো জীবন শুরুর ছক বা গতানুগতিক পদ্ধতি তো একই। সেখানে আরাম আয়েশ বা দারিদ্র্যের পার্থক্য থাকলেও একই আকাশ, একই চাঁদ তারার তলেই সবাই বড় হয়। এই আকাশ বাতাস নদী খালবিল তাতে কোনো দখলদারি,কোনো কার্পণ্য নেই। সবার সমান অধিকার। বরঞ্চ যারা খোলা আকাশের নিচে - গাছের তলে রাত কাটায় তারা অনেক শান্তিতে ঘুমায় এই প্রকৃতির কোলে। হাট বাজারের ফেলে দেওয়া শাক পাতা কুড়িয়ে মাটির মালসায় কাগজ পুড়িয়ে রেঁধে লবণ ভাত যারা খায় তাদের যাপনকে তুমি কি নামে অভিহিত কর ? ওটাও কি জীবন যাপন নয় ? বর্তমান প্রজন্ম বলে "খাও পিও আউর জিও।" খাও দাও আর বাঁচো। সরলতা - সততা - মনুষ্যত্ব এযুগে বোকামি। অপরের প্রতি কোনো বিবেচনা বোধের বালাই নেই - প্রয়োজন নেই। সংসার গড় - ভাঙ্গো - রাখো। স্বল্প বাস পড়ে নাইট ক্লাবে হুল্লোড় করে গভীর রাতে বাড়ি ফের। কারও কোনো অধিকার নেই কিচ্ছুটি বলার। সৌজন্যে ব্যক্তি স্বাধীনতা। তাই চুপ থাকাটাই ভদ্রতা। নীরব থাকাটাই বুদ্ধিমত্তা। তাহলে জীবনের প্রতি ভালবাসা - সত্যিকারের জীবন শৈলী সত্যিকারের যে যাপন সেটাই তো হারিয়ে যাচ্ছে! তার জন্য কি ভাবছো ? ডাকবাক্স হারিয়ে গেল তাকে আঁকড়ে বসে থাকলে ব্যাপারটা ঠিক মাটির পৃথিবীর জল সংরক্ষণের কোনো চেষ্টা না করে চাঁদে জলের সন্ধানের মত প্রয়াস হয়ে যাচ্ছে না তো ? পৃথিবীর ইতিহাস তো বিবর্তনের। রূপান্তর তো ঘটবেই। দ্রুত পরিবর্তনের যুগে মানুষের অপেক্ষা কমেছে। সময়ের অপচয় কমেছে। চিঠির জন্য প্রতীক্ষার প্রহর কি কম কষ্টকর ছিল ? অসুস্থ বাবার চিঠি সন্তানের হাতে পৌঁছনোর আগে বাবাই গত হয়ে যেতেন। কত মা ছেলের চিঠির অপেক্ষায় কেঁদে কেঁদে অন্ধ হয়ে যেতেন। এখন কয়েক সেকেন্ডে মা সন্তানের কথা হচ্ছে। মা ছেলেকে দেখতে পাচ্ছেন। এর সাহিত্যিক মূল্য হয়তো নেই। তাই এ যোগাযোগ শিল্পের মর্যাদা পায় না। কিন্তু জীবন তুমি বল তো এ যোগাযোগ সময়কে আসলে মেরে ফেলেছে নাকি অনেক বেশি জীবন্ত করে তুলেছে ? সময়কে হাতের মুঠোয় বন্দী করতে সক্ষম হয়েছে মানুষ। সময়ই তো জীবনের রাজা! তার দান হাত পেতে নিতে শিখাবে কবে ? ও জীবন তুমি বলো তো যখন Computer এলো - কি গেল গেল রব ! যখন মোবাইল এলো অনেকেই বলল অধ:পতন- সময় অপচয়। এখন মোবাইল ছাড়া জীবন অচল। ও জীবন, তোমাকে লোকে চিনবে কবে ? বুঝবে কবে ? বাঁচবে কবে ? তুমি কি শুধু জিও পিও খাও ? আর হাপিত্যেশ করে যাও ? নতুন তো আসবে। পরিবর্তন হবে।যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অভ্যস্ত হতে হবে।
আর খাওয়া তো মানুষের ভেতর যে পরমাত্মা থাকে তাকে পরিতৃপ্ত করার পুজা মনে করেন বহু মানুষ! ঈশ্বর আল্লাহর নামে নিবেদন করে খাবার মুখে তোলেন অনেকে। সে বোধের মূল্য কোথায় গেলো জীবন তুমি বল তো ? কেননা এ যুগের কিছু ফুড ব্লগারদের রাক্ষুসে খাওয়ার প্রতিযোগিতা। লেগ পিস, নাল্লি পিস, রেউয়াজি খাসি - আস্তখাসী, আস্ত মুরগি গেলার ছবি ? এগুলি সাহিত্যের কোন নান্দনিক শৈলী তুলে ধরছে জীবন তুমি আমায় জানাতে ভুলো না কিন্তু। আচ্ছা জীবন তুমি তো একটা যাপন - তুমি একটা কাল - তুমি একটা নির্দিষ্ট সময়ের প্রতিচ্ছবি - পরিধি। যার শুরু বা শেষ কোথায় কেউ জানেনা। তাই এক একটা যুগের যাপনের এর ছবির তুমিই তো প্রামাণ্য দলিল। যুগের সাথে এগিয়ে যাওয়া তোমার ধর্ম। বর্তমান হবে অতীত আর ভবিষ্যত বর্তমান।এই তো ইতিহাস। তাই জীবন তুমি একটা নিশ্চিত দর্শন। তাই তোমার একটা আদর্শ থাকাও জরুরি। যা যাপনের গর্ব এবং পরিচয় হবে নীতিবোধ - মানবিকতা - দায়িত্ব - সততা - সমতা। সেটা হারিয়ে ফেলে মানুষের গর্বের বিষয় যখন টাকার পাহাড় গড়ে বিদেশে পাঠানো। চাঁদে জমি কেনা। অন্যদিকে পয়সার অভাবে মৃতদেহ কাঁধে সন্তান স্বামী 30 কিলোমিটার হেঁটে আপনজনকে দাহ করবে ? ও জীবন সবাই যে বলে জীবনই নাকি মানুষকে আসল শিক্ষা দেয় - সাজা দেয় ? জীবনই আর সময়ই নাকি সবচাইতে বড় শিক্ষক ? তাহলে তুমি মানুষকে কি শেখাও ? মানুষ কি আদৌ কোনো শিক্ষা তোমার কাছ থেকে নেয় ? আর তোমার আদালত কোথায় ? সেটা তো মানুষেরই হাতে - মানুষের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাহলে জীবন তোমার কি আদৌ কোনো ভূমিকা আছে এ যাপনে ? মানুষ তো জীবনের সব অমৃতবাণী কে নিজের মত ব্যবহার করে । কবি টেনিসন বলেছেন "I will drink life to the lees" সৃষ্টিতে তিনি থামবেন না এতটা অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন যে জীবনের তলানী পর্যন্ত পান করবেন। অথবা 'the Night is still young'. এখন এই কথাগুলো সাহিত্যিক মূল্য হারিয়ে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়া গভীর রাতে বয় ফ্রেন্ড দের সাথে ফুর্তি করা বেহেড মহিলা মাতালের ভাষায় পরিণত ? আবার অনেক সেলিব্রিটি যাদের দুর্ব্যবহার অত্যাচারে বহু অস্থায়ী অধ:স্তনের জীবন অতিষ্ট হয়েছে তারা প্রচন্ড ভালোমানুষের ভান করে আওয়ার্ড হাতে তুলে নেন। আর মোসাহেবরা হর্ষধ্বনি হাততালিতে আসর মাতিয়ে তোলেন। তাহলে গরিবী যদি সততার ভিতের উপর দাঁড়িয়ে থাকে আর বিত্ত যদি চিত্ত হারায় তাহলে দারিদ্র দূরীকরণ কেন ? বিত্তহীন তো তাহলে আসল ধনী - অভিজাত। ক্ষমতা হাতে পেলে কিংবা সুযোগ পেলেই যে অত্যাচারী হয় তার চেয়ে যে গাছতলায় থেকেও যে চুরি করে পেট ভরানোর স্বপ্ন দেখেনা এ্যাওয়ার্ড তো তার পাওয়া উচিত। আসলে জীবনের সঠিক মানে বোঝা আর একটা যাপন কত যে কঠিন জীবন তুমিই কি সত্যি জানো ? একটা জীবন যাপন আসলে খাড়া পাহাড় বেয়ে ওঠার চেয়েও কঠিন ? যারা যাপনের ভান করে লোক সমক্ষে আমরা তাদের দেখতেই অভ্যস্ত। আসলে চারদিকে এত শিকল এত চেইন এত হাতছানি, এত ট্র্যাপ, সিস্টেম এর দাস না হয়ে বাঁচা কি আদৌ সম্ভব ?
মানুষের তো জন্ম হয় কাজ করে খাবার জন্য। তাই মানুষের কাজের ব্যবস্থা করা জরুরি। কেননা কথায় বলে ওপর থেকে দিয়ে দিলে মানুষের কর্ম ক্ষমতা মরে যায়। তাহলে মানুষের সামনে দান খয়রাতির ললিপপ ঝুলিয়ে লোভী বানিয়ে মেরুদণ্ড বিক্রি করতে বাধ্য যারা করে তাদের তুমি চেনাও না কেন জীবন তুমি ? অন্তত সঠিক পথ চেনানোর দায়িত্ব তো নিতে পারো ? নাহলে তোমার সৃষ্টিকে তুমি বিপথে চালিতই যদি কর তাহলে তুমি কিসের দর্শন ? কিসের শিক্ষক ? কিসের আদর্শ ? তাই তোমার এই খাও পিও জিও র অধ:পতন ভীষণ বিচলিত করে ফেলছে বর্তমান সমাজকে। কি করে কেউ বলবে "মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে , মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই"।আসলে মানুষের ধর্মই তো বাঁচতে চাওয়া। দুঃখ কষ্ট রোগ জ্বালা নিয়েও তো মানুষ বাঁচতেই চায়। বাঁচার কি চরম আকুতি মানুষের। মানুষ সব ত্যাগ করতে পারে কিন্তু জীবন ত্যাগ করতে চায় না। ফাঁসির আসামীর বাঁচার আকুতি মানুষকে ক্ষমাশীল করে তোলে।
তাহলে এ ভোগবাদী জীবন তো মানুষকে বাঁচার জন্য আরও মরিয়া করে তুলবে ? জীবন তখন তুমি জীবন মরণের ভারসাম্য কি করে রক্ষা করবে ? জীবন তুমি ম্যালিগন্যান্ট হয়ে যাবে তো তখন। এমনিতেই তুমি দিন দিন নিজের সম্মান হারিয়ে ফেলছো। মানুষের লোভ লালসা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ পথিক হয়ে উঠছো ? আদর্শে অনেকটাই গ্যামাকসিন লাগিয়ে ফেলেছো। দর্শনেও পলি জমেছে। মানুষ জীবন থেকে মুক্তি খুঁজতে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে। আত্মহনন বাড়ছে।
লোকে বলছে তুমি নাকি ভুয়ো। তাই জীবন তোমাকে নিয়ে আমার ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছে আজকাল। আর যাই হোক তুমি কিন্তু বিপদগামী হয়ে যেয়ো না। আমার অনুরোধ তুমি রেখো। লোভ লালসা আর ভোগের লিপ্সা কখনো জীবন নয়। জীবন মানে বৃহদর্থে মহত্তম যাপন - আলোর পথে উত্তরণ। এটা তুমি বুঝিও তোমার ধারণকারীদের আর উত্তর খুঁজে দিও এই উলুখাগড়ার প্রশ্নগুলো যদি বুঝতে পেরে থাকো ? ভালো থেকো,অনেক ভালোবাসা নিও চিরবন্ধু জীবন তুমি।
ইতি
তোমারই শুভাকাঙ্ক্ষী আমি।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴