জীবন মানে মৃত্যুর কাছাকাছি/সুনীতা দত্ত
জীবন মানে মৃত্যুর কাছাকাছি
সুনীতা দত্ত
আত্ম সন্তুষ্টি কখনোই ব্যক্তিগত জীবনে অন্তত থাবা বসায় নি। কোনদিন সেই থাবায় ক্ষতবিক্ষত হতে হবে কিনা তাও জানিনা - শুধু বাঁচি মাত্র - আগামী দিনের সূর্যোদয়ে স্নান সেরে গোধূলির আতরমাখা গন্ধে বিনিদ্র রজনী যাপন। এই তো দিনের রোজনামচা। ব্যস্ততম দিনের শেষে অনেক স্মৃতি মনের গভীরেই হারিয়ে যায় , যেমন করে দিন প্রতিদিন রাত্রির কোলে হারিয়ে ফেলে নিজেকে।
কর্মজীবনের কুড়িটা বছর পার করেও প্রতিদিন অবাক হতে হয় অসুস্থতার ইতিহাসে। রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, কখনো রোগের ক্ষতিকর জীবাণুদের প্রতিরোধ করে জয়ী করতে হয় মানুষকে তবুও হাহাকার কারণ চিকিৎসা তো শুধু শরীরের হয় না মনেরও অঢেল যোগাযোগ তাতে। ব্যক্তিগত জীবনের সীমারেখা শরীরের অলিন্দ নিলয়ের প্রকোষ্ঠে বিরাজিত তবুও হৃদয় ঘিরে মানবিকতার হাহাকার সেখানে রোগ নয়, রোগী নয় সামাজিকতার একটা ছাই চাপ আগুন ধিক ধিক করে জ্বলে। নীরবতার প্রাচীর তুলে সেখানে মন নির্বিকার অথচ চোখের সামনে কি নিদারুণ পরিহাস, হয় সহ্য কর না হয় মুখ খোল এর বাইরে বোধহয় আর কোন কর্তব্য নেই - থাকবেই বা কিভাবে পৃথিবীর চোখের সামনে এত দৃশ্যপট অনবরত বদলে যায় তবুও মনে হয় সব চরিত্রই যেন কাল্পনিক!
চৈত্রের কাঠফাটা রোদ - পাড়াটা কিছুটা শান্ত কয়েকটা মুখ এপাশ-ওপাশ করছে। কয়েকদিন ধরেই এলাকার পঞ্চায়েত মশাই বলে যাচ্ছেন "দিদি ওই চঞ্চলকে কিন্তু উচিত শিক্ষা দিতেই হবে, আপনার সাহায্য দরকার!" আমার মনে হল আমার কাজ তো কাউকে শিক্ষা দেওয়া নয়, শেখানো - তাও আবার ভালো মন্দ নয় - শুধু শরীরের আর মনের জটিল সরল সব সমস্যার সমাধানের রাস্তা বলে দেওয়া । তবুও চঞ্চলের কথা শুনতেই হল ।
চঞ্চল গ্রামের একটা সহজ সরল যুবক । অবশ্যই বিবাহিত এক ছেলেও আছে বছর সাতেকের। সে নিজে মানসিক রোগী নয় কিন্তু আচার-আচরণ কিছুটা অস্বাভাবিক। তার এক বোন মানসিক সমস্যায় জর্জরিত। বছর তিরিশের সেই বোন আর মা একই বাড়িতে তার থেকে ভিন্নভাবে বসবাস করে। মায়ের সাথে প্রায় মুখ দেখাদেখি বন্ধ থাকে। মাঝে মাঝেই অপ্রকৃতস্থ বোনকে ঘর বন্ধ করে রেখে মা বাজার ঘাট করেন। মা পেনশনভোগী তবুও সমস্যা। চঞ্চল ও তার বউ মায়ের সাথে এক হাঁড়িতে খায় না। বোনকে নিয়ে একই বাড়িতে এপাশ-ওপাশ করে থাকে। এখন সেই মা মানে চঞ্চলের মা অসুস্থ। যখন থেকে অসুস্থ তারপর কিছুদিন ওর বড় দাদা শিলিগুড়ি নিয়ে রেখেছিল। বিশেষ কিছু উন্নতি হয়নি, কয়েকদিন আগে উনাকে অসুস্থ অবস্থাতেই চঞ্চলের কাছে দিয়ে গেছে। চঞ্চল এর কাছে যদিও নয় কারণ ওরা তো আলাদা থাকে। মা যে কয়দিন বাড়িতে ছিল না বোনের কি হয়েছে, সে কি করেছে চঞ্চল বা তার বউ পাশের ঘর থেকে বসে বসে অনুভব করেছে কিন্তু নিজের হাতে অপ্রকৃতস্থ বনের জন্য কিছুই করেনি। ফলস্বরুপ সারা ঘরময় দুর্গন্ধ ছড়িয়েছে মলমূত্র । এভাবেই মেয়েটা আধমরা হয়েছে। আশপাশের বাড়ির লোক মাঝে মাঝে জল মুড়ি ইত্যাদি খাবার দিয়েছে জানালা দিয়ে কিন্তু দুজন মহিলা বলে কেউ ঘরে যায়নি - যাবেই বা কিভাবে সে ঘরে অন্তত কোন মানুষের বাস সম্ভব নয়। এইরকম এক ভয়ানক পরিস্থিতিতে পঞ্চায়েত মশাই আমাকে কিছু করার জন্য বলেছেন যাতে অন্তত মা মেয়ে দুজনের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়। যেদিন উনি সব জানিয়ে গেলেন তার একদিন পর আমি নিজস্ব গন্ডির দায়িত্বপ্রাপ্ত কয়েকজনকে নিয়ে সেখানে গেলাম অথচ কি নিদারুন সত্য উপলব্ধি করলাম তা বোধ হয় ভাষায় প্রকাশ্য নয়। বাড়িতে ঢোকার রাস্তা প্রায় নেই জঞ্জাল আবর্জনায় ঢাকা। ওনার এক বারান্দা দিয়ে দরজা খোলা ঘরে প্রবেশ করে দেখি মানসিক রোগগ্রস্ত বোনটি পড়ে আছে মেঝেতে। সারা ঘরে মলমূত্রের অসহ্য গন্ধ তার মধ্যেই মেয়েটি পড়ে আছে। আমি জল দিলাম সাথে ও আর এস দিয়ে। বেশি খেতে পারল না। ওকে তুলে ওঠানোর মতো কোনো মনের জোর আমার ছিল না চোখ পরল ভিতরের ঘরে - এক মহিলা বিছানার থেকে পা নিচের দিকে দিয়ে শোয়া। আমার পাশে আরেকজন স্বাস্থ্যকর্মী কিন্তু সে কোনভাবেই দুর্গন্ধ এড়িয়ে ভেতরের ঘর পর্যন্ত যেতে পারলেন না। অগত্যা আমি একাই ওই ঘরে মহিলাটিকে পরীক্ষা করলাম। অসাঢ় দেহ প্রথমে ভেবেছিলাম - অচেতন অবস্থায় আছেন কিন্তু না হৃদযন্ত্রের কোন সাড়া ছিল না, নাড়ি ও চলছিল না। একটু ঘরের এদিক ওদিক দেখে নিলাম - নাহ ! এ ঘর কয়েক মাস যাবত পরিষ্কার হয়নি , ওই মহিলা যেদিন থেকে অসুস্থ তবে থেকে রান্না খাওয়া কিছুই হয়নি। সারা ঘরময় শুধু দুর্গন্ধ। বাইরে ততক্ষণে পাড়ার অনেক লোক জড়ো হয়েছে, এত আওয়াজ হওয়াতে ও চঞ্চল বা তার পরিবার বেরিয়ে আসেনি। পঞ্চায়েত মশাই ততক্ষণে এলাকার স্থানীয় এক ডাক্তার বাবুকে (গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার) ডাকলেন - এক তলায় তার পরীক্ষার পর তিনি জানালেন ওই মহিলা বেঁচে নেই। এবার স্থানীয় লোকজন চঞ্চলকে ডাকলেন, ও অনেকক্ষণ পর বাইরে বেরিয়ে এল। ওর দাদা যার কাছে মহিলা বেশ কিছুদিন ছিলেন তাকে ফোন করা হলে সে প্রথমে তোলেনি তারপর ফোন বন্ধ হয়ে গেল । আর সে ফোন তোলেনি। ওই ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে আমার বা আমার সাথে যারা স্বাস্থ্য দপ্তরের কর্মী ছিলেন তাদের কিছু করার ছিল না।। চঞ্চল কে দেখছিলাম সুস্থ সবল যুবক অথচ একবারও মা আর নেই শোনার পরও ঘরে গেল না মাকে দেখতে। আমি ওকে বললাম তাড়াতাড়ি যা করবে করে বোনকে ওই ঘর থেকে পরিষ্কার করে বের করতে না হলে ওই জীবিত মানুষটাও লাশ হয়ে যাবে। এর পরের গল্প গতানুগতিক পুলিশ আসবে না ডাক্তার না অন্য কিছু সেটা সবাই মিলে ঠিক করছিল। আমি আরো কিছুক্ষণ পর চলে এলাম।
আমরা সন্তান সংসার এসব নিয়ে খুব চিন্তিত। অথচ ওই দৃশ্য দেখার পর ধারণাগুলো হোঁচট খেয়েছিল সেদিন । পাশের ঘরে ছেলে - মা তার পাশের ঘরে কয়েক ঘন্টা ধরে মৃত অবস্থায়, এ কোন সমাজের বাসিন্দা আমরা? সেদিন আমার নির্বিরোধ ভাবে একটা কথাই মনে হয়েছিল সন্তান যদি এমন হয় তাহলে নিঃসন্তান থাকা অনেক শ্রেয়। আরো নিদারুণ কঠিন অবস্থা ওই অপ্রকৃতস্থ মেয়েটির। যুবতী একটি মেয়ে কথাও বলতে পারেনা- নিজের শরীরের যত্নটাও নিতে পারেনা -তার কি দোষ? পরিবার পরিজন নিয়ে যারা সুখে শান্তিতে থাকেন তাদের কাছে এই দৃশ্য বড় অসহায়ত্বের, বড় বেদনার! আজও মেয়েটিকে মাঝে মাঝে দেখতে যাই পরিবেশ একটু বদলেছে। দাদা বোনকে দেখে রাখে তবে পরিছন্নতার বড়ই অভাব। আমার যা বলার সব বলি মেয়েটিকে ওরা কোন মানসিক হাসপাতালে দেবে না অথচ অপরিচ্ছন্ন রাখার কথা বললে মানতে চায় না। ঘরে ঢোকার মুখে আগাছা ওটা দেখে একদিন চঞ্চলকে বলেছিলাম ,"জঙ্গল গুলো কেটে ফেলো সাপ খুব ঢুকে যাবে।" চঞ্চল আমায় উত্তর দিল -"সাপ তো আছেই মাঝে মাঝে আসেও, ওরা কিছু করে না দিদি ,মানুষ ওদের থেকে বেশি ভয়ংকর।"
আমি সেদিন আর কথা বলতে পারিনি। ও কোন দৃষ্টিকোণে কথাটা বলেছিল তা শুনতে চাইনি তবে কথাটা যে খুব একটা অযৌক্তিক তাও নয় ওই কথার সবচেয়ে বড় উদাহরণ যে ও নিজে সে কথা ও জানে না বোধহয়। মনের কোনে অনেক ঝড় বয়ে যায়, সমাজের এ কি হাল ! জীবনের দোরগোড়ায় মৃত্যু যখন হাতছানি দেবে তখনও এ দৃশ্য, ওই ঘটনা মনকে লজ্জায় ফেলবে - বারবার মনে করাবে চঞ্চল ওর মা আর বোনের কথা। এ কোন বেঁচে থাকা - মৃত্যুকে পাশে নিয়ে জীবনের কাছে এগিয়ে যাওয়া।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴