জন্মভিটে/দেবাশীষ বক্সী
জন্মভিটে
দেবাশীষ বক্সী
এই যে নদী, খাল, বিল, ওই যে দূরে আম-কাঁঠালের ছায়ায় ঘেরা ছোট্ট খড়ের ঘর, সবুজ ধানের ক্ষেত, মেঠো পথের বাঁকে বাঁকে তাল, সুপারি, খেজুরের সারি, দোয়েল, শ্যামা, ফিঙে আরও কত শত পাখির গুঞ্জন - সবকিছুই বড্ড চেনা চেনা লাগছে। কবির কলমে লেখা বা শিল্পীর তুলিতে আঁকা অনন্য সুন্দরী গ্রাম্য প্রকৃতির অপরূপ রূপ। কোথাও মটর খেতে বেগুনি ফুল কোথাও বা দিগন্ত বিস্তৃত হলুদ সর্ষের ক্ষেত কখনো বা নীল আকাশে সাদা সাদা মেঘের ভেলা কখনো বা কাজল কালো মেঘে ঢাকা আকাশ। বাংলার ছয়টি ঋতু মিলেমিশে একাকার। প্রতিটি ঋতুই গন্ধে বর্ণে রূপে আলাদা। আমার চোখ মনকে মোহগ্রস্ত করে তুলেছে। কখনো গরুর গাড়ি কখনো বা পালকি, দিগন্তবিস্তৃত ঝিলে নৌকায় করে এগিয়ে চলেছি।
ঠা ঠা রোদ। গাছের পাতা নিথর। চাতক পাখি ডাকছে। ঝুপসি আম-কাঁঠালের ছায়ায় একদল বুড়ো খাটিয়ায় বসে ঝিমুচ্ছে। পালকি দেখে কাহারদের উদ্দেশ্যে তারা বলে ওঠে , "কে যায়?"
ভারি অবাক হয়ে যাই। মনটাও অভিভূত হয়ে ওঠে । খুব ছোটবেলায় ঠাকুর্দা বলতেন , তিনি যখন দেশের বাড়িতে যেতেন পালকিতে চেপে , গাঁয়ের লোকেরা পালকি চালকদের উদ্দেশ্যে একই কথা বলতেন । পালকি চালকেরা সমস্বরে বলতেন , " ঠাকুর্দা যায় ।"
শুধু কি তাই ? দেখতে দেখতে কোন ফাকে ঈশান কোণে ঘন কালো মেঘ জমেছে। মেঘের সাথে মেঘের ঝগড়া লেগে গুরুগুরু শব্দে চারিধার কেঁপে উঠছে। গুরু গুরু মেঘের গর্জনের শব্দ শুনে অবাক বিস্ময়ে দেখি একঝাঁক কৈ মাছ বিলের জল থেকে বেরিয়ে সারি বেঁধে ডাঙায় উঠে আসছে। একটি কিশোর ছেলে পরনে হাফ প্যান্ট একটি লাউয়ের বাউসের ভিতর সেই কৈ মাছগুলো ধরছে আর রাখছে। আমি আদুরে গলায় কিশোরটিকে বললাম , "কয়খানা মাছ ধরলে গো ?" ছেলেটি মুচকি হেসে বলল, "আশি খানা।"
ভারি অবাক হয়ে যাই, ছেলেটির কথায় নয়, ঘটনাটি চাক্ষুষ উপলব্ধি করে। বাবার যখন কিশোর বয়স এমনি এক মেঘ মাতালের দিনে ঠিক এই ভাবেই আশিখানা কৈ মাছ ধরে ছিলেন। দেশের বাড়ি কথা উঠলে বাবা কতবার উৎসাহে এই গল্পটি আমাদের বলতেন।
সামনে দিগন্ত বিস্তৃত ঝিল। টলমলে স্বচ্ছ জল। জলের বুকে শরতের আকাশের প্রতিচ্ছবি। ঝিলের পাড়ে নৌকা বেঁধে দশাসই চেহারার এক মাঝি হাস্য মুখে আমার পানে চেয়ে রয়েছে। পরনে চেক লুঙ্গি কোমরে একখানা গামছা বাঁধা। আদুল গায়ে কষ্টি পাথরের মতো শরীর। গলায় ঝুলছে বড় একটি মাদুলি। থুতনিতে একগোছা দাড়ি। আমার চোখে বিস্ময়। আমার শৈশবে বাবার মুখে বারবার একটি মানুষের গল্প শুনতাম। মানুষটি যেমন সাহসী তেমনি শক্তিশালী ছিল। দৈত্যের মতন চেহারা হলেও মনটা ছিল তার অতি কোমল। দুস্থ, গরিব মানুষের সেবা সে যেমন করত তেমনি দুষ্টু লোকেরা তাঁকে যমের মতো ভয় পেত। সেই সময় গায়ে গঞ্জে ডাকাতের খুব উপদ্রব ছিল। আব্দুল চাচা (নামটা ঠিক মনে করতে পারছি না ) নাকি মন্ত্র পড়ে বাড়ি বন্ধন করতে পারতেন। ডাকাতের দল সারারাত ধরে হাজার চেষ্টা করলেও সেই বাড়িতে নাকি ঢুকতে পারত না । শৈশবে মনের ভেতর কল্পনায় আব্দুল চাচার যে ছবি এঁকেছিলাম, আজ সামনের মানুষটির সাথে তার সাদৃশ্য দেখে অনন্য সুখানুভূতি অনুভব করতে লাগলাম। আব্দুল চাচার স্নেহময় হাতছানিতে আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো নৌকায় উঠে পড়লাম। নৌকা চলতে লাগল। মাছরাঙ্গা, পানকৌরি দল মাছের আশায় ঝিলের জলে বসে রয়েছে। ছলাৎ ছলাৎ শব্দে আমরা এগিয়ে চলেছি। বেশ কিছুটা পথ চলার পর পাড় দেখা যায়। সবুজ শ্যামল একটি গ্রাম আমার চোখে ভেসে ওঠে। আব্দুল চাচা ডানহাত দিয়ে দিক নির্দেশ করে বলে, "ওই দেখো পাকুড়িয়া (জেলা গাইবান্ধা ) গ্রাম। আম-কাঁঠালের ছায়ায় ঘেরা ঐ যে বড় বাড়ি, ওটিই তোমার পূর্বপুরুষদের বাড়ি। তোমার বাপ ঠাকুরদার জন্মভিটে। দেখো, তোমায় দেখবে বলে কত লোক জমা হয়েছে। নৌকা প্রায় পাড়ের কাছে। আমি আনন্দে আত্মবিস্মৃত হয়ে চিৎকার করে উঠি .......
হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। স্বপ্নের রেশ তখন দুচোখ ভরে । মন কেঁদে ওঠে। অনুভব করলাম ছেলেটি আশ্লেষে আমায় জড়িয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে। ওর মাথাটি আমার বুকের মাঝে। সন্তানের শরীরের উষ্ণতা এবং শরীরের মিষ্টি গন্ধে আমার দুঃখ ধীরে ধীরে ফিকে হতে লাগে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴