জলে-জঙ্গলে/মধুমিতা দে রায়
জলে-জঙ্গলে
মধুমিতা দে রায়
বছর ১৫ আগে এক বৈশাখে দীর্ঘদিনের ইচ্ছা পূরণ হল, সুন্দরবনে যাবার। আমি, কর্তা মশাই, আমাদের ছোট্ট ছেলে এবং কর্তা মশাই-এর বন্ধুসম দুই দাদা তাদের পরিবারসহ, সবে মিলে ন'জন ভ্রমণসঙ্গী। ট্রেনে কলকাতায় নেমে সেখান থেকে গাড়িতে ক্যানিং। তারপর সেখান থেকে ভুটভুটিতে পাখিরালয়। উত্তরবঙ্গের মেয়ে, তাই ছোট থেকে চা বাগান জঙ্গল নদীর কাছেই বেড়ে ওঠা। কিন্তু আমাদের ডুয়ার্সের নদী সংলগ্ন মাটিতে বালির ভাগ বেশি, অপরদিকে সুন্দরবনের নদীগুলি বঙ্গোপসাগরের সন্নিবিষ্ট হওয়ায়, অর্থাৎ মোহনার কাছে হওয়ায়, মাটিতে পলির ভাগ খুব বেশি, তাই স্বভাবতই নদীর পারে নেমে লঞ্চে উঠতে বা নামতে বেশ অসুবিধাই হল, অনভ্যাসে পা পিছলে যাবার সম্ভাবনা খুব বেশি। কিন্তু ওখানকার স্থানীয় মানুষেরা সেখানেই যথেষ্ট সচ্ছন্দভাবে চলাফেরা করছিলেন। পাখিরালয়ের একটি ছোট্ট সুন্দর রিসোর্টে আমরা রাত্রি যাপন করলাম। সুন্দরবনের নদীগুলির জল লবনাক্ত তাই পানীয়যোগ্য নয়। আমাদের রিসোর্টিতে একটি ছোট মিষ্টি জলের পুকুর ছিল, স্থানীয় গ্রামের মানুষেরা এই রিসোর্টের পুকুরটি থেকেই তাদের নিত্যদিনের খাবার জল সংগ্রহ করতেন। তাই গ্রামের মানুষদের আনাগোনা লেগেই থাকত। আমরা যেদিন পৌঁছলাম দিনটা ছিল পূর্ণিমা তিথি। সন্ধ্যার পর মাতলা নদীর বাঁধে হাঁটতে গিয়ে নদীর জলে প্রতিফলিত চাঁদের ঝিলমিল আলোয় এক অপরূপ সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করলাম। জোয়ারের জল বারেবারে ছলকে উঠে চারিদিকের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে দিচ্ছিল। অপূর্ব সেই দৃশ্য মনের ঘরে চিরকাল রয়ে যাবে। রাত্রিবেলায় রিসোর্টে গল্পের আসরে কেয়ারটেকার রামচন্দ্রবাবুও যোগ দিলেন। সুন্দরবনের মানুষদের কিভাবে নিত্যদিন বাঘ আর কুমিরের সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয় সে গল্পই শোনালেন তিনি । এমনকি তার নিজের পরিবারের সাথে ঘটে যাওয়া একটি দুর্ঘটনা কথা শুনে আমরা রীতিমতো শিউরে উঠলাম। কাবেরী, রামচন্দ্র বাবুর স্ত্রী, এই রিসোর্টে রাঁধুনির কাজে বহাল, একদিন মাছ ধরতে খাঁড়িতে গিয়েছিলেন, হঠাৎ করেই ওঁর অজান্তে খুব সন্তর্পনে এক কুমির এসে পায়ের উপরের অংশে কামড় বসায়। কুমিরের বিশাল হাঁ-মুখের এর ভেতর কাবেরীর পা থেকে কোমর অব্দি অংশ ঢুকে যায়, তিনি সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে থাকেন এবং হাতের মাছ ধরার হাঁড়িটি দিয়ে কুমিরের পিঠে অনবরত আঘাত করতে থাকেন। ওঁনার শব্দ শুনে রামচন্দ্রবাবু ও চারপাশ থেকে গ্রামের মানুষেরা লাঠি দাঁ প্রভৃতি নিয়ে দৌড়ে আসেন এবং ঝাঁপিয়ে পড়ে জলে নেমে কুমিরটিকে আঘাত করতে থাকেন। কুমিরের ছটফটানিতে আরো বেশি করে দাঁত বসে যেতে থাকে কাবেরির পায়ে, এক সময় আঘাত সহ্য করতে না পেরে কুমিরটি কাবেরীর পা ছেড়ে দেয় এবং জলের গভীরে পালিয়ে যায়। রামচন্দ্র বাবুর অনুরোধে কাবেরী আমাদের তাঁর কোমরের ক্ষতস্থান দেখিয়েছিলেন। প্রায় ১২৫ টি সেলাই পড়েছিল কাবেরীর সম্পূর্ণ ক্ষতজুড়ে।
পরদিন সকালে আমরা স্থানীয় মানুষদের মিন বা ছোট চিংড়ি মাছের চাষ পদ্ধতি দেখে নিলাম, যা সুন্দরবনের অনেক মানুষের পেশা। পাখিরালয় থেকে আমরা নিজেদের একটি ছোট লঞ্চ ভাড়া করে নিয়েছিলাম এবং খাবার সমস্ত সামগ্রী লঞ্চে তুলে নেওয়া হয়েছিল। সেই লঞ্চের ভেতরের একতলায় রান্নাবান্নার ব্যবস্থা হয়েছিল আর দোতালায় ছিল আমাদের বসবার জায়গা। পাখিরালয়ের উল্টো দিকেই সজনেখালি ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের অফিস। এই অফিস থেকেই জঙ্গলে প্রবেশ করবার সমস্ত রকম পাস পাওয়া যায়। যারা মধু সংগ্রহ করতে যান তাঁরাও এখান থেকে পাস সংগ্রহ করে জঙ্গলে প্রবেশ করেন এবং মধু জমা দিতেও এই অফিসেই তাঁদের আসতে হয়। আমরাও সেখান থেকে পাস সংগ্রহ করে নিলাম। পাখিরালয়ের বনদপ্তরের একটি জলাশয়ে কুমিরও রাখা হয়েছিল। নদীর তীরে চোখে পড়ল অনেক সন্ন্যাসী কাঁকড়া, ক্যাট ফিস ইত্যাদি। এরপর আমরা চললাম খাঁড়ির ভেতর দিয়ে বিভিন্ন ওয়াচ টাওয়ার গুলি দেখতে। খাঁড়ির দুপাশে ঠেসমূল আর শ্বাসমূল যুক্ত বিভিন্ন রকমের গাছের ঘন অরণ্য- সুন্দরী, গড়ান, গেঁওয়া, হেতাল এগুলির মধ্যে অন্যতম। খাঁড়ির মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় বনবিবি এবং দখিন রায়ের ছোট ছোট মন্দির চোখে পড়ল। সুন্দরবনের মানুষের বিশ্বাস বনবিবি তাঁদের রক্ষা করেন দখিন রায়ের হাত থেকে। তাই তাঁরা মধু সংগ্রহ করতে যাবার সময় বনবিবির পূজা করে রওনা হন। পৌঁছালাম দোবাকি ওয়াচ টাওয়ারে। চারিদিকে ব্যারিকেড করা জঙ্গল, যদিও তেমন কোনো পশুর দেখা পেলামনা। এরপর এক এক করে দেখে নিলাম নেতি ধোপাণি বিট অফিস, সুধন্যখালি ওয়াচ টাওয়ার। মনসামঙ্গল আছে বেহুলা লক্ষিন্দর কে নিয়ে এই পথে যাবার সময় দেখা হয়েছিল নেতি ধোপানির সাথে, তাই এই স্থানটির এমন নামকরণ। বিভিন্নরকমের পাখি, হরিণ, প্রভৃতি দেখলেও বাঘ দেখবার সৌভাগ্য হয়নি। ফিরবার সময় আমরা পঞ্চমুখানি হয়ে মাতলা নদীতে উঠলাম। পঞ্চমুখানি, অর্থাৎ পাঁচটি নদীর মুখ বা মিলনস্থল। পাঁচটি নদী যথাক্রমে পদ্মা, মেঘনা, ভৈরব, মধুমতি ও হুগলি। এই নদীসঙ্গমে যেমন দিগন্তবিস্তৃত জলরাশি তেমনি স্রোত। লঞ্চের দুলুনিতে রীতিমতো ভয়ের উদ্রেক হয়েছিল আমাদের সকলের। সকালে যাবার পথে ভাটার সময় যে গাছগুলির শেকর মাটি থেকে অনেকটা বেরিয়েছিল ফেরবার সময় দেখলাম জোয়ারের জলে সেগুলো অনেকটাই নিমজ্জিত। ফেরবার পথে মাতলা নদীতে লঞ্চ যখন মাঝ নদীতে তখন কালবৈশাখীর কবলে পড়লাম আমরা। কোনমতে তীরের কাছাকাছি নিয়ে গেলেন লঞ্চচালক, আমাদের নির্দেশ দেওয়া হল লঞ্চের নীচতলায় চলে যাবার। কালবৈশাখীর এমন ভয়ঙ্কর রূপ প্রত্যক্ষ করবার অভিজ্ঞতা সেই প্রথম হয়েছিল। এমনকি লঞ্চচালক নিজেও স্বীকার করেছিলেন মাঝনদীতে থাকলে লঞ্চ উল্টে যাবার প্রভূত সুযোগ ছিল, কোনো মতে তীরে ভেরানো গেছে এই যা রক্ষে।
সুন্দরবনে গিয়ে দেখেছি ওখানকার স্থানীয় মানুষগুলো খুব সহজ সরল কিন্তু তাঁদের জীবনযাত্রা বেশ কষ্টসাধ্য। খাবার জলের অভাব, যাতায়াতও কষ্টকর তাই গুরুতর অসুস্থ হলেও সহজে সুচিকিৎসা লাভ করা সম্ভব নয়। এছাড়াও সামুদ্রিক ঝড় বা অন্যান্য প্রকৃতিক দুর্যোগতো লেগেই রয়েছে। পর্যটকদেরও আরও দায়িত্ববান হতে হবে। প্রায় ১৫ বছর আগে দেখা সুন্দরবন হয়তো অনেকটাই পাল্টে গেছে আজ, হয়তো আগের চেয়ে এখন অনেকটাই উন্নত। এবং সেই উন্নতি অবশ্যই স্বাগত। পশু ও মানুষের নিরাপদ সহাবস্থান হয়ে সুন্দর এই বন আরও সুন্দর হয়ে উঠুক।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴